সূর্যের ছায়া বা জলে চলা ঘড়ি থেকে স্মার্ট ওয়াচ, ঘড়ির যে ইতিহাস অজানা

ঘড়ির দুনিয়ায় আরও নানা বিবর্তন আসে। বিভিন্ন কোম্পানি নতুন নতুন কায়দার ঘড়ি এনে চমক দিতে থাকে। ঘড়ির ফ্যাশনে সর্বাধুনিক সংযোজন, স্মার্ট ওয়াচ।

"সময় যখন থমকে দাঁড়ায়, নিরাশার পাখি দু’হাত বাড়ায়।"- সময় কখনও কখনও থমকে দাঁড়ালেও ঘড়ির কাঁটায় ভর করে ফ্যাশন ট্রেন্ড কখনও থেমে থাকেনি। সেদিনের মাধ্যমিক দিতে যাওয়া ছেলেটার হাতে প্রথম এইচএমটি-র বড় ডায়ালের হাতঘড়ি পরিয়ে দিয়েছিল বাবা। হাতে প্রথম ঘড়ি পরার সে কী গৌরব! আজ তার হাতে স্মার্ট ওয়াচ। শৌখিনদের কাছে হাতঘড়ির মূল্য চিরকালই অপরিসীম। খোদ বলিউড বাদশা শাহরুখ খানও হাতঘড়ির প্রেমে মুগ্ধ হয়ে যান। হাতের শোভা বাড়াতে লক্ষ টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনার আগে দু’বার চিন্তা করেন না। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে। কীভাবে এল এই স্মার্ট ওয়াচ? এর যাত্রাপথ অনেক লম্বা। যেতে হবে অনেকটা পিছনে।

 

সময়ের জন্ম ঠিক কবে, তা হয়তো অজানা। তবে সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ যে সময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই এগিয়ে চলেছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর সময়ের হাত ধরে মানুষের এই এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হতেই যুগে যুগে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সময় দেখার যন্ত্র। প্রাচীনকালে ক'টা বাজে, তা বলার উপায় ছিল না। কারণ সেসময় ঘড়ি আবিষ্কার হয়নি। সময় দেখার বিষয়টা নির্ভর করত সূর্যের অবস্থানের ওপর।

 


সূর্যঘড়ি
ঘড়ির ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু হয় সূর্যঘড়ি বা Sundial-এর মাধ্যমে। কবে সর্বপ্রথম এই সূর্যঘড়ি আবিষ্কার হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে সবচেয়ে প্রাচীন যে সূর্যঘড়ি পাওয়া যায় ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তা মিশরে নির্মিত হয়।

 

আরও পড়ুন: পিৎজা-পুরাণ, কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই জনপ্রিয় খাবার?

 

সূর্যঘড়ির গঠন খুব সাধারণ। দিনের বিভিন্ন সময়ে কাঁটাটির ছায়া ডায়ালের বিভিন্ন স্থানে পড়ত। এই ছায়া থেকে সময় নির্ণয় করা হতো। পৃথিবীর বহু দেশে এই সূর্যঘড়ির প্রচলন ছিল। ছোট থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির হতো এই সূর্য ঘড়ি। আবার কিছু বিশাল আকৃতির সূর্যঘড়ি বানানো হতো রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে, যাতে মানুষ সহজে সময় জানতে পারে। যেমন, প্যারিসের ‘লুক্সর অবেলিস্ক’ নামের বিশাল আকৃতির সূচালো চারকোণা স্তম্ভটি একটি সূর্যঘড়ি।

 

কিন্তু এই ঘড়ির কিছু সমস্যা থাকার কারণে মানুষ নতুন ঘড়ি আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে। সূর্যঘড়ির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল- এই ঘড়ি রাতের বেলা ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া মেঘলা দিনেও এই ঘড়ি অচল হয়ে পড়ত।

 

জলঘড়ি
প্রাচীনকালে সূর্যঘড়ির পাশাপাশি প্রচলন ছিল জলঘড়ির। ধারণা করা হয়, প্রায় ৫০০০ বছর আগে চিন দেশে জলঘড়ি বা Clepsydra-র প্রচলন ছিল। অনেকে আবার মনে করেন, মিশরে এই ঘড়ির প্রথম প্রচলন হয়। জলঘড়ির গঠনও ছিল সরল আকৃতির। বহু দেশে এই জলঘড়ি জনপ্রিয়তা পায়। এটিতে সূর্যঘড়ির মতো অসুবিধা ছিল না, ফলে এটি দিনে-রাতে ব্যবহার করা যেত ও যে-কোনও স্থানে বহন করা যেত।

 

জলঘড়ির কিছু অসুবিধাও ছিল। এই ঘড়ি জাহাজে ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া শীতপ্রধান দেশগুলোতে এই ঘড়ি ছিল অচল। কারণ এই ঘড়ির জল জমে বরফে পরিণত হলেই ঘড়ি বন্ধ হয়ে যেত। ফলে মানুষ এই জলঘড়ির বিকল্প খোঁজা শুরু করে।


