সুনীলের জন্য পড়ে আছে অনন্ত মাঠ
Sunil Chhetri: ম্যাচের শেষ মুহূর্তে যখন সুনীল মাঠ ছাড়ার জন্য এগিয়ে আসেন, স্টেডিয়াম কাঁপছিল করতালিতে।
ভারতীয় ফুটবলের আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র সুনীল ছেত্রী তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষ ম্যাচটা খেললেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে, কুয়েতের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচ নিছকই খেলা নয়, এ এক যুগের সমাপ্তি এবং নতুন প্রজন্মের উত্থানের সূচনা। স্টেডিয়ামে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় মাঠ কাঁপছিল সুনীলের ভক্তদের উদ্দাম উল্লাসে। ম্যাচ ঠিকই, তবে ফলাফল যেন গৌণ! এ তো সুনীলের দিন, এমন একজন মানুষের দিন, যিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে ভারতীয় ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
সুনীল ছেত্রী। ৮৪টি আন্তর্জাতিক গোল, ১৯ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ার, অগণিত রেকর্ড — অর্জনের তালিকা অনন্ত। তবে তার চেয়েও বড় ছিল দলের প্রতি ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণার শক্তি। সুনীল একজন আইকন, সুনীল একজন টিম ম্যান। নিজের সেরাটা দিয়ে দেশকে প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন সুনীল। একটা সময় ছিল যখন ভারতের ফুটবলের কোথাও কোনও কদর ছিল না বললেই চলে। সেখান থেকে ভারতীয় ফুটবলকে বিশ্বের মানচিত্রে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে এসেছেন সুনীল। ভারতের ফুটবলের উত্থানে যদি কোনও খেলোয়াড়ের অবদান সবথেকে বেশি থাকে, তিনি সুনীল ছেত্রী।
কুয়েতের বিরুদ্ধে ভারত গোলশূন্য ড্র করলেও, এই ম্যাচে সুনীলের খেলা ছিল দেখার মতো। অন্যান্য যে কোনও ভারতীয় স্ট্রাইকারের থেকে ভালো গোল করার দক্ষতা রয়েছে সুনীল ছেত্রীর পায়ে। সুযোগ সন্ধানী সুনীল তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল কেরিয়ারে বহু অভাবনীয় এবং অবিশ্বাস্য গোল করেছেন। ৩৯ বছরের সুনীল বিশ্বের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় বর্তমানে লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ঠিক পরেই। ভারতের অন্য কোনও ফুটবলারেরই এই রেকর্ড নেই।
আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল
২০১১ সালটা ছিল সুনীল ছেত্রীর জীবনের সবথেকে ভালো সময়। এই বছরই নিজেকে ভারতীয় দলের সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন সুনীল। গোল সংখ্যার দিক থেকেও এটাই ছিল সুনীল ছেত্রীর সবথেকে ভালো বছর। এই বছরে মোট ১৩ টি গোল করেছিলেন তিনি ভারতের হয়ে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে একার দক্ষতায় দলকে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। এক টুর্নামেন্টে সাতটি গোল করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। এই একই বছর এএফসি এশিয়া কাপেও দক্ষিণ কোরিয়া এবং বাহারিনের বিরুদ্ধে গোল করে ভারতকে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন সুনীল ছেত্রী।
ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে ২০১৮ সালে নিজের সেরা পারফরমেন্স দিয়েছিলেন সুনীল ছেত্রী। এই একই বছরে তিনি একাধিক মাইলফলক অর্জন করেছিলেন। একের পর এক নজির গড়ে, তখন তিনি হয়ে উঠছিলেন ভারতীয় ফুটবলের সব থেকে ভরসাযোগ্য খেলোয়াড়। সারা দুনিয়ার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতাদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সুনীল। সেই বছর ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপে সুনীল ছেত্রীর হ্যাটট্রিকের ফলে চিনের তাইপেকে হারায় ভারত। সেই টুর্নামেন্টের প্রতি ম্যাচেই গোল করেছিলেন সুনীল ছেত্রী। ফাইনাল ম্যাচে তাইপেকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট জিতে নেয় ভারত। আর টুর্নামেন্টের সেরা হন সুনীল ছেত্রী।
এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুনীলকে। ২০১৮-তে যে ফর্ম নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, সেই একই ফর্ম তিনি চালিয়ে গিয়েছেন কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। ২০১৯ সালে আগের বছরের থেকেও বেশি টুর্নামেন্ট খেলেন সুনীল ছেত্রী। একের পর এক ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ গোল করে তিনি ভারতীয় দলের সবথেকে নির্ভরযোগ্য ফুটবলার হয়ে ওঠেন। ২০১৯ সালে এএফসি এশিয়ান কাপে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর দু'টি গোলের ফলেই ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতে নিয়েছিল ভারত। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপেও তাজাকিস্তানের বিরুদ্ধে দু'টি গোল করেছিলেন সুনীল ছেত্রী।
২০২১ সালে ধারাবাহিকভাবে স্ট্রাইকার এবং অধিনায়ক হিসেবে একের পর এক গোল করেছিলেন সুনীল। সেই সময় সুনীল একেবারে পরিণত ফুটবলার। ১৬ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি সেই সময় ভারতীয় ফুটবলের সত্যিকারের ক্যাপ্টেন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সুনীলের নেতৃত্বে সেবছর দুর্দান্ত পারফর্ম করে ভারত। পুরো চ্যাম্পিয়নশিপে তিনিই হন ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টে পাঁচটি গোল করেছিলেন তিনি এবং সবক'টিই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মলদ্বীপের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করে ভারতকে জিতিয়েছিলেন সুনীল। এছাড়া বাংলাদেশ এবং নেপালের বিরুদ্ধেও গোল করেন সুনীল ছেত্রী। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেছিলেন সুনীল এবং জিতিয়েছিলেন ভারতকে।
আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ
২০২৩ সালে যখন তিনি মাঠে নামছেন, সেই থেকেই অবসর নিয়ে জল্পনা চরমে ওঠে। তখন সুনীলের বয়স ৩৮। এত বেশি বয়স পর্যন্ত সাধারণত কোনও ফুটবলারকেই খেলতে দেখা যায় না। আর কতদিন তিনি মাঠে থাকবেন, কতদিন পর্যন্ত তাঁকে ভারতের জার্সিতে দেখা যাবে, তাঁর গোলের সেঞ্চুরি হবে কিনা, তাঁর উত্তরসূরি কারা হতে পারেন, এসব প্রশ্ন উঠতে থাকে তখনই। কিন্তু বয়স যে শুধু সংখ্যা মাত্র, তা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন সুনীল ছেত্রী। ইচ্ছেশক্তি এবং ফিটনেস দিয়ে নিজের দলকে বারবার জিতিয়েছেন সুনীল। ২০২৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জীবন-মরণ ম্যাচে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে ভারতকে কাঙ্খিত জয় এনে দিয়েছিলেন সুনীল। এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই গোল করে আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি। এছাড়াও নেপাল এবং কুয়েতের বিরুদ্ধে এই চ্যাম্পিয়নশিপে দুরন্ত কিছু গোল করেন সুনীল। কিরগিজস্তান এবং মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচেও গোল আসে সুনীলের পা থেকে। এছাড়াও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দু'টি গোল করেছিলেন সুনীল। তবে সেবছর ওই টুর্নামেন্টে ভালো ফল করতে পারেনি ভারত।
কুয়েতের ম্যাচ ছিল এই সমস্ত সফরের শেষ। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে যখন সুনীল মাঠ ছাড়ার জন্য এগিয়ে আসেন, স্টেডিয়াম কাঁপছিল করতালিতে। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে সতীর্থদের জড়িয়ে ধরেন সুনীল। সুনীল ভারতীয় ফুটবলের আশার প্রতীক, অনুপ্রেরণার মূর্তি। কত যুদ্ধ জিতেছেন, কত অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন! লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নকে জল-হাওয়া দিয়েছেন অক্লান্ত পরিশ্রম করে। সুনীল মাঠ ছাড়ালেন, তবে স্থান শূন্য থাকবে না। নতুন প্রজন্মের তারকা ফুটবলাররা এগিয়ে আসছেন তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। সুনীল ছেত্রী তাঁদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, লড়াই শিখিয়েছেন, বিশ্বাস জাগিয়েছেন। সুনীলের জন্য অনন্ত মাঠ পড়ে আছে, অনন্ত পথ। তিনি হেঁটে যাচ্ছেন আলোর দিকে।