দিনে ইজারায়েলি সেনা, রাতে সেটলার! প্যালেস্টাইনের হেবরন যেন সাক্ষাৎ কালাপানি
Israel-Palestine conflict: দিনে সেনা, রাতে সেটলার, বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে, জানলা থেকে একেকটা বাড়ির দিকে তাক করে রাখা রয়েছে বন্দুক। কান পাতলেই সেনার গর্জন, বাড়ির ভিতরে থাকতে বলার নির্দেশ।
ইজরায়েলি আগ্রাসনে ছাড়খার গাজা। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ একাধিক এলাকা ঘিরে রেখেছে ইজরায়েলি বাহিনী। চলছে লাগাতার অভিযান। মাঝেমধ্যেই এসে আছড়ে পড়ছে রকেট। ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের হেবরন। যেখানে এখন অবৈধ ভাবে বসবাস করছে অন্তত সাতশো ইজরায়েলি, যাদের পরিচয় ইজরায়েলি সেটলার (বসতিস্থাপনকারী) নামে। যাদের দৌরাত্ম্যে হেবরনের রাস্তাঘাট জুড়ে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। হেব্রনের এইচ টু এলাকায় এক সময় থাকতেন ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি। আর তার উপর ইজরায়েলি সেনা তো রয়েইছে। রাস্তা জুড়ে টহল দিচ্ছে তারা। জোড়া অত্যাচারে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাসিন্দাদের জন্য। গোটা এলাকায় জারি করা হয়েছে পুরোপুরি লকডাউন। এই পরিস্থিতিতে যে কী অবস্থায় রয়েছে হেবরনের মানুষ, তা ভাবাটাও বোধহয় কঠিন।
খাদ্য নেই, জল নেই। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই। নেই জীবিকাও। এরকম পরিস্থিতির আগে কখনও মুখোমুখি হননি স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বিতীয় ইফতিদা অর্থাৎ প্যালেস্টাইনের দ্বিতীয় বার গণজাগরণের সময়েও এমন কাণ্ড দেখেননি কখনও, জানালেন স্থানীয় গাড়ি চালকদের ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট বসম আবু আইশা। সেই সময়েই দোকান বাজার করার, জীবিকা নির্বাহ করার অধিকার ছিল আমাদের কাছে। তবে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন এই যুদ্ধ যেন এক লহমায় সব পাল্টে দিয়েছে। সমস্ত রকম অধিকার ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে মানুষকে। যেন একটা বন্দিশালায় বন্দি ওইসব এলাকার মানুষ। অপরাধ জানা নেই। তবু জেল খাটার শাস্তি নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছে তাদের।
আরও পড়ুন: গাজার যুদ্ধে ‘হ্যানিবাল’ নীতি নিচ্ছে ইজরায়েল? কী এই বিতর্কিত হ্যানিবাল প্রোটোকল?
দিনে নিপীড়ন চালায় ইজরায়েলি সেনা। চলে তল্লাশি, হামলা, অত্যাচার। আর রাত বাড়লেই ইজরায়েলি সেটলার (বসতি স্থাপনকারীদের) উৎপাত শুরু। ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাস-হামলার পরেই কোনও রকম অ্যালার্ম ছাড়াই হেবরনের ফিলিস্তিনি দোকানগুলিতে ঢুকে পড়ে ইজরায়েলি সেনারা। দোকানদার ও কর্মীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঘরবন্দি হয়ে যায় গোটা এলাকা। ঘোষণা করে দেওয়া হয়, কোনও ফিলিস্তিনিকে রাস্তায় দেখা গেলেই তাঁকে গুলি করে মারা হবে। ভয়ে আতঙ্কে সম্পূর্ণ ভাবে গৃহবন্দি হয়ে বসে রয়েছে গোটা হেবরন। দিনে রাতে বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত বাড়িগুলির ছাদে টহল দিচ্ছে ইজরায়েলি সেনা।
করোনার সময় লকডাউন দেখেছে গোটা বিশ্ব। ভাইরাসের ভয়ে ঘরের ভিতর সিঁধিয়ে গিয়েছিল দুনিয়া। কিন্তু হেবরনের লকডাউনের সঙ্গে সেই লকডাউনের কোনও মিল নেই। খাদ্য, পানীয় জল থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিষেবা থেকে যেভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে হেবরনের জনজীবন, যেভাবে তাড়া করছে মৃত্য়ুভয়, তা কার্যত নজিরবিহীন। ইজরায়েল বাহিনী দখব নেওয়ার পর অন্তত চারদিন পর্যন্ত কোনও ফিলিস্তিনি ঘরের জানলা খুলতে পর্যন্ত সাহস করেননি। ক্রমে ফুরিয়ে এসেছে বাড়ির সমস্ত সঞ্চিত খাদ্য। আপাতত কিছুক্ষণের জন্য ছাড় ঘোষণা করেছে ইজরায়েলি সেনা। রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার, সকালে একবার এবং বিকেলে একবার। সেই নির্দিষ্ট সময়টুকুতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে চেকপয়েন্ট ক্রস করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা। কিন্তু কিনবেন কোথা থেকে? ইজরায়েলি বাহিনীর ভয়ে দোকানপাটের চিহ্ন মাত্র নেই গোটা এলাকায়।
Israeli settlers in an army uniform raided my houses yard two times in the last 48 hours, they damaged my free Palestine sign, and other staff, they tried to break in to the house, I refused to open.
