শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ২
Shri Chaitanya Deb: অধিকাংশই মনে করেন যে, রথযাত্রার সময় পায়ে ইটের টুকরো বিঁধে সেই অংশে টিটেনাস হয়ে মারা যান মহাপ্রভু
বাংলার গ্রামেগঞ্জে চৈতন্য ও তাঁর শিষ্যদের ঘিরে কত যে মেলা জমে ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। এর মধ্যে অগ্রদ্বীপের মেলা,পানিহাটির চিড়ের মেলা, রামকেলীর মেলা আজও ব্যাপক জনপ্রিয়। প্রতিটি মেলার নেপথ্যে আছে এক অশ্রুতপূর্ব অনিন্দ্যসুন্দর ইতিহাস। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো। শোনা যায়, বিষয়-বাসনা ছাড়তে না পারার কারণে চৈতন্য তাঁর এক শিষ্য গোবিন্দ ঘোষকে সংসারে ফিরে যেতে বলেন। গোবিন্দ ঘোষ সংসারে গিয়ে আরও নিঃস্ব হলেন। হারালেন স্ত্রী-পুত্রকে। প্রিয়জনকে হারানোর শোক, মহাপ্রভুর করুনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যথাভার,তার সঙ্গে এসে জুড়লো নিজের অন্তিম সৎকারের চিন্তা। কে করবে তার পরলোককর্ম? শোনা যায় গোবিন্দ ঘোষকে স্বপ্নে অভয় দেন গোপীনাথ স্বয়ং।
তাঁরই সমাধিমন্দিরে প্রতি বছর দোলপূর্ণিমার পরে কৃষ্ণা একাদশীতে তার প্রয়াণদিবসে এই মেলা হয়ে আসছে। রামকেলীর মেলা মালদা জেলার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মেলা। সাকার মল্লিক ও দাবির খাসের (রূপ ও সনাতন) সঙ্গে মিলিত হতে নাকি চৈতন্য স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন মালদহের রামকেলী নামক স্থানে (সম্ভবত ১৫১৫ সালে)। সেই পদধূলিধন্য স্থানেই জৈষ্ঠ্য মাসের সংক্রান্তিতে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে সেই মেলা।আগেই বলেছি লীলামাহাত্ম্য শ্রীচৈতন্য থেকে কিছু কম যান না তার পারিকরেরা। পানিহাটিতে শ্রীচৈতন্যের এক ভক্ত রাঘব পণ্ডিতের গৃহে নিত্যানন্দ প্রায় তিনমাস থেকে ওই অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন।আবার বৃন্দাবন থেকে নীলাচল যাবার পথে এবং নীলাচল থেকে বৃন্দাবন ফেরার কালে শ্রীচৈতন্যও দু'দণ্ড জিরিয়ে নিতে পদার্পণ করেছিলেন পানিহাটিতে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের ষোড়শ পরিচ্ছদে ও শ্রী চন্দ্রোদয় নাটকের নবম অঙ্কে তার উল্লেখ আছে। মহাপ্রভু নাকি ক্ষুধার্ত অবস্থায় পানিহাটি ঘাটে নেমে দই-চিড়ে খেয়েছিলেন, এমনই লিপিবদ্ধ আছে পানিহাটির ঘাট সংলগ্ন দেওয়ালে। মহাপ্রভুর আবির্ভাব উপলক্ষ্যে আজও কার্তিক মাসের পয়লা তারিখ পানিহাটিতে চিড়ের মেলা বসে।
গোরাচাঁদের বাজারে,একমন যার সেই যেতে পারে
চৈতন্যের প্রভাব কোনও একটি ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালির জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তিনি, মানসের একমেবাদ্বিতীয়ম পুরুষ তিনি,ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতির আইকন তিনি।দেখুন প্রান্তিক দেহবাদী বাউল সাধকের গানে কিভাবে বারবার উঠে আসছেন তিনি। বাউল বলছে-“এলোরে চৈতন্যের গাড়ি সোনার নদীয়ায়/শ্রীঅদ্বৈত ইঞ্জিনিয়ার,নিত্যানন্দ টিকিটমাষ্টার/আবার শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে ড্রাইভার সেই গাড়ি চালায়”। আবার ফকিরদের হৃদয়েরও রাজা তিনি।কতবার গৌরডাঙায় মনসুর ফকিরকে বিভোর হয়ে গাইতে শুনেছি “আমার নিতাইচাঁদের দরবারে, গোরাচাঁদের বাজারে, একমন যার সেই যেতে পারে”।
আরও পড়ুন - শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ১
সম্প্রতি কয়েকজন গবেষক দাবি তুলেছেন শ্রীচৈতন্য অ্যান্ড্রোজেনাস। তথ্য উৎস হিসেবে তাঁরা কাজি সিরাজউদ্দিনের বাড়িতে যাওয়ার সময় শ্রীচৈতন্য পরিহিত পোষাকের বর্ণনা দিচ্ছেন। একই অঙ্গে পুরুষ ও নারী উভয়কে অনুভব করার প্রবণতাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন। দু'টি বিষয় এই প্রসঙ্গে বলার।
এক, অনেক গবেষক অতীতে বারবার চৈতন্যের মূর্ছা যাওয়ার ঘটনাকে তো হিষ্টিরিয়া বলতেন। ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বই ঘেঁটে তুলে এনেছেন অসাধারণ যুক্তি। পণ্ডিত হেমাঙ্গপ্রসাদ শাস্ত্রী ভাগবতভূষণ রচিত 'গম্ভীরামাহাত্ম্য' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি তুলে তিনি দেখাচ্ছেন গম্ভীরার ঘরে শ্রীকৃষ্ণের ছবি এঁকে তাতে অশ্রুবর্ষণ এবং ক্রমাগত মুখঘর্ষণ করছেন শ্রীচৈতন্য।এখন প্রশ্ন হিষ্টিরিয়ার রোগী অবচেতন অবস্থাতেও কৃষ্ণ মুখচুম্বনের মত কাজটি করবেন কী করে? তবে কি দেহে মনে রাধা হয়ে উঠতেই চেয়েছেন তিনি! হয়তো এখনও স্থির সিদ্ধান্তে আসার সময় আসেনি তিনি অ্যান্ড্রোজেনাস কি না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই তিনি অ্যান্ড্রোজেনাস, ভাবুন তো তৎকালীন বঙ্গীয় মধ্যবিত্তের মানসিক ঔদার্য্য ও আধুনিক মনস্কতার প্রসর!
মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান
চৈতন্যের মৃত্যু ঘিরে আজও প্রহেলিকার শেষ নেই। “জয়ানন্দের... রথ বিজয়া নাচিতে/ইটাল বাজিল পায়ে আচম্বিতে” (চৈতন্যমঙ্গল)তত্ত্বটিই সর্বাধিক মান্যতা পেয়েছে। অধিকাংশই মনে করেন যে, রথযাত্রার সময় পায়ে ইটের টুকরো বিঁধে সেই অংশে টিটেনাস হয়ে মারা যান মহাপ্রভু। কৃষ্ণদাস কবিরাজ কিন্তু ইঙ্গিঁত দিচ্ছেন কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর চৈতন্যের মানসিক ভারসাম্যহীনতার। চৈতন্যচরিতামৃতের অন্তলীলা খণ্ডে তিনি বলেছেন “এইমত মহাপ্রভু রাত্রি দিবসে/উন্মাদের চেষ্টা প্রলাপ করেন প্রেমবশে”।শেষ পরিচ্ছদে তিনি দেখাচ্ছেন সারারাত রামানন্দ রায় ও অন্যান্য পারিকরদের সাথে দিব্যোন্মাদ চৈতন্য নাচগান করার পর সকালবেলা স্নান সেরে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছেন। তারপর? কৃষ্ণদাস কবিরাজের জবানিতে “অলৌকিক প্রভুর চেষ্টা প্রলাপ শুনিয়া/তর্ক না করিও শুন বিশ্বাস করিয়া”। তিনি ইঙ্গিত করছেন, অলৌকিকভাবে জগন্নাথের মূর্তিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। এখানেই খটকা! চৈতন্য বিলীন হচ্ছেন নাকি তাকে গুমখুন করা হল?
সাম্প্রতিক অতীতে রচিত জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের “কাঁহা গেলে তোমা পাই” বইটিতে এই প্রসঙ্গে অনেক বাস্তবধর্মী সূত্র ছড়ানো রয়েছে। তবে তিনি আদৌ কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। কেউ কেউ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের পূজ্য আউলিয়াচাঁদের মধ্যে চৈতন্যের পুনঃঅভ্যুত্থান দেখতে পান। যিশুর মৃত্যু এবং বৈবাহিক জীবন নিয়ে তৈরি হওয়া অসংখ্য প্রশ্নগুলোর কথা মনে আসছে (উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন “জেসাস ইন ইন্ডিয়া” বইটি)।
যুগে যুগে মহাপুরুষের মৃত্যু নিয়ে এত ধোঁয়াশা কেন? আসলে হয়তো প্রেরিত পুরুষের সামান্য মৃত্যু ভক্তকুল মেনে নিতে পারেন না। এক ব্যাধের হাতে কৃষ্ণের মৃত্যু কি তাড়িত করে না তার ভক্তদের হৃদয়? আবার মৃত্যুতে যদি অলৌকিকত্বের ছোঁয়া থাকে তাহলেই খেপে যাবেন যুক্তিবাদীরা। অবশ্য এই নিরন্তর প্রশ্ন মহাপুরুষের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে না।
চৈতন্যকে নিয়ে বহু রচনা হয়েছে। এই নিবন্ধ সেগুলির তুলনায় নাবালকের ধৃষ্টতা মাত্র। শেষ কথনে দুই নারীর কথা বলব।লক্ষীপ্রিয়া আর বিষ্ণুপ্রিয়া। প্রাণপ্রিয়ের সঙ্গে বন্ধনহীন গ্রন্থি গড়ে ওঠার আগেই বিষধর সাপের দংশনে জীবনলেখ্য শেষ করলেন লক্ষীপ্রিয়া। আর বিষ্ণুপ্রিয়া কী পেলেন? শ্রীরাধারই মত অনন্ত বিরহ, সুরের সংবেদ, অশ্রুজলরেখা। প্রিয়জন সন্ন্যাস নিল। নীলাচলে যাওয়ার আগে শেষ দেখাটুকুও হল না।তারপর তাঁর কী হল? সে কথা আর কেউ বলেননি। শ্রেষ্ঠ মরমিয়া বাউল শিরোমণি লালন সাঁই অবশ্য তাঁকে ভোলেননি। তাঁর একটি পদে রয়েছে সংসার ত্যাগে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চৈতন্যকে ভৎসনা। লালন শচীমাতার কথা লিখছেন এইভাবে-
“মনে ইচ্ছা ছিল তোঁরই/
বুঝিয়ে নাচের ভিখারি/
তবে কেন বিয়ে করলি পরের মেয়ে/
কেমনে আমি রাখব ঘরে।”
প্রাণপ্রিয় পাঠক কান পেতে ওই শুনুন, “নধরকান্তি গোরাচাঁদের জন্য বিষ্ণুপ্রিয়ার কাজলকালো চোখে শ্রাবণমেঘের দিন,মুখে দীর্ঘশ্বাস-“হা কৃষ্ণ!”