জীবনের ৭২ বছর লোহার ফুসফুসে বেঁচে আছেন! অবাক করবে এই বৃদ্ধের কাহিনি

Polio Iron Lungs : ২০২০ সালে আলেকজান্ডার তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন, থ্রি মিনিটস ফর আ ডগ: মাই লাইফ ইন অ্যান আয়রন লাং।

আর পাঁচটা স্বাভাবিক গ্রীষ্মের মতোই ছিল ১৯৫২ সালের সেই দিন। বাইরে খেলছে পাড়ার ছেলেমেয়েরা। শরীরটা হঠাৎ করেই কেমন খারাপ হতে থাকে আলেকজান্ডারের। বয়স তখন কতই বা, ৬ কী ৭! কে জানত, ওই গ্রীষ্মের দুপুরের সামান্য অসুস্থতা আগামী ৭১ বছর তাঁকে ঠেলে দেবে মেশিনের গভীরে। শুধু মাথাটুকু বেরিয়ে থাকে তাঁর, খাবার খান ওভাবেই, দাড়িও কামান, ওভাবেই শুয়ে শুয়ে লিখে ফেলেছেন বই। শুধু মাথাটুকু বের করা। বাকিটা এক নলাকার মেশিনের পেটে। মেশিন থেকে বেরোলেই প্রাণ শেষ। টেক্সাসের পল আলেকজান্ডারের সেদিন কী হয়েছিল? ঘাড় ও মাথায় ব্যাথা এবং প্রচণ্ড জ্বর। বাড়িতে এসে মাকে বলতেই, দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মা। মা ঠিকই বুঝেছিলেন তাঁর সন্তানের সঙ্গে কী হতে চলেছে। দিন কয়েকের মধ্যেই, আলেকজান্ডার আর নড়াচড়া করতে পারে না, কথা বলতে পারে না, গিলতেও পারে না। পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল আলেকজান্ডার।

এখন ঘাড় থেকে প্রায় সম্পূর্ণই পঙ্গু হয়ে গেছেন তিনি। বয়স আশির কাছাকাছি। তবু বেঁচে আছেন এবং ভালোই আছেন। শুধু জীবনের প্রায় ৭২টা বছর স্টিলের নলের মধ্যে ঢুকে রয়েছেন। এই মেশিনই দীর্ঘ সাত দশক ধরে শ্বাস নিতে সক্ষম করেছে পল আলেকজান্ডারকে। ওই নল আসলে আয়রন লাংস বা লোহার ফুসফুস। এই বিশেষ ফুসফুস ব্যবহার করা শেষ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন তিনি। সারা বিশ্বে পোলিও যখন মহামারী হয়ে ওঠে তখন পোলিও ওয়ার্ডে এই যন্ত্রের মধ্যে থেকে মাথা বের করে রাখা শিশুদের দৃশ্য ছিল অতি সাধারণ। সেই কোনকাল থেকে আলেকজান্ডার এই নলের মধ্যে থাকেন। লোহার ফুসফুস তাঁকে প্রাণবায়ু জোগায় বলেছেন। হাল ছাড়েননি তিনি। কখনই না।

আরও পড়ুন- ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেন তিনিই! ‘কালো ভারতীয়’ এই চিকিৎসককে ফিরিয়েছিল হাভার্ড!

এই যন্ত্র তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, অথচ এই যন্ত্রেই তিনি বন্দি। তবে বন্দি হয়েও অনার্স সহ স্নাতক হন তিনি। দক্ষিণ মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পান। সেই সময় দিনে সামান্য সময় এই লোহার ফুসফুস ছাড়াই শ্বাস নিতে পারতেন তিনি। ওই সময়েই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন হুইলচেয়ারে করে। আলেকজান্ডার ১৯৮৪ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্টিন ল স্কুল থেকে স্নাতক হন। একজন আইনজীবী হিসাবে কাজও শুরু করেন। হুইলচেয়ারে বসে বসেই মামলা লড়তেন তিনি।

