বিদেশি ঘড়ির পিছনে আঁকা হয় ছবি! গুপ্তহত্যার ছক থেকে ত্রিপুরাকে বাঁচিয়েছিলেন যে মহারানি
Kanchan Prava Devi Tripura: ঘড়িটি আজও রাখা রয়েছে য়েগার ডি'কলটা-র মিউজিয়ামে, এবং তার নিচে লেখা রয়েছে ‘The Indian Beauty’।
১৯২০-র দশক। এক সুন্দর রৌদ্রজ্জ্বল সকালে পোলো খেলা চলছে ক্যালকাটা পোলো ক্লাবে। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন এক ব্যক্তি যার নাম সিজার দে'ট্রে। সুইস ঘড়ির খুব বড় ভক্ত তিনি। নেট চলাকালীনই এক ব্রিটিশ অফিসার সিজারকে বললেন, “ঘড়ি পরে খেলতে গিয়ে পোলোর বল লেগে ঘড়ি ভেঙে যায়। এমন কোনও ঘড়ি আছে যা ভাঙবে না?” এই প্রশ্নের উত্তর তখন সিজারের কাছে ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এত শক্ত কাঁচ বানানো সম্ভবও নয়। তবে এই সমস্যার কথা শুনে তাঁর মাথায় খেলে যায় একটি নকশার কথা। দেশে ফিরে তিনি য়েগার ডি'কলটা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং একটি বিশেষ ঘড়ি বানান। এই ঘড়িটির ডায়াল ঘোরানো যেত। খেলার সময় ঘড়িটির ডায়াল ঘুরিয়ে পিছনের দিকে করে দিলে আর কাঁচ ভাঙার সম্ভাবনা নেই। এই বিশেষ ধরনের ঘড়িটির নাম রিভারসো। বাজারে আসতেই বিপুল জনপ্রিয় হয় ঘড়িটি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষরা এই ঘড়ির ডায়ালের পিছনে আবার বিশেষ ছবি আঁকিয়ে উপহার দিতেন। চলে আসা যাক ২০০৪ সালে। য়েগার ডি'কলটা কোম্পানি নিজেদের ঘড়ির মিউজিয়ামের জন্য পুরনো ঘড়ি সংগ্রহ করছিল। এই সময় তাদের হাতে আসে একটি ১৯৩২ মডেলের রিভারসো। এই ঘড়িটির ডায়ালের পিছনে আঁকা ছিল এক সুন্দরী ভারতীয় রাজকুমারীর পোর্ট্রেট। এই রাজকুমারী কে, তা জানতে আনানো হয় যাবতীয় পুরনো অ্যালবাম। জানা যায় তিনি হলেন, ত্রিপুরার মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী। কঠিন সময়ে শক্ত হাতে রাজ্যের রাশ ধরে কীভাবে একটি গোটা রাজ্যকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি, সেই গল্পই আজকে জানা যাক।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীন হলো। সেই সময় দেশে সাড়ে পাঁচশোর বেশি রাজবংশ ছিল। তাদের একত্রিত করেছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। এরকমই একটি রাজবংশ ছিল ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশ। সেই সময় ত্রিপুরার রাজ সিংহাসনে বসে রয়েছেন মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর দেব বর্মণ (তিনি ছিলেন শিল্পী শচীন দেব বর্মণের কাকা)। আগে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল উদয়পুর। আঠেরো এবং উনিশ শতকে, ওল্ড আগরতলা এবং আগরতলা নামে দু'টি শহর নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে টিপেরা জেলা, ওল্ড আগরতলা, আগরতলা নিয়ে ত্রিপুরার এখনকার রাজধানী আগরতলা শহর তৈরি হয়। ত্রিপুরার রাজা নোয়াখালি এবং সিলেট থেকেও খাজনা আদায় করতেন। স্বাধীনতার সময়, ভারত-পাকিস্তানের বাটোয়ারা করার জন্য যখন র্যাডক্লিফ লাইন টানা হয় তখন টিপেরা, চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা, নোয়াখালি, সিলেটের মতো হিন্দুআধিক্য অঞ্চলগুলি পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানকার বাসিন্দারা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন এবং দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেখান থেকে প্রাণে বাঁচতে অনেক মানুষ পালিয়ে ত্রিপুরায় চলে আসেন।
আরও পড়ুন- ধর্মে মুসলমান, কণ্ঠে শিবের গীত, রাজস্থানের আশ্চর্য জাতি মাঙ্গানিয়ার

