'বাংলাদেশি বাবু' ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
Nagarwala Scam: রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা আসলে কে ছিলেন? সেই ‘বড় খবর’, যা তিনি ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, সেটাই বা কী?
দিল্লির সংসদ রোডে এসবিআই-এর যে ব্রাঞ্চটি রয়েছে, তা মূলত নেতা-মন্ত্রী, আমলা-সহ অনেক হাই প্রোফাইল ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ম্যানেজ করে। তারিখ ২৪ মে, ১৯৭১। সেদিন সকালবেলা ব্যাঙ্ক খুলেছে সবে আধঘণ্টা হয়েছে। ব্যাঙ্কে একটি ফোন এল। ফোনটি তুললেন ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার বেদপ্রকাশ মালহোত্রা। এরপর যা কথোপকথন হলো, তা নিম্নরূপ:
-নমস্কার। আমি পি এন হাক্সর বলছি, ম্যাডাম আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
(পি এন হাক্সর ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্যসচিব, এরপর তিনি কলটি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ট্রান্সফার করেন)
-আমি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলছি...
আরও পড়ুন: ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ
এভাবে কিছুক্ষণ ফোনে কথোপকথন চলল। ফোনে ইন্দিরা গান্ধী মালহোত্রাকে নির্দেশ দেন, ব্যাঙ্কের থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে একটি বিশেষ জিনিস ডেলিভারি করার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়ে যাওয়ার পর বেদপ্রকাশ মালহোত্রা ডেপুটি ক্যাশিয়ারকে নির্দেশ দিলেন ব্যাঙ্কের গাড়িতে ৬০ লক্ষ টাকা ভরে রেডি করতে। টাকা ভরা হয়ে গেলে সেই ব্যাঙ্কের গাড়ি নিজেই চালিয়ে নিয়ে চলে গেলেন মালহোত্রা। ব্যাংকের থেকে কিছু দূরেই বিশেষ একটি স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভদ্রলোক। মালহোত্রা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনিই 'বাংলাদেশি বাবু' কি না? জবাব এল, 'Bar at law.' এটিই ছিল কোড ওয়ার্ড। এবার সেই বাংলাদেশি বাবুকে গাড়িতে বসিয়ে পঞ্চশীল মার্গ জংশনের দিকে এগিয়ে চললেন বেদপ্রকাশ মালহোত্রা। ক্যাশভর্তি বাক্স নিয়ে জংশনে নেমে 'বাংলাদেশি বাবু' বেদপ্রকাশ মালহোত্রাকে বললেন, অতি অবশ্যই সংসদ ভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভাউচার কালেক্ট করে নিতে।
পি এন হাক্সর এবং ইন্দিরা গান্ধী
বেদপ্রকাশ মালহোত্রা সেইমতো গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন সংসদ ভবনের দিকে। কিন্তু সেই সময় ব্যস্ততার কারণে প্রধানমন্ত্রী দেখা করতে পারেননি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, অর্থাৎ, সাত নম্বর রেসকোর্সের দিকে যান মালহোত্রা।
কিন্তু ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্কে হয়ে গিয়েছে আরেকটি কাণ্ড। ডেপুটি ক্যাশিয়ার রোহেল সিং ম্যানেজারকে জানান, প্রায় দু'ঘণ্টা আগে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার ৬০ লক্ষ টাকা গাড়িতে লোড করিয়ে নিয়ে চলে গেছেন। সেই থেকে কোনও খোঁজ নেই তার। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের দ্বারস্থ হন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। পুলিশের কাছে যেতেই খবরটি লিক হয়ে যায় মিডিয়ায়। সারা শহরে রটে যায় এসবিআই সংসদ রোডের ব্রাঞ্চে ৬০ লক্ষ টাকা ডাকাতি হয়েছে। পুলিশ এসপি টি কে কাশ্যপের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সবার প্রথমে পঞ্চশীল মার্গের জংশনে পুলিশ খোঁজ করে। সেখান থেকে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে তারা ধরে, যার গাড়িতে করে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন ওই 'বাংলাদেশি বাবু'। ট্যাক্সিওয়ালা জানান, বেশ বড় একটি বাক্স নিয়ে গাড়িতে উঠেছিলেন ওই ভদ্রলোক। পুরনো দিল্লির দিকে গাড়ি নিয়ে যেতে বলেন তিনি। রাস্তায় যাওয়ার সময় একটি বড় স্যুটকেস কেনেন তিনি। আর গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় ৫০০ টাকা ভাড়াও দেন। এর থেকে পুলিশ অনুমান করে, ওই বাক্স থেকে টাকা স্যুটকেসে নিয়ে পালিয়েছে অপরাধী। ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছে খবর আসে, এফআইআর দায়ের হয়েছে জানতে পেরে ফেরার হয়ে গেছেন বেদপ্রকাশ মালহোত্রা। ২৪ মে-র প্রায় মাঝরাতে ধরমশালা থেকে এক স্যুটকেসভর্তি টাকা সমেত একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনাচক্রে সেই স্যুটকেসের মধ্যে ৬০ লক্ষ টাকাই পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তির নাম ছিল রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা।
সেদিনই ভোররাতে প্রেস কনফারেন্স করে দিল্লি পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের সামনে তারা জানায় দোষী রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা ধরা পড়েছে। সে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আওয়াজ নকল করে ব্যাঙ্কে ফোন করেছিল এবং ৬০ লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার তালে ছিল।
দোষী ধরা পড়লেও বেশ কয়েকটি খটকা ছিল, বড় বড় খটকা। রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা নামক যে লোককে দোষী সাব্যস্ত করে মিডিয়ার সামনে প্রস্তুত করেছিল দিল্লি পুলিশ, তার মুখে ফেসিয়াল প্যারালাইসিস ছিল। যার মুখের এক দিকে প্যারালাইসিস, সে কীভাবে অন্য আরেকজনের গলার আওয়াজ নকল করতে পারে! উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউই মানতে চাইছিলেন না পুলিশের এই যুক্তি। উপরন্ত, ব্যাঙ্কের এত বড় একজন অফিসার শুধুমাত্র একটা ফোন কলেই টাকা দিয়ে দিল? আর টাকাটা এল কোথা থেকে? কার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হলো? বেদপ্রকাশ মালহোত্রা যেভাবে টাকা দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছিল, ফোন কল মারফৎ এরকম ফান্ড রিলিজ প্রায়শই হয়ে থাকে। কিন্তু এতসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই নাগারওয়ালার ওপর মোকদ্দমা শুরু হল। এবং প্রথম দিনেই কোর্টে নিজের দোষ স্বীকার করে নিল নাগারওয়ালা। মাত্র ১৫ মিনিটের শুনানিতে, শুধুমাত্র নাগারওয়ালার বয়ানের ওপর ভিত্তি করে, কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই নাগারওয়ালাকে দোষী সাব্যস্ত করল হাই কোর্ট। নাগারওয়ালার দাবি ছিল, এই কাণ্ডের মাধ্যমে সে ভারত সরকারের নজর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের দিকে করতে চাইছিল। যাই হোক কোর্টের রায়ে শাস্তিস্বরূপ তার চার বছরের জেল এবং ১০০০ টাকা জরিমানা হলো।
রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা-র স্কেচ
কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, যদি না এর পরে পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটত। জেলে ঢুকতে না ঢুকতেই নিজের বয়ান পাল্টে ফেলে নাগারওয়ালা। সে কোর্টে আপিল করে, তার মামলা পুনরায় বিচার করে দেখা হোক, তবে তা খারিজ হয়ে যায়। তবে এই মামলায় এখনও বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর অজানা ছিল, তাই তদন্ত জারি রাখার সিদ্ধান্ত নেয় দিল্লি পুলিশের বিশেষ কমিটি। এরই মধ্যে ২০ নভেম্বর, ১৯৭১, গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান নাগারওয়ালা কাণ্ডের তদন্ত কমিটির হেড টি কে কাশ্যপ। এর কয়েকদিন পর নাগারওয়ালা ‘দ্য কারেন্ট’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক টি কারাকা-কে একটি চিঠি লিখে জানায়, সে তাকে একটি ইন্টারভিউ দিতে চান। চিঠিতে নাগারওয়ালা দাবি করেন, তিনি দেশের সবচেয়ে বড় খবর ফাঁস করতে চলেছেন। ওই একই চিঠির একটি প্রতিলিপি তিনি নিজের আইনজীবী আর সি মহেশ্বরীকে দিয়েছিলেন। সেই চিঠি থেকেই এই তথ্যগুলি সামনে আসে। কিন্তু কারাকা-কে আর ইন্টারভিউ দেওয়া হয়নি রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালার। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে কারাগারেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
এরপর এই কেসটি শিরোনামে আসে ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের সময়। মোরারজি দেশাই এই কেসের তদন্তের জন্য জগনমোহন রেড্ডি কমিশন গঠন করেন। সেই কমিশন তদন্ত করে একটি ৮২০ পাতার রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে তারা সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীর দিকে দুর্নীতির অভিযোগ না আনলেও দাবি করে, ইন্দিরা গান্ধী সরকারের অনেক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি এই কেসের তদন্তকে প্রভাবিত করেছেন। এছাড়াও ওই কমিশন দাবি করে সংসদ রোডের এসবিআই ব্যাঙ্কে বেনামে অনেক টাকা গচ্ছিত রয়েছে। ওই কমিশন নিজের রিপোর্টে সাফ জানিয়ে দেয়, এরকম ফোনের মাধ্যমে ফান্ড রিলিজ এর আগেও বহুবার হয়েছে। জগনমোহন রেড্ডি কমিশনের রিপোর্ট সামনে আসতেই ব্যাঙ্ক নিজেদের ইন্টার্নাল ইনভেস্টিগেশন শুরু করে এবং বেদপ্রকাশ মালহোত্রাকে সাসপেন্ড করে দেয়। ওই একই বছর 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' নিজেদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করে, ১৯৭১ সালের মে মাস থেকেই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেছিল ভারতীয় সেনা। ওই ৬০ লক্ষ টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেই পাঠানো হচ্ছিল, কিন্তু ডেপুটি ক্যাশিয়ার রোহেল সিংয়ের তাড়াহুড়োর জন্য তা সকলের সামনে চলে আসে। এবং এই ক্ষেত্রে নিজেরা বাঁচতে স্রেফ বলির পাঁঠা বানানো হয় রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালাকে।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১ সালে ভারতে শুরু হয় মারুতি উদ্যোগ
এক্ষেত্রে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য জানিয়ে রাখা উচিত, পরবর্তীকালে ভারতে মারুতি উদ্যোগ শুরু হলে ভারত সরকারের তরফে চিফ অ্যাকাউন্টিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই বেদপ্রকাশ মালহোত্রাকে। এরপর এই মামলাটি আরও একবার প্রকাশ্যে আসে ১৯৮৬ সালে। সেবার স্টেটসম্যান নাগারওয়ালার বেশ কয়েকটি চিঠি নিজেদের সংবাদপত্রে প্রকাশ করে। চিঠিগুলিতে নাগারওয়ালা বারংবার দাবি করেছে, ইন্দিরা গান্ধী তাকে চেনেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার দেখা করতে চেয়েও যে সে বিফল হয়েছে, সেকথারও উল্লেখ রয়েছে চিঠিগুলিতে। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই বেদপ্রকাশ মালহোত্রার কাছ থেকে সে বাংলাদেশি বাবু নাম নিয়ে টাকা নিয়েছিল, এমনটাই দাবি করেছিলেন নাগারওয়ালা। এইসব চিঠি সামনে আসতেই সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন শুরু হয়, নাগারওয়ালা আসলে RAW এজেন্ট ছিলেন। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা যেতে পারে, ইন্দিরা গান্ধীর জীবনিকার ক্যাথরিন ফ্রাঙ্ক নিজের বই ‘Indira’-তে আর এস এ নাগারওয়ালা নামক এক এজেন্টের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, প্রথমে ভারতীয় সেনায় ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কে ছিলেন নাগারওয়ালা, এবং পরবর্তীকালে RAW-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান তিনি। অবশ্য এই দাবি নস্যাৎ করে দেয় RAW। ’৮৬ সালের নভেম্বর মাসে হিন্দুস্তান টাইমস-এর তরফে দাবি করা হয় যে, নাগারওয়ালা আসলে ছিলেন CIA এজেন্ট। নাগারওয়ালা CIA-র হয়ে কাজ করছিলেন এবং এই পুরো প্রকরণের উদ্দেশ্য ছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে বিশ্বের দরবারে অপদস্ত করা।
আসল সত্যি কী ছিল? রুস্তম সোহরাব নাগারওয়ালা আসলে কে ছিলেন? সেই ‘বড় খবর’, যা তিনি ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, সেটাই বা কী? সিনেমার ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, “Yeh raaz bhi ussi ke sath chala gaya.”