হারাচ্ছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য! ভারতের শেষ গোলাপ জল নির্মাতার কাছে কেন কৃতজ্ঞ থাকবে দেশ?

Rose Water: গোলাপের পাপড়ি এবং অন্যান্য ভেষজ একটি তামার কড়াইতে সেদ্ধ করা হয় এবং সেই সেদ্ধ হওয়া জলের বাষ্প ঘনীভূত হলে তা পাতনের মাধ্যমে জমা করা হয়।

গোলাপ জল। প্রাণের শান্তি, ত্বকের আরাম। হালকা অথচ দীর্ঘস্থায়ী গন্ধের প্রেমে পড়ে আছেন ভারতীয়রা, সেই কবে থেকেই। প্রেমের ফুলের গন্ধ ভরা জলও কি প্রেমের উদ্রেক করে না সময়ে অসময়ে? করেই তো, করে বলেই না উচাটন মন নিমেষে থিতু হয়ে যায় গোলাপ জলের স্পর্শে! শুধু স্পর্শই বা কই, রান্নাতে গোলাপ জল, বিয়ের অনুষ্ঠানে গোলাপ জল, ধর্মীয় ভক্তিতে মিশে আছে গোলাপ জল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গন্ধ মানুষকে বেঁধে রেখেছে অদৃশ্য সুতোয়। কিন্তু এর ব্যবহার ব্যাপকহারে হলেও খুব কম লোকই প্রাকৃতিক গোলাপ জল তৈরি করেন। বাকি সবেতেই হ্যান ত্যান রাসয়নিকের ভিড়। পরিশ্রুত, প্রাকৃতিক গোলাপ জল কিনতে হলে যেতে হবে কাশ্মীরে। কাশ্মীরের শেষ বেঁচে থাকা গোলাপ জল প্রস্তুতকারক মানুষটির গল্প শুনতে হবে। চাহিদা মেটাতে যান্ত্রিক কৌশলকে কোনও দিনই ব্যবহার করেননি তিনি।

শ্রীনগরের আব্দুল আজিজ কোজগার আজও প্রাকৃতিক গোলাপ জল তৈরি করে চলেছেন তাঁর ১০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন দোকান ‘আর্ক-ই-গুলাব’-এ। শ্রীনগরের খানকাহ-ই-মৌলা মসজিদের কাছে অবস্থিত এই দোকানটি। গোলাপের গন্ধে এলাকা ভরে থাকে সারাক্ষণ। লেবেলবিহীন প্লাস্টিকের পাত্রে প্রতিদিন কয়েক লিটার গোলাপ জল বিক্রি করেন আজিজ। আব্দুল আজিজ কোজগার গোলাপ জল বানানো শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। আজও কোনওমতে এই ঐতিহ্য ত্যাগ করতে চান না তিনি।

আরও পড়ুন- কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?

প্রায় ৪০০ বছর আগে তুরস্কে তাঁদের পূর্বপুরুষদের বাস ছিল। সেখানেই গোলাপ জল তৈরির শুরুটা হয়। পরে তাঁর পরিবার হাতে কলমে গোলাপ জল তৈরির প্রক্রিয়াটি ভারতবর্ষে নিয়ে আসে। কিন্তু এখন তিনিই এই প্রাচীন পদ্ধতির একমাত্র রক্ষক, তিনিই শেষ নির্মাতা। পরবর্তী প্রজন্মের এই শ্রমসাধ্য পদ্ধতিতে গোলাপ জল তৈরিতে কোনও আগ্রহ নেই। কমছে গ্রাহক, কমছে লাভও!

প্রাচীন পদ্ধতিতে গোলাপের পাপড়ি থেকে গোলাপ জল তৈরি করা হয় এই দোকানে। কাঠ-ইটের দোকানের ভেতরে দেওয়ালে সাঁটানো সুফি সাধকদের ছবি। আর্ক-ই-গুলাব ছাড়াও তাঁর দোকানে তাকজুড়ে গাঢ় রঙের কাঁচের বোতল এবং বিভিন্ন আকারের প্রাচীন জার রয়েছে। সেগুলিতে হাতে লেখা উর্দু এবং ফার্সি লেবেল চেটানো রয়েছে। প্রাচীন সব শিশি বোতলে সাজানো কত রকমের সিরাপ ও সুগন্ধি। পেটের রোগ সহ বিভিন্ন ধরণের রোগের প্রতিকার হিসাবে কাজ করে এই সিরাপগুলি।

গোলাপ জল কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ থেকে পাওয়া কোশুর গুলাব দিয়ে তৈরি হয়। কোনও মেশিনপত্র না সম্পূর্ণ পদ্ধতিটাই হাতে করেন আজিজ কোজগার৷ গোলাপের পাপড়ি এবং অন্যান্য ভেষজ একটি তামার কড়াইতে সেদ্ধ করা হয় এবং সেই সেদ্ধ হওয়া জলের বাষ্প ঘনীভূত হলে তা পাতনের মাধ্যমে জমা করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে প্রক্রিয়টি অত্যন্ত ধীর, প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এত কঠিন পদ্ধতিতে তৈরি গোলাপ জলের দাম কিন্তু বেশি নয়। ২০০ মিলি-র বোতলের দাম মাত্র ৪০ টাকা।

আরও পড়ুন- ভূস্বর্গের ভয়াবহতাকে লেন্সে ধ‍রেছেন বারবার, চেনেন এই কাশ্মীরি নারীকে?

প্রাকৃতিক গোলাপ জল অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের কোশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। গোলাপ জল গলা ব্যথা প্রশমিত করতেও ব্যবহৃত হয়। গোলাপ জল সাধারণত অ্যারোমাথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়, যা মাথাব্যথার উপশম করে। বলিরেখা কমায়, হজমেও সহায়তা করে। এত গুণ সত্ত্বেও খাঁটি গোলাপ জল তৈরিতে আগ্রহ নেই নয়া প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের।

অস্ট্রিয়ান পণ্ডিত এবং কূটনীতিক ব্যারন চার্লস ফন হুগেল একজন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদও ছিলেন। ১৮ শতকে কাশ্মীর সফরে এসে তিনি বলেছিলেন কাশ্মীরের ফুল, বিশেষ করে গোলাপ বিশ্বে আর কোথাও মেলে না। কাশ্মীরের গোলাপের রঙ অনেক বেশি সুন্দর এবং এর সুগন্ধ সারা বিশ্বের অন্য যে কোনও গোলাপের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষক। এই গোলাপ থেকেই বিশ্বের সেরা গোলাপ জল উৎপন্ন হয়। স্রেফ তাগিদের অভাবে এমন সূক্ষ্ম ঐতিহ্যশালী গোলাপ জল উত্পাদন ফুরিয়ে যাচ্ছে।

More Articles