সত্যিই কি বিরসা মুন্ডা ছিলেন বিষ্ণুর একাদশ অবতার?

ভারতের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের আদিবাসী শাখার অন্যতম লোক নায়ক বিরসা মুন্ডার জন্মদিন আজকে। আজকের দিনে বিরসা মুন্ডার ১৪৬ তম জন্মবার্ষিকী পালন হচ্ছে সারাদেশে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ঝাড়খন্ড এলাকার আদিবাসীদের কাছে বিরসা মুন্ডা একটি চিরস্মরণীয় নাম। মুন্ডা জনজাতির কাছে, বিরসা মুন্ডা আজকে ধরতি আব্বা নামেই পরিচিত হন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিরসা মুন্ডার অবদান অনস্বীকার্য। আদিবাসীদের লড়াইয়ের ইতিহাসে সিধু কানহু যেমন জনপ্রিয়, ঠিক একইভাবে জনপ্রিয় বিরসা মুন্ডা। ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর ঝাড়খণ্ডের রাচি জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিরসা মুন্ডা। মাত্র ২৫ বছর বেঁচে ছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী, কিন্তু তার মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম তুলে ধরেছিলেন বিরসা মুন্ডা।

 সেই সময় সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বৈরাচারী শাসনে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সকলে। মঙ্গল পান্ডের সিপাহী বিদ্রোহের পর এই লড়াইয়ের আগুন যেন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল সারা ভারতে। সারা ভারতবাসীদের মনে ভগৎ সিংয়ের মতো নেতারা স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ জাগাতে পারলেও আদিবাসীদের মনে এখনো স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে ওঠেনি। সেই সময় আদিবাসীদের ইংরেজ দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সম্মানের সাথে জীবনযাপন এর মর্ম বুঝিয়েছিলেন বিরসা মুন্ডা। ঝাড়খণ্ডের সিংহ ভূমি এবং রাচি এলাকায় যে মুন্ডা জনজাতি বসবাস করে তাদের কাছে বিরসা মুন্ডা আজকেও ভগবানের সমান।

 ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আদিবাসী নেতাদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় এই বিরসা মুন্ডা। জীবনের প্রথম দিকে ভয়ঙ্কর দারিদ্রতার সম্মুখীন হলেও সেই দারিদ্রতার জন্য কোনদিন হার মেনে যাননি বিরসা মুন্ডা। তার পিতার নাম ছিল শুগনা মুন্ডা এবং তার মা তার নাম ছিল করমি হাট্টু। বিরসা মুন্ডার বাবা-মা মাঠে চাষ বাস করে জীবন যাপন করতেন। ছোটবেলায় বিরসা মুন্ডা তাদের বাড়িতে থাকা কিছু ভেড়া চরানোর জন্য জঙ্গলে যেতেন এবং সেখানে বসে বসে তিনি বাঁশি বাজাতেন বলেও জানা যায়। তিনি খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন পারদর্শী।

তাদের পরিবারে দারিদ্রতা এতটাই বেশি ছিলো যে, তার বাবা মা তাকে স্কুলে পর্যন্ত পাঠাতে পারছিলেন না। সেই সময় দারিদ্রতার জন্য বিরসা মুন্ডার বাবা-মা তাকে তার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা করার জন্য। সেখানে গিয়ে একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়। বিরসা মুন্ডার শিক্ষক পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ দেখে রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যান এবং তাকে পরামর্শ দেন খ্রিস্টান স্কুলে পড়াশোনা করার। সেই সময় খ্রিস্টান স্কুলে শুধুমাত্র ঈশাই সন্তানরা পড়াশোনা করতে পারতেন। তাই বিরসা মুন্ডা ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকে তার নাম হয় ডেভিড। সেখানে ভালো করে পড়াশোনা করে ঈশাই স্কুল থেকে বেরিয়ে নিজের আসল জীবনে পা দিলেন বিরসা মুন্ডা। কিন্তু সেখান থেকেই তার জীবন পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গেল।

 ইসাই স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পরে বিরসা মুন্ডা পরিচিত হলেন হিন্দু ধর্মের সঙ্গে। বিরসা মুন্ডার জীবনে হিন্দু ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঈসায়ী ধর্ম পরিবর্তনের বিরোধ করে তিনি আদিবাসীদের এই ধর্ম পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ব্যাপারে সচেতন করতে শুরু করলেন। কিন্তু সেই সময়ে সেই এলাকা দিয়ে রেললাইন পাতার কাজ চলছিল। সেই সময়ে রেললাইনের কাজের জন্য অন্যায় ভাবে আদিবাসীদের ব্যবহার করা শুরু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আদিবাসীদের জোরজবরদস্তি করে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ধর্ম পরিবর্তনের জন্য কার্যত বাধ্য করা হচ্ছিল আদিবাসীদের। বিরসা মুন্ডা সরকারের এই সমস্ত নীতিগুলির বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়লেন। সেই সময় থেকেই ইংরেজ বিরোধী আদিবাসী আন্দোলন এর সবথেকে জনপ্রিয় মুখ হয়ে দাঁড়ালেন বিরসা মুন্ডা।

 মানুষ তার এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হলেন। সবাই নিজের ধর্মের ব্যাপারে জানালেন এবং সার্বিকভাবে গরুর হত্যাকে বন্ধ করার দাবি উঠলো। সেই সময় বিরসা মুন্ডা নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন বিষ্ণু ভগবানের একটি রূপ হিসেবে সামনে তুলে আনলেন। তিনি নিজেই যদিও নিজেকে বিষ্ণু ভগবানের অবতার ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। মানুষও তাকে ভগবানের অবতার হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন এবং তার কথা এবং তার বাণী গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং পালন করতে শুরু করলেন। বিরসা মুন্ডার কথা বলার ক্ষমতা এত ভাল ছিল, যে তিনি মুহূর্তের মধ্যে মানুষের মন পরিবর্তন করে দিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে বিরসা মুন্ডার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। বিরসা মুন্ডার এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে ঈশাই ধর্ম পরিবর্তন বিরোধী আন্দোলন চরম সীমায় পৌঁছে গেল।

 কিন্তু বিরসা মুন্ডা তখনও পর্যন্ত ঈশাই ধর্মাবলম্বী ছিলেন। আন্দোলন চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়ায় তিনিও নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে নিজের পুরনো ধর্মে ফিরে এলেন। এরপর থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে নেমে পড়লেন বিরসা মুন্ডা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে করবিরোধী আন্দোলনে আদিবাসী শাখার একমাত্র মুখ ছিলেন বিরসা মুন্ডা। তিনি আদিবাসীদের নিয়ে নিজের একটি সেনা বাহিনী গঠন করেছিলেন, যারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছাপামার আন্দোলন ব্যাপকতা ধারণ করেছিল। ইংরেজরা এই আন্দোলনের কারণে রীতিমতো তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। গোলাবারুদ দেগে ইংরেজদের বেশ কিছু খুটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বিরসা মুন্ডা এবং তার সেনাবাহিনী।

১৮৯৮ সালে বিরসা মুন্ডা টাঙ্গা নদীর ধারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন এবং ইংরেজদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে অতিরিক্ত ইংরেজ সেনাবাহিনী এসে আদিবাসীদের পরাজিত করেছিল। বেশ কিছু আদিবাসী ইংরেজদের হাতে গ্রেফতার হলেও বিরসা মুন্ডার আন্দোলন চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ সালে ইংরেজ সেনার হাতে গ্রেফতার হয়ে যান ভারতের এই আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামী। তার কয়েক মাসের মধ্যেই ৯ জুন ১৯০০ সালে জেল এর মধ্যেই সন্দেহজনকভাবে মৃত্যু হয়েছিল বিরসা মুন্ডার। ছাপামার আন্দোলনের নেতার মৃত্যু নিয়ে এখনও প্রচুর প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে।

ইংরেজ সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, কলেরা হওয়ার কারণে কারাগারের মধ্যেই বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার করে জানা যায়নি বিরসা মুন্ডার মৃত্যু ঠিক কেন হয়েছিল। তবে মাত্র ২৫ বছর জীবিত থাকলেও তার মধ্যেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা এবং আদিবাসীদের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য বিরসা মুন্ডার অবদান অনস্বীকার্য। ইংরেজ সরকারের দ্বারা চালু করা জমিদারি প্রথা এবং রাজস্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বিরসা মুন্ডা। সাথেই জঙ্গলের জমি রক্ষার জন্ম বিরসা মুন্ডার আন্দোলন আদিবাসীদের আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিরসা মুন্ডা। সেখান থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মর্যাদা, স্বতন্ত্রতা, এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঈসায়ী ধর্ম পরিবর্তন বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েছিলেন বিরসা মুন্ডা। তিনি মারা গেলেও তিনি রেখে গিয়েছিলেন তার সেই আদিবাসী বাহিনীকে। তিনি মারা গেলেও তার আদর্শ কখনোই মারা যায়নি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আদিবাসী নেতা হিসেবে এই ভাবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিরসা মুন্ডা, ওরফে ধরতি আব্বা।

More Articles