বালিঘড়ি
বালিঘড়ি বা Hourglass আরেকটি প্রাচীন ঘড়ি। এই ঘড়ি কবে ও কোথায় আবিষ্কার হয়েছিল, তা অজানা। তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় আট শতকে এক সন্ন্যাসী এই ঘড়ি আবিষ্কার করেন। মধ্যযুগে ইউরোপে এই ঘড়ি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হত। বহু বিখ্যাত চিত্রকর্মেও এই ঘড়ির প্রতিকৃতি রয়েছে। এছাড়াও সপ্তদশ শতকে বহু গির্জায় ধর্মোপদেশ দেওয়ার সময় ঠিক করার জন্য এই ঘড়ি ব্যবহৃত হত।


এরপর আগুনঘড়ির হাত ধরে এল ক্লক। তবে তার ইতিহাসও প্রাচীন।


ক্লক
পুরোপুরি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি প্রথম ঘড়ি হচ্ছে ক্লক (Clock)। কেউ কেউ মনে করেন, গ্রিক পদার্থবিদ আর্কিমিডিস ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম ক্লক আবিষ্কার করেন। তিনি চাকাযুক্ত ঘড়ি তৈরি করেন। সর্বপ্রথম গির্জাগুলোতে এই ধরনের ঘড়ির প্রচলন হয়।


১২৮৮ সালে ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে এবং ১২৯২ সালে ক্যান্টাবেরি ক্যাথিড্রালে এই ধরনের ঘড়ি বসানো হয়। মধ্যযুগে ক্লকের প্রচলন অনেক বেড়ে যায়। তবে এদের কোনওটাই সঠিক সময় দিত না। ১৩৬৪ সালে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চম চার্লস একটি ঘড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৫ বছর পর এই ঘড়ি নির্মাণ শেষ হয়। বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা হেনরি দ্য ডিক এটি নির্মাণ করেন। এটাই সেযুগের সবচেয়ে আধুনিক ঘড়ি।

 

ষোড়শ শতকে ইউরোপে নবযুগের সূচনা হয়। এসময় ঘড়ি অনেক উন্নত হয়। এরপর বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও প্রথম দোলকের ধর্ম সম্পর্কিত সূত্র আবিষ্কার করেন। যা পরবর্তীতে ঘড়িতে ব্যবহৃত হয়।

 

ঘড়ির পেন্ডুলাম মূলত ঘড়ির প্রতি সেকেন্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে হাতঘড়ি এবং টেবিল ঘড়িতে সাধারণত ব্যালান্স হুইল ঘড়ির প্রত্যেক সেকেন্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় সব মেকানিক্যাল ঘড়ির বাকি অংশ প্রায় একইরকম থাকে।


ওয়াচ
ঘড়িতে ঝুলন্ত ভারী বস্তু ব্যবহারের চলন উঠে যাওয়ার পর পকেটে বহনযোগ্য ছোট ঘড়ি তৈরি হয়। এগুলোই ‘ওয়াচ’ নামে পরিচিত। এটাই আমাদের বর্তমান যুগের ঘড়িগুলোর আদিরূপ। এই ধরনের ঘড়িগুলো গোলাকার ডিম আকৃতির ছিল। এজন্য এগুলোকে বলা হতো ‘নুরেমবার্গের ডিম’।


এরপর ঘড়ির দুনিয়ায় আরও নানা বিবর্তন আসে। বিভিন্ন কোম্পানি নতুন নতুন কায়দার ঘড়ি এনে চমক দিতে থাকে। ঘড়ির ফ্যাশনে সর্বাধুনিক সংযোজন, স্মার্ট ওয়াচ।

 

আগেকার সাধারণ ডিজিটাল হাতঘড়িতে ক্যালেন্ডার, ক্যালকুলেটর প্রভৃতি থাকলেও সর্বপ্রথম স্মার্ট ওয়াচ চালু হয় ২০১০ সালে। এই স্মার্ট ওয়াচগুলোতে নানা ধরনের সুবিধা যোগ করা হয়েছে। বিখ্যাত অ্যাপল কোম্পানি নিয়ে আসে তাদের স্মার্ট ওয়াচ। অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম-যুক্ত স্মার্ট ওয়াচেরও আবির্ভাব ঘটে এর সঙ্গে সঙ্গে। শীর্ষ অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং তৈরি করা শুরু করে অ্যানড্রয়েড চালিত স্মার্ট ওয়াচ ‘স্যামসাং গিয়ার’। অডিও-ভিডিও প্লেয়ার, ক্যামেরা, এফএম রেডিও, ব্লু টুথ, জিপিএস, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই সব ধরনের প্রযুক্তিই যুক্ত করা হয়েছে আধুনিক স্মার্ট ওয়াচগুলোতে। একটি স্মার্টফোন দিয়ে যা যা করা যায়, তার প্রায় সবই এখন করা যাচ্ছে স্মার্ট ওয়াচ দিয়ে।


ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে লিখে দিল আজকের ফ্যাশন।

More Articles