নাগ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব মেলে এখানে, আজও নিয়মিত পুজো হয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এই হিন্দু মন্দিরে
Oldest Hindu Temple : সারা বছরই ভক্ত এবং পর্যটকদের কম বেশি ভিড় থাকলেও রামনবমী ও শিবরাত্রির দিন বিশেষ করে ভক্তের ঢল নামে এই মন্দিরে, কোন দেবতার পুজো হয় এখানে?
বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন মন্দিরের প্রসঙ্গ। কোনও মন্দির বলতে কেবল যে ধর্ম সংক্রান্ত বৃত্তান্ত বোঝায় তাই নয়, পাশাপাশি সেই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক প্রাচীনত্বের খোঁজ। স্থাপত্য শৈলীর থেকে শুরু করে সূচনা পর্বের ইতিহাস, সব কিছু নিয়েই আলোচিত হয়ে ওঠে মন্দির। এই মন্দির শব্দটি মূলত হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গেই আসে। হিন্দুদের আরাধ্য দেব দেবীর বাসস্থান বোঝায় একে। গোটা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র মন্দির। কিন্তু জানেন কি আমাদের এই দেশেই রয়েছে এমন একটি মন্দির, যা শুধু ভারত তো বটেই এমনকী গোটা বিশ্বের মধ্যেই প্রাচীনতম।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো হিন্দু মন্দির আছে ভারতে, তাও আবার বাংলার একেবারে পাশেই। প্রাচীনত্বের ভারে অবশ্য বাইরের অবয়বে খানিক ভাঙন ধরেছে, তবে তাতে ইতিহাসের কিছুই যায় আসে না। ইতিহাস রক্ষিত হয় নিজের ছন্দেই। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ১০৮ বছরের মধ্যেই নির্মাণ হয়েছিল এই মন্দির। হিন্দু পুরাণ ঘাঁটলে যতো মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার নিরিখে সবচেয়ে প্রাচীন এটিই, অন্তত স্থাপত্যকাল হিসেবে তাই বলা যায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হল আজ এত এত বছর পরেও এই মন্দিরে নিত্যদিন পুজো করা হয় আরাধ্য দেবতাকে। ফলে সক্রিয় মন্দির বলতে বিশ্বের এখনও অবধি যে পুরনো মন্দিরে পুজো অর্চনা হয় সেটি হল এটিই। সবচেয়ে পুরনো এই হিন্দু মন্দিরটির নাম হল মুণ্ডেশ্বরী মন্দির। বিহারের শোন নদীর ধারে কাইমুর মালভূমির মুণ্ডেশ্বরী পাহাড়ের ওপর রামগড় গ্রাম, সেখানেই অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দির।
আরও পড়ুন - মুখ চিনে নেবে যন্ত্র! নয়া প্রযুক্তির ব্যবহার তিরুপতি মন্দিরে, কেন এমন ব্যবস্থা নিল কর্তৃপক্ষ?
জানা যায়, ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখায় এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই লেখা থেকে সহজেই আঁচ করা যায় এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব। ১৯১৫ সাল থেকে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক সংরক্ষিত একটি ঐতিহাসিক মন্দির। এএসআই কর্তৃক সম্প্রতি এই মন্দির ভবনটির প্রতিষ্ঠার তারিখ হিসেবে ১০৮ খ্রিস্টাব্দকে নির্ধারিত করার ফলে এটি এখন পৃথিবীর প্রাচীনতম সক্রিয় হিন্দু মন্দির। মন্দির এলাকায় অবস্থিত একটি তথ্য ফলক নির্দেশ করে যে, এই মন্দিরের অস্তিত্বের শুরু অন্তত ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এবং ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের হিন্দু ফলক পাওয়া গিয়েছে এই মন্দিরে।
শিব এবং মহাশক্তিকে উৎসর্গ করে ভারতের প্রাচীনতম সক্রিয় এই হিন্দু মন্দিরটি। সারা বছরই ভক্ত এবং পর্যটকদের কম বেশি ভিড় থাকলেও রামনবমী ও শিবরাত্রির দিন বিশেষ করে ভক্তের ঢল নামে এই মন্দিরে। প্রাচীন এই মন্দিরে নবরাত্রির সময় একটি বিশেষ মেলা বসে। যাকে কেন্দ্র করেও প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে এখানে।
২০০৩ সাল নাগাদ এই মন্দির সংলগ্ন এলাকা থেকে পাওয়া যায় শ্রীলংকার রাজা দুটুগমুনুর একটু প্রাচীন সীলমোহর, এই আবিষ্কার রাতারাতি বদলে দেন প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস। নতুন একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যে ১০১ থেকে ৭৭ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের মধ্যে শ্রীলংকা থেকে আগত রাজকীয় তীর্থযাত্রীর দল বুদ্ধ গয়া থেকে বিখ্যাত দক্ষিণপথ মহাসড়ক হয়ে সারনাথে ভ্রমণকালে মন্দিরের স্থলে তাদের এই সীলমোহরটি হারিয়েছিল। আর এই তত্ত্বই বাড়িয়ে দেয় মন্দিরের প্রাচীনত্ব।
আরও পড়ুন - সময় পেরলেও মরচে পড়েনি এতটুকুও, ভারতের এই মন্দিরে আজও রয়েছে পরশুরামের কুঠার
এছাড়া এই মন্দিরে মেলে চারমুখী শিবলিঙ্গের মাথায় নাগের অস্তিত্ব, গণেশের উপর নাগ জনু বিশিষ্ট মূর্তি এবং পাহাড়ের আশেপাশের ভাঙ্গা অংশ সবই নির্দেশ করে যে এই মন্দিরটি নাগ সাম্রাজ্য কর্তৃক নির্মিত যারা নাগকে নিজেকে রাজকীয় চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতো। এই নাগ সাম্রাজ্যের সময়কাল ১১০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৩১৫ খ্রিস্টাব্দ, ফলে এর মধ্যেই মন্দিরের নির্মাণ তা স্পষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিহার রাজ্য ধর্মীয় ট্রাস্ট বোর্ড ২০০৮ সালে পাটনায় গবেষকদের নিয়ে এক জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে যেখানে মুন্ডেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণকাল ১০৮ সাল নির্ধারণ করে এটিকে রাষ্ট্রের প্রাচীনতম মন্দির ঘোষণা করা হয়।
গঠনশৈলীর দিক থেকে যথেষ্ট নজর কাড়ে এই প্রাচীন মন্দিরটি। কংক্রিট, কাঠ কিংবা মাটি নয়, গোটা মন্দিরটিই নির্মাণ করা হয়েছিল পাথর দিয়ে। অষ্টভুজ আকারের মন্দিরের গঠনশৈলী বড় একটা দেখা যায়না বিশ্বে। অর্থাৎ সেই দিক থেকেও বিরল নিদর্শন বলা চলে প্রাচীন এই মন্দিরটিকে। এই অষ্টভুজ আকৃতির গঠনকে বলা হয় নাগারা শৈলী। যা অতি প্রাচীন গঠনশৈলী হিসাবেই পরিচিত। বিহারের পাটনা থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মুণ্ডেশ্বরী মন্দির। কলকাতা থেকে দূরত্ব খুব বেশি নয়। এখানে গেলেই যেন শুরু হয়ে যায় টাইম ট্রাভেল। প্রাচীনত্ব এসে জানান দেয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সক্রিয় হিন্দু মন্দির হল এটিই।

Whatsapp
