অভিমন্যু হয়ে নতুন দিনের সূর্য ছিনিয়ে আনবে পড়ুয়ারাই
Bangladesh Quota Protest: রক্তস্নানে হাজারো আবু সাঈদ-তাঈম জেগেছে আজ বাংলার ঘরে ঘরে। আমি তো পড়ুয়াদের আহত বাঘের মতো দেখি। এতদিন ঘাতকেরা ছাত্রদের ঘৃণা দেখেছে, এবার দেখবে ক্রোধ।
কোটা আন্দোলন ইস্যুতে উত্তাল গোটা বাংলাদেশ। রাস্তায় কত পড়ুয়া যে প্রাণ হারিয়েছেন তার হিসেব নেই। যদিও গণমাধ্যমগুলো খণ্ডিতভাবে জানাচ্ছে, এই সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালগুলোতে ঢল নেমেছে আহতদের, বাড়ছে মৃত্যু। আজও গুলিবিদ্ধ দু'জনের মৃত্য হয়েছে হাসপাতালে। পুরো জাতিকে অন্ধকারে রেখে সরকার যে নৃসংশতা চালিয়েছে, তাতে এই সংখ্যাটা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।
পড়ুয়াদের আন্দোলনে বারুদ ঢেলেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিকের উস্কানিতে তিনি আন্দোলনকারীদের 'রাজাকারের নাতি-পুতি' বলে উল্লেখ করেন। এই কটাক্ষ মানতে পারেননি বিক্ষুব্ধ পড়ুয়ারা। ওই রাতেই নামেন রাস্তায়, অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে দেশের সকল ক্যাম্পাস। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে দেশজুড়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি নির্বিচারে গুলি চালায় ছাত্রদের উপর। সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগও নামে হত্যার মিশনে।
গত ১৬ জুলাই রংপুরেরে রাস্তায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। নিমেষেই প্রশস্ত বুক ভেদ করে যায় পুলিশের বুলেট! দূর প্রবাসে বসে সেই ভিডিয়োটি বার বার দেখেছি, আর ভেবেছি— হত্যাকারী পুলিশ সদস্য ইউনুস আলির কি পরিবার-পরিজন নেই? নিজেকে প্রশ্ন করেছি, রাতে বাসায় ফিরে ইউনুস আলি কি ঘুমোতে পেরেছিলেন আদৌ?
আরও পড়ুন: সব যোগাযোগ বন্ধ! বাংলাদেশে আটকে ভারতের পড়ুয়া ফিরতে পারবেন তো?
ওই রাতে ইউনুস আলির ঘুম এসেছিল কি না জানি না, কিন্তু ঘুমোতে পারেননি পুলিশের উর্দি পরা ময়নাল হোসেন। কারণ তিনি হাসপাতালের মর্গে আবিস্কার করেছিলেন তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলে ইমাম হাসান তাঈমের নিথর দেহ। গত ২১ জুলাই পুলিশের ছোড়া ছররাগুলি আবু সাঈদের মতই তাঈমেরও বুক বিদীর্ণ করে দিয়েছে। গুলি তো আর স্বজন চেনে না!
ছেলের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে বড়কর্তাকে ময়নাল জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?' হয়তো একই প্রশ্ন ছিলো শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনেরও। যদিও ইউনুস আলি কিংবা ময়নাল হোসেনদেরই সে প্রশ্নের উত্তর জানা। পিতৃত্বে ময়নাল হোসেনের সঙ্গে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের কোনও ব্যবধান নেই । দু'জনেরই অশ্রুর রং এক, একই আহাজারি। দু'জনের বুকের গভীরে আজ একই শূন্যতা। ব্যবধান কেবলই ওই পুলিশের উর্দিটা। গত এক সপ্তায় ঘটে যাওয়া এমন হাজারো ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যায় এক নিঃশ্বাসে। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, কী ঘটেছে সেখানে। এতো আহাজারি, এতো মৃত্যুশোক বইবে কী করে এ জমিন?
ঘাতকের বুলেটের সামনে আজও জাগ্রত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ ড. সামসুজ্জোহা। তিনি যে মশালটা আবু সাঈদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা শত-সহস্র হাতে উঠেছে। সেই মশাল হাতে পথে নেমেছিলেন কলেজপড়ুয়া তাঈমও। পুলিশ বাবা আগেই জানতেন, শিক্ষার্থীদের দমনে তারা কতটা খড়গহস্ত। তাই তো ছেলেকে আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু উত্তাল তরঙ্গ কি বাঁধ দিয়ে আটকানো যায়? মুক্তির উন্মাদনায় ঠিকই সব বাধা তুচ্ছ করেছিলেন তাঈম। তাই তো আজ তিনি মুক্তবিহঙ্গ!
রক্তস্নানে হাজারো আবু সাঈদ-তাঈম জেগেছে আজ বাংলার ঘরে ঘরে। আমি তো পড়ুয়াদের আহত বাঘের মতো দেখি। এতদিন ঘাতকেরা ছাত্রদের ঘৃণা দেখেছে, এবার দেখবে ক্রোধ। গগনবিদারী স্লোগানে নড়ে গেছে স্বৈরাচারের ভিত, এবার পতনের গান। তারা ফিরবেই, ফিরতেই হবে। নতুন বাংলাদেশে তারাই তো দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা।
রক্তের দাগ কি এত সহজেই মুছে ফেলা যায়? ইন্টারনেট বন্ধ করে, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে কি গণহত্যা আড়াল করা যায়? অবশ্য আন্দোলন দমনে এই কৌশল আওয়ামী লীগের পুরনো। দেশে গত এক যুগের সাংবাদিকতার সুবাদে দেখেছি দলটির ক্রমে দানব হয়ে ওঠা।
আন্দোলনের মোড় ঘোরাতেও পটু দলটি। আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে জামায়াত-বিএনপির লেবেল লাগানো হয়েছে। সমন্বয়কারীদের তুলে গিয়ে করা হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। শরীরে চেতনানাশক পুশ করে অচেতন করে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। কোথাও কোথাও বন্দি করে আন্দোলন স্থগিতের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এত কিছুর পরও দমানো যায়নি শিক্ষার্থীদের। শেষে নিজেরাই শুরু করেছে জ্বালাও-পোড়াও। চট্টগ্রামে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শ্রমিক লীগের সভাপতি দিদারুল আলমের গ্রেফতার সামনে এনেছে অকাট্য প্রমাণ। এই ক'দিনে গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক। কেবল ঢাকাতেই দায়ের হয়েছে দুই শতাধিক মামলা, চলছে গণগ্রেফতার। পুরো দেশটাই এখন জেলখানা!
আরও পড়ুন: একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়! কেন রাস্তায় নামল বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্রযুব?
গদি টিকিয়ে রাখতে শেখ হাসিনা প্রথমেই বসেছেন তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে। এ অভিযোগ অবান্তর নয় যে আওয়ামী লীগের শাসনকালে সব নিয়োগ-পদন্নোতি হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। নানান কৌশলে বিরোধীশূন্য করা হয়েছে, কয়েক জন থেকে গেলেও তাঁরা কোণঠাসা। একাধিক অনিয়ম-দুর্নীতির পরেও কতিপয় কর্তা পার পেয়েছেন শুধুমাত্র সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার দৌলতে। তাঁরাই এখন আন্দোলন দমন করার প্রতিদান দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরাও পাশে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারের। এরাই তো ব্যাঙ্ক লুটে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অর্থপাচার করে বিদেশে গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য। দলীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও নেমেছেন একজোট হয়ে। তাঁরাও তো ফুলে ফেঁপে উঠেছেন গত এক যুগে।
এই লুটেরা জোটের বিরুদ্ধে ছাত্র-পড়ুয়াদের অসম লড়াই চলছে, চলবে। পথে পথে নৃশংস হত্যার ছবি দেখেও কি এখনও দ্বিধাবিভক্ত থাকবেন? জেগে উঠুন, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান। তারুণ্য আজ জেগেছে। আপনি-আমি পাশে দাঁড়ালেই অভিমন্যু হয়ে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে নতুন দিনের সূর্য ছিনিয়ে আনবে এ তারুণ্য।