The Indian Beauty
১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসেই কিশোর দেব বর্মন বুঝতে পেরেছিলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মহারাজ সরকারিভাবে ঘোষণা করলেন ত্রিপুরা ভারতের অংশ হবে। সেইমতো ত্রিপুরা বিধানসভার সচিবকে একটি চিঠিও পাঠানো হয়। তবে এই ঘোষণার তিন সপ্তাহের মাথায়, ১৭ মে প্রয়াত হন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর দেব বর্মণ। যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য দেব বর্মণ তখন শিশু। তাই রিজেন্সি কাউন্সিল গঠন করা হয় এবং শাসনভার গ্রহণ করেন মহারানি। কাঞ্চনপ্রভা দেবী ছিলেন পান্নার মহারাজের বড় কন্যা। ১৯১৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে, ২২ বছর বয়সী তরুণ রাজার প্রেমে পড়েন এবং তাদের বিবাহ হয়। মহারাজের অকাল মৃত্যুর পর গোটা রাজ্যের দায়ভার এসে পড়ে মহারানির উপর। একদিকে ক্রমাগত পাকিস্তানের চাপ, অন্যদিকে রাজ পরিবারের ভেতরেই অন্তর্ঘাত- পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে থাকে। মহারাজের সৎ ভাই দুর্জয় কিশোর সিংহাসন দখলের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তিনি সেখানকার স্থানীয় মুসলিম নেতা আব্দুল পারেখের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেন। আব্দুল পারেখ ছিলেন আঞ্জুমান-এ-ইসলামিয়া নামক একটি মুসলিম সংগঠনের সভাপতি। মুসলিম লিগের সমর্থনে তাঁরা সারা ত্রিপুরা জুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের দাবি, ত্রিপুরাকে পাকিস্তানের অংশ করতে হবে। ত্রিপুরা পাকিস্তানের অংশ হলে দুর্জয় কিশোর হতেন ত্রিপুরার নতুন মহারাজ। তাদের এই ষড়যন্ত্র রুখতে উদ্যত হলেন স্বয়ং মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী।

বীরবিক্রম কিশোর দেব বর্মন এবং কাঞ্চনপ্রভা দেবী
১১ জুন, ত্রিপুরা কাউন্সিল বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয় ত্রিপুরা ভারতেরই অংশ হচ্ছে। মহারাজ জীবিত অবস্থায় সেটাই চেয়েছিলেন। এছাড়াও কাউন্সিল সংবিধান সভায় ত্রিপুরার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে মহারানিকে। দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করতে আব্দুল পারেখ এবং দুর্জয় কিশোর সারা ত্রিপুরা জুড়ে ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন। এই খবর মহারানির কানে যেতেই তিনি বেশ কয়েকটি কঠিন পদক্ষেপ করেন। তাঁর মন্ত্রী সভা থেকে দুর্জয় কিশোরের অনুগামীদের ইস্তফা দেওয়ান তিনি। প্রথমে কিছু না করলেও, দুর্জয় কিশোর অচিরেই শুরু করে দেন গুপ্ত হত্যা। রানির অনুগত বেশ কয়েকজন সভাসদকে গুপ্ত হত্যা করা হয়। এই পরিস্থিতির কথা জানিয়ে রানি একটি চিঠি লেখেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে। চিঠি পাওয়া মাত্র অসমের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্যাটেল। ১৯৪৭-এর অক্টোবরে মহারানি, যুবরাজ এবং রাজ পরিবারের কয়েকজন বিশ্বস্ত সদস্যকে শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে, দাঙ্গা রুখতে ভারতের বায়ুসেনা পাঠিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপুরায়। দাঙ্গা থেমে যায়। এরপর ভারত সরকারের পরামর্শে ১২ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে, রিজেন্সি কাউন্সিল ভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এর দেড় বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর, সরকারিভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় ত্রিপুরা। এই সময় সর্দার প্যাটেল নিশ্চিত করেছিলেন যাতে কাশ্মীরের মতো কোনও ঝামেলা ত্রিপুরায় তৈরি না হয়। ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয় ত্রিপুরা, ১৯৭২ সালে পূর্ণ রাজ্য রূপে আত্মপ্রকাশ করে ত্রিপুরা।

মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী
২০০৪ সালে প্রাপ্ত ওই রিভারসো ঘড়িটি বর্তমানে রাখা রয়েছে সুইৎজারল্যান্ডের ভ্যালি ডি'সিউ-তে। এখানেই আজ থেকে প্রায় দু'শো বছর আগে প্রথম হাতঘড়ির কারখানা শুরু হয়েছিল। ওই ঘড়ির ডায়ালের পেছনে যে ছবিটি ছিল, তার সঙ্গে মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবীরই সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে কাঞ্চনপ্রভা দেবীর নাতিও জানান, ওই ঘড়ির পিছনের ছবিটি তার ঠাকুমারই। য়েগার ডি'কলটা-ও তা মেনে নেয়।
আরও পড়ুন- গুয়াহাটির জঙ্গলে ভূতের নাচ! সরাইঘাটের যুদ্ধে যেভাবে মুঘলদের হারিয়েছিল অহমরা

ঘড়ির সেই ছবি এবং জুবেদা বেগম
তবে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ফের বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুম্বইয়ের বাসিন্দা নিখিল ধনরাজ দাবি করেন, ছবিটি আসলে তার দিদা জুবেদা বেগমের। ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ছিল ‘আলম-আরা’। এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জুবেদা বেগম। সুরাতের এক রাজ পরিবারের কন্যা জুবেদা নিজের জীবনে ৬০-এর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নিখিল জানান, ঘড়িটি জুবেদা বিয়েতে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। এই দুই দাবিদার উঠে আসায়, কোম্পানি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে দু'জনের ছবির সঙ্গে ঘড়ির ছবিটির তুলনা করে। কিন্তু তাতেও বোঝা যায় না ছবিটি আসলে কার। ঘড়িটি আজও রাখা রয়েছে য়েগার ডি'কলটা-র মিউজিয়ামে, এবং তার নিচে লেখা রয়েছে ‘The Indian Beauty’।