ইতালির ফুটবলের জাদুকর তিনি, অথচ একসময় খেলাও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন আন্দ্রে পির্লো

Life story of Andrea Pirlo : আন্দ্রে পির্লোর কাছে টাকার থেকেও ফুটবলের মূল্য অনেক বেশি। বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও কোনও দেখনদারি নেই তাঁর।

আজ থেকে ১৭ বছর আগের এক সন্ধ্যা। ২০০৫ সালের ২৫ মে। ইস্তানবুলের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়াম জমজমাট। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে মুখোমুখি লিভারপুল এবং এসি মিলান। নিছকই ক্লাব ফুটবলের দু’টি বড়ো নামের দ্বৈরথ নয়; এ লড়াই ইংল্যান্ড বনাম ইতালির। এসি মিলানে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলছেন ২৬ বছরের এক সুদর্শন তরুণ। দেখলে মনে হবে, গ্রিক বা রোমান পুরাণ থেকে সরাসরি তিনি ধরাধামে নেমে এসেছেন। সেরকম ছবির মতো খেলাও তাঁর। কিন্তু উল্টোদিকে লিভারপুল তেতে উঠেছে। নির্ধারিত সময়ের ম্যাচ শেষ হয়ে গেল। স্কোরলাইন ৩-৩। এক ঝলকে পাঠকদের মনে পড়তে পারে ২০২২-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল।

১৭ বছর আগের ওই দিনটিও ফাইনালের মহাদ্বন্দ্ব ছিল। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছিল না। শেষমেশ শুরু হল পেনাল্টি শ্যুট আউট। সেখানে ৩-২ গোলে মিলানকে হারিয়ে দেয় লিভারপুল। চোখের সামনে স্বপ্ন ভাঙতে দেখেন ২৬ বছরের ওই তরতাজা যুবক। এই ঘটনার বেশকিছু বছর পর কোটায় নিজের ছাত্রের সামনে এসে দাঁড়াবেন জিতু ভাইয়া। ছোট বয়সে কোনও জিনিসকে খুব মন দিয়ে চাইলে দু’টো ঘটনা ঘটে। যদি সেটা পাওয়া যায়, তাহলে আনন্দ হয়। আর না পাওয়া গেলে? একে একে সামনে আসে অবসাদ, দুশ্চিন্তা, নিজেকে হেরে যাওয়াদের দলে ভাবা… ‘কনফিডেন্স গির জাতা হ্যায় ভাইসাব!’

২৬ বছরের আন্দ্রে পির্লোর ঠিক সেটাই হয়েছিল। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফিটা। মাথা নিচু করে, কান্না চাপতে চাপতে ফিরে গেলেন তিনি। তিনি তো নিজের সেরা খেলাটা জিততে চেয়েছিলেন। কেবল এসি মিলানের জন্য নয়, ইতালির জন্য জিততে চেয়েছিলেন এই কাপ। সেই ইতালি, পির্লোর স্বপ্নের ইতালি। ডিফেন্সকেও শিল্প ও শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা ইতালি। নব জাগরণের এই দেশ কি কাপ পাবে না? পির্লো পারবেন না? ২০০৫-এর মে মাসে দাঁড়িয়ে চরম সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন তিনি। আর খেলবেন না তিনি। ফুটবল তার জন্য নয়, এই বুটজোড়া তার জন্য নয়। ‘দ্য স্টোরি ওয়াজ ফিনিশড, সো অ্যাঁম আই।’

নিজের আত্মজীবনীতে এমনটাই বলেছেন আন্দ্রে পির্লো। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তের সামনে তখন। কিন্তু একজন তো বলেই গিয়েছিলেন, “হার কে জিতনেওয়ালো কো বাজিগর ক্যাহতে হ্যায়।” মন একটু ঠিক হলে দ্বিগুণ উদ্যমে শুরু হয় পরিশ্রম। ফলাফল? ১৩ মাসের মধ্যে, ২০০৬ সালে ফাইনালে মুখোমুখি ফ্রান্স। সেই বিখ্যাত ফাইনাল, জিদানের শেষ ম্যাচে মাতেরাজ্জিকে ঢুঁসো, এবং লাল কার্ড। সেই ম্যাচেই পেনাল্টি শ্যুট আউটে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ পায় ইতালি। বিশ্বজয়ী টিমের ২১ নম্বর জার্সিধারী কে? আন্দ্রে পির্লো।

দু’বছরের মধ্যে ফের এসি মিলানের মুখোমুখি হয় লিভারপুল। এবার আথেন্সে। সেই ম্যাচে জিতে যায় এসি মিলান। সেই টিমে ফের পির্লো। প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, সেইসঙ্গে জেদ। ফুটবলার পির্লো এখন অবসর নিয়েছেন। এখন কোচিং করান। কিন্তু ২০০৫-এর সেই রাত তৈরি করে দিয়েছিল এক তরুণের ভাগ্য। তৈরি করেছিল ফুটবলের একনিষ্ঠ এক শিল্পীকে। আন্দ্রে পির্লো, বিশ্বের সর্বকালের সেরা সেই শিল্পীদের মধ্যে একজন…

যারা ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে সেরার শিরোপা আদায় করেন, বেশিরভাগেরই জীবন বেশ কষ্টের। হয় দরিদ্র, নয়তো মধ্যবিত্তের জীবন। কিন্তু আন্দ্রে পির্লোর শৈশব সেরকম ছিল না। আক্ষরিক অর্থেই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো তাঁর। আন্দ্রে-র বাবা লুইগি পির্লো একটি স্টিলের কোম্পানি তৈরি করেছিলেন, নাম এলগ স্টিল। ব্যবসা মন্দ চলত না। ছুটির দিন পরিবারের সঙ্গে দূরে ঘুরতে যাওয়া, ভালো জামাকাপড়, ক্রিসমাসে ভালো লজেন্স – পির্লো সবই পেয়েছিলেন।