২০২০ সালে আলেকজান্ডার তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন, থ্রি মিনিটস ফর আ ডগ: মাই লাইফ ইন অ্যান আয়রন লাং। বইটি লিখে শেষ করতে তার পাঁচ বছর লেগেছিল। বই লিখেছিলেন নিজেই, কারও সাহায্য না নিয়ে। নিজের মুখে একটি হাতল দিয়ে আটকে রাখা কলম দিয়ে লিখতেন তিনি, একটি একটি করে শব্দ।

পোলিও অর্থাৎ পোলিওমাইলাইটিস ২০ শতকের মাঝামাঝি ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে ওঠে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতেন এই রোগে। হাজার হাজার মানুষ মারাও যেতেন। পোলিওভাইরাস এক সংক্রামক রোগ যা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে, যার ফলে প্রায় ০.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও না কোনওভাবে রোগীর পক্ষাঘাত হয়। ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ তম রাষ্ট্রপতি, ১৯২১ সালে পোলিওতে আক্রান্ত হন। পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায় তাঁর৷ ১৯৫৩ সালে ভাইরোলজিস্ট জোনাস সালক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পরে স্বাস্থ্য পরিষেবার কর্মকর্তারা ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন৷

আরও পড়ুন- নতুন মহামারীর নাম হবে অবসাদ?

পোলিও মহামারী ২০ শতকের মাঝামাঝি ওই সময়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। যারা ফুসফুসের পক্ষাঘাতে ভুগছিলেন তাদের জন্য লোহার ফুসফুসের দরকার পড়ে। এই যন্ত্রটি একটি চাপ তৈরি করত যাতে ফুসফুস প্রসারিত হতে বাধ্য হতো, আর রোগীকে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিত। এই মুহূর্তে আলেকজান্ডার সম্ভবত সেই দু'জনের মধ্যে একজন যাঁরা এখনও লোহার ফুসফুস ব্যবহার করছেন। স্মিথসোনিয়ানের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্ট্রি বলছে, ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১,২০০ জন মানুষ এই লোহার ফুসফুসের উপর নির্ভর করে বেঁচেছিল। ২০০৪ সাল নাগাদ মাত্র ৩৯ জন ব্যক্তি তা ব্যবহার করত।

আলেকজান্ডার জানাচ্ছেন, লোহার ফুসফুসের জীবনকে মেনে নেওয়া, এই জীবনের সঙ্গে নিজের শরীরকে, মনকে মানিয়ে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। তিনি যে অন্যদের থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছেন, বুঝতে পারতেন। এই ভেন্টিলেটরের বাইরে বেরনোর পথ খুঁজছিলেন তিনি। সেই সময় আলেকজান্ডারের নার্স তাঁকে বলেন, তিনি যদি এই আয়রন লাংস ছাড়া ৩ মিনিট শ্বাস নিতে পারেন তাহলে তিনি পলকে একটি কুকুরছানা উপহার দেবেন। পেরেছিলেন পল আলেকজান্ডার। একদম শুরুর দিকে এই লোহার ফুসফুস ছাড়া তিন মিনিট শ্বাস নিতে পারতেন তিনি। ধীরে ধীরে তিনি ব্যাঙের মতো শ্বাস নেওয়া শেখেন। অর্থাৎ ফুসফুসে বাতাস ঠেলে গলার পেশী ব্যবহার করে যেভাবে ব্যাঙ শ্বাস নেয়, তিনিও সেভাবেই শ্বাস নিতেন। তিনি মিনিট থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বেশ কয়েক ঘণ্টা ওভাবেই শ্বাস নিতে শেখেন তিনি। তখন হুইচেয়ারে করে বেরিয়ে পড়তেন। পড়াশোনাও ওইভাবেই। তবু, নিজেকে শেষ হতে দিতে চাননি আলেকজান্ডার। লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। পোলিও নির্মূল হয়েছে। পোলিওকে নিয়ে ভীতি আর নেই। কিন্তু কী ভয়াবহ অবস্থা ছিল সেই সময় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ পল। তবু হার না মানার উদাহরণও তিনিই। লোহার ফুসফুস তো বটেই, পলকে আসলে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁর জীবনীশক্তি, অদম্য, অনন্ত!

More Articles