— Issa Amro عيسى عمرو 🇵🇸 (@Issaamro) October 16, 2023
Yesterday I was detained and attacked, I am not allowed to leave the house now. pic.twitter.com/9ZzWxQ0JZS
তেল রুমেইদায় ইজরায়েলি সেনাঘাঁটি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইসা আমরো নামে এক স্থানীয়কে। বছর ৪৩-এর আমরোকে গ্রেফতার করেছিল ইজরায়েলি সেনা। তার সঙ্গে ছিল বসতি স্থাপনকারীরাও। সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তাঁর চোখও। তারপর সেনাঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে চলে মারধর। মুখে দেওয়া হয় থুতু। তার সঙ্গেই চলতে থাকে ইজরায়েল সেটলারদের অশ্রাব্য গালিগালাজ। প্রায় ১০ ঘণ্টা পর তাঁকে বাড়িতে ছেড়ে দেয় ইজরায়েল বাহিনী।
এর পরে দিন কতক সেনার পোশাক পরা ইজরায়েলি সেটলাররা তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। এক সময় তো তাঁর বাড়ির চাবিও নিয়ে নিয়েছিল তারা। জোর করে বাড়িতে ঢুকে চালানো হত অত্যাচার। আমরোর অপরাধ শুধু একটাই। তাঁর বাড়ি মিলিটারি জোনের কাছে। শেষমেশ প্রাণে বাঁচতে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি। এইচওয়ান এলাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। হাত-পায়ে জখম এখনও তাঁর সারেনি পুরোপুরি। নিজের ঘর নিজের বাড়ি নিজের এলাকা এখন তাঁর জন্য যেন পরবাস। সেখানে ফিরতে আজও বুক কাঁপে তাঁর।
I was detained and torture today. pic.twitter.com/hwnkGiFgzO
— Issa Amro عيسى عمرو 🇵🇸 (@Issaamro) October 7, 2023
গাজা এবং লেবনিস বর্ডারে যেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা, আর সেনা-অস্ত্রশস্ত্র সঞ্চয় করে রাখছে তারা এইচটুর মতো এলাকা গুলিতে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন ইজরায়েলি বাহিনীর দখলে। দিনে সেনা, রাতে সেটলার, কেউ কারওর থেকে আলাদা নয়। ফিলিস্তিনিদের যে কোনও উপায়ে কোণঠাসা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য তাদের। বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে, জানলা থেকে একেকটা বাড়ির দিকে তাক করে রাখা রয়েছে বন্দুক। কান পাতলেই সেনার গর্জন, বাড়ির ভিতরে থাকতে বলার নির্দেশ। একই সঙ্গে সেনাদের পোশাক পরে ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখাচ্ছে সেটলাররাও। বাড়ির মেয়ে-বউদের শারীরিক নিগ্রহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। চলছে মারধর। বাসিন্দাদের কথায়, কোনও না কোনও অছিলায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য।
গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ গোটা প্যালেস্টাইনে শিশুদের অবস্থা বোধহয় সবচেয়ে খারাপ। স্কুল বন্ধ। বাবা-মার সাহস নেই সন্তানদের রাস্তায় বের করার। শৈশব কাকে বলে জানে না প্যালেস্টাইনের শিশুরা। লজেন্সের মিষ্টি স্বাদ ভুলেছে, হাসতে ভুলেছে, খেলতে ভুলেছে, শ্লেট-পেনসিল-বই- সব ভুলেছে। ভয়াবহ আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে হয় না। অনলাইনে স্কুল চালানোর চেষ্টা চলছে কোথাও কোথাও। কিন্তু ইন্টারনেট পরিষেবার উপরেও রকেট হেনেছে ইজরায়েলি সেনা। মাথায় ঠেকানো বন্দুকের নল। সেই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক কোনও কিছুই কি সম্ভব! পারছে না ফিলিস্তিনি শিশুরা। অসুস্থ হলে ওষুধ বা ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও মিলছে না যেখানে, সেখানে পড়াশোনার স্বপ্নটুকও যেন বিলাসিতা।
আরও পড়ুন: ভাঙা হুইলচেয়ার, কানে আসে না বোমার শব্দ! কেমন আছেন গাজার ৯৩,০০০ বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ?
জাবের এলাকায় এক আসন্নপ্রসবা মহিলার ব্যথা উঠেছিল ভোর পাঁচটা নাগাদ। ইজরায়েলি সেনার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন পরিবারের লোকেরা, যাতে মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু রাস্তায় বেরোনোর সময় হয়নি এখনও, সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। সকাল ১১টায় যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, চিকিৎসকেরা জানান, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছে গর্ভের শিশুটি। এমনটা হওয়াই যেন দস্তুর গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মতো এলাকায়। ঘরে মজুত কমছে, বাইরে যাওয়ার জায়গা নেই। ক্রমে ফুরিয়ে আসছে ওই সব এলাকায় প্রাণবায়ু। গণকবরে ভরে যাচ্ছে দেশ। সকলে যেন সেই পরিণতিরই প্রহর গুনছে প্যালেস্টাইনে।