হতেই পারতেন একজন ব্যবসায়ী। পারিবারিক ব্যবসায় তাঁর নিজস্ব অংশ আছে। সেইসঙ্গে রয়েছে নিজস্ব ওয়াইনের ব্যবসা। দেখতে শুনতে যথেষ্ট ভালো, রোমান গড বললেও অত্যুক্তি হয় না। লম্বা চুল, এক মুখ দাড়ি, ছাঁচে কাটা চেহারা – চাইলে ফ্যাশন মডেল বা অভিনেতাও হতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্য চলে গিয়েছিল মাঠের দিকে। ধুলো মেখে, ঘামে রোদে ভিজে লম্বা একটা দৌড়। একটা সাজানো পাস। ছোট্ট একটা লব পাস। আন্দ্রে পির্লোর কাছে টাকার থেকেও ফুটবলের মূল্য অনেক বেশি। বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও কোনও দেখনদারি নেই তাঁর। বরং ছোট থেকে যে প্রতিভার বলে বলীয়ান ছিলেন তিনি, তার দিকেই যাবতীয় নজর।

পির্লোর যাবতীয় কান্না, ভেঙে পড়া, লড়াই – সবটা মাঠে, ঘাম আর শিশির লাগা ঘাসে। সেই লড়াইই তাঁকে কিংবদন্তি করেছে। ছোটবেলায় নিজের জন্মস্থান ব্রেসচিয়ার হয়ে কেরিয়ার শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে কম বয়সেই ব্রেসচিয়ার সিনিয়র টিমে যোগদান। পির্লোর চেষ্টাতেই ১৯৯৭ সালে টিমটি ইতালির প্রথম সারির টুর্নামেন্ট সিরি এ-তে জায়গা করে নিয়েছিল। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। এমনও হয়েছে যে, খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। প্র্যাকটিসও শেষ। সমস্ত খেলোয়াড়রা বাড়ি চলে গিয়েছে। কোচ এসে দেখেন, পির্লো তখনও অনুশীলনে মগ্ন। কোনওদিকে মন নেই। শেষমেশ সমস্ত আলো বন্ধ করে দিতেন কোচ, যাতে পির্লো বাড়ি চলে যান।

মূলত আক্রমণ ভাগেই খেলতেন তিনি। কিন্তু ফুটবলের এই বিভাগে প্রতিযোগিতা মারাত্মক। পির্লোর প্রতিভা থাকলেও তাঁর স্পিড বেশি ছিল না। ১৯৯৮ সালে ইন্টারে যাওয়ার পরও সেভাবে সুযোগ পাননি। কারণ? সেই কম স্পিড। শেষমেশ লোনে বিভিন্ন ক্লাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ২০০১ সালে ইন্টারে ফিরে এলেও খুশি হতে পারেনি ম্যানেজমেন্ট। ওদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলান পির্লোর জন্য অফার করে। এই ফুটবলার কিই আর এমন করবে? যাক, বরং ওদের তিমেই যাক। ২০০১ সাল। পির্লো চলে এলেন এসি মিলানে। তৈরি হল নতুন একটি উপন্যাসের মুখবন্ধ।

সেই সময় এসি মিলানের কোচ ছিলেন কার্লো আন্সেলোত্তি। কিংবদন্তি এই ম্যানেজার আন্দ্রে পির্লোর প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। সেইসঙ্গে দেখলেন, এতদিন ভুল জায়গায় খেলছিলেন তিনি। একেবারে সামনের দিকে না খেলিয়ে একটু নিচে খেলালে কেমন হয়? ঠিক ডিফেন্সের সামনের ফাঁকা জায়গাটায়… যেখানে পির্লো নিজের মতো খেলতে পারবেন। বল আটকাতেও পারবেন, সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সচেরা পাস দিতে পারবেন। পির্লোর মধ্যে ক্লাসিকাল মিডফিল্ডারের সমস্ত গুণই যে রয়েছে, বুঝতে পারেন আন্সেলোত্তি। নতুন পজিশন থেকেই তিনি গোটা মাঠ দেখতে পারবেন। পরিষ্কার ভাবে বল বাড়াতে পারবেন।

ফুটবল ইতিহাস পরে এই পজিশনেই আন্দ্রে পির্লোকে দেখবে। এই পজিশনেই তিনি একের পর এক জাদু দেখাবেন। ফুটবল ইতিহাস জানবে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডারের নাম। ২০১১ সালে মিলান ছেড়ে জুভেন্তাসে গিয়েও কামাল করেন। ২০০৩ সাল থেকে জুভেন্তাস কোনও ট্রফি জেতেনি। পির্লো যাওয়ার পর পরপর চারটে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ, দু’টো সুপারকোপা ইতালিয়ানা, একটা কোপা ইতালিয়া জেতে জুভেন্তাস।

ইতালিতে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দ্য আর্কিটেক্ট’; এমন একজন, যিনি পুরো খেলাটা তৈরি করেন। যার হাত দিয়ে একটা ম্যাচ তৈরি হয়। বাকিরা তাঁর সহযোগী। তিনিই ম্যাজিশিয়ান। এসবের বাইরে পির্লো সেই ২০০৫ এঁর ২৬ বছরের সেই তরুণটির স্বপ্ন দেখেন। যার কান্না, যার ভেঙে পড়া, যার ফিনিক্স পাখি হয়ে ফিরে আসার গল্প তিনি দেখেন রোজ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে ছেলেটি সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর সামনে। আঙুল তুলে বলে, হ্যাঁ, তুমি আন্দ্রে। তুমিই। হেরে গিয়েও ফিরে আসা এক বাজিগর।

More Articles