পেনাল্টি শ্যুটআউটে নাচ! স্নায়ুর লড়াইয়ে কীভাবে এমবাপেদের পিছনে ফেললেন এমি মার্তিনেজ?

FIFA World Cup 2022 : মাঠের প্রবল লড়াইয়ের মধ্যেও তুলে এনেছে অন্য একটি লড়াইয়ের কথা। যে যুদ্ধের নায়ক ডিবু; এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।

মাঠের ভেতর দু’দলের ১১ জন করে মোট ২২ জন খেলোয়াড়। মাঠের বাইরে আরও কয়েকজন খেলোয়াড়; সঙ্গে কোচিং স্টাফ, কোচ এবং হাজার হাজার সমর্থক। রেফারির বাঁশি বাজলে সবার মধ্যেই শুরু হয় ফুটবল যুদ্ধ। মাঠের বাইরের লড়াইটা একরকম। আর ভেতরে? সাইডলাইনের এপার ওপার দু’দিকেই থাকে আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা। মাটি কামড়ে আঁকড়ে লড়ে যাওয়া। ফুটবল, ট্যাকটিক্স, শিল্প, গতি ইত্যাদির পাশেও থাকে আরও একটি জিনিস। মনস্তত্ত্ব। যুদ্ধ চলে সেয়ানে সেয়ানে। শুধু পায়ের লড়াই নয়, এ লড়াই মাথার। বুদ্ধির, মগজাস্ত্রের। সেইসঙ্গে মানসিক লড়াইও।

সেইসব লড়াইয়ের মন্ত্রই তৈরি হয়েছে ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের মঞ্চে। সেই যুদ্ধে কেউ হেসেছেন, কেউ খালি হাতে বসে পড়েছেন মাঠের ওপর। চোখের জল ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছে ফ্লাডলাইটের আলো। ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনালের রাত তেমনই কিছু মুহূর্ত তুলে ধরেছে। মাঠের প্রবল লড়াইয়ের মধ্যেও তুলে এনেছে অন্য একটি লড়াইয়ের কথা। যে যুদ্ধের নায়ক ডিবু; এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।

ফুটবল মানে স্নায়ুর যুদ্ধ। কেবল পায়ের দক্ষতা নয়, প্রতিপক্ষকে মেপে নিয়ে তাঁকে চেপে ধরা, নতি স্বীকারে বাধ্য করা। ফাইনালের পেনাল্টি শ্যুট আউটে ঠিক তেমনটাই নাকি করেছেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক। অবশ্য কেবল ফাইনালের চূড়ান্ত মুহূর্ত নয়, এর আগেও এমন মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলেছেন তিনি। আসল খেলার আগে স্নায়ুর যুদ্ধেই প্রতিপক্ষকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন তিনি। সেই লড়াই জিততে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছিলেন মার্তিনেজ। পরে বিভিন্ন বিতর্কের সম্মুখীন হলেও সেই মনস্তত্ত্বের দ্বন্দ্বকে কুর্নিশ জানিয়েছে বিশ্ব।

ফাইনালের টাই ব্রেকারের চরম মুহূর্তে কীভাবে প্রতিপক্ষকে কাবু করলেন এমি মার্তিনেজ? তা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন নরওয়ে স্কুল অফ স্পোর্টস সায়েন্সেসের অধ্যাপক ও মনস্তত্ত্ববিদ গের জরডেট। ফাইনালের শ্যুট আউটের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তিনি মার্তিনেজের মানসিক যুদ্ধকে সামনে আনেন। যা দেখে সত্যিই চমকে যেতে হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে জরডেট ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করেছেন সবটা। তাঁর দাবি, পেনাল্টি শ্যুট আউটের একেবারে প্রথম ধাপ থেকেই নিজের ‘খেল’ শুরু করেন এমি মার্তিনেজ। খেয়াল করুন টসের কথা। টাই ব্রেকারের টস হওয়ার আগেই পেনাল্টি বক্সে ঢুকে যান মার্তিনেজ। অপেক্ষা করতে থাকেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক হুগো লরিসের জন্য। যেন লুসাইল স্টেডিয়ামের ওই গোলপোস্ট তাঁর ঘরবাড়ি। আর লরিস সেখানে অতিথি। তাঁকে নিজের ‘ঘরে’ স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন ডিবু। সেইসঙ্গে লরিস পেনাল্টি বক্সে ঢোকার পর তাঁর সঙ্গে হাতও মেলান। বাড়িতে অতিথি এলে যেমন করে স্বাগত জানানো হয়। মনে হতেই পারে, এটা তো নিছকই সৌজন্য। কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে আছে মনস্তত্ত্বের যুদ্ধ। ‘আমার ঘরে আমিই রাজা, যারা আসবে তারা সব অতিথি’ – পেনাল্টি শুরুর সময় থেকেই মার্তিনেজের হাবভাব ছিল এমনই।

এরপর শুরু হয় আসল খেলা। খেয়াল করে দেখবেন, ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা যতবার পেনাল্টি মারতে গিয়েছেন, বল ঠিক জায়গায় বসাচ্ছেন, মার্তিনেজ সামনে এগিয়ে এসেছেন। বারবার কথা বলে ফোকাস নষ্ট করার চেষ্টা। রেফারিকে প্রতিবার জিজ্ঞেস করা, ‘বলটা ঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে তো?’ রেফারিও দেখে নিয়ে থাম্বস আপ দেখান। কেবল প্রতিপক্ষের ফোকাস নষ্টই নয়, মাঠে তিনিই যে রাজত্ব করতে এসেছেন ঠারে ঠারে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। পেনাল্টি বক্স, গোলপোস্টের নিচে আসল রাজা যে তিনিই, সেটাই কথায়, হাবেভাবে বারবার বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন এমি মার্তিনেজ। প্রথমে এমবাপে, তারপর কোম্যান, চুয়ামেনি, কোলো মুয়ানি… প্রতিবার এগিয়ে গিয়ে বল ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করছিলেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক। একসময় হলুদ কার্ড দেখলেও টলে যাননি তিনি।

এমি মার্তিনেজের আরও একটি বৈশিষ্ট্য তাঁর সেলিব্রেশন। মনে রাখবেন, ১৮ ডিসেম্বর কোনও চ্যারিটি ম্যাচ বা গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ ছিল না। বিশ্বকাপ ফাইনাল, তার ওপর টাই ব্রেকার। পাহাড়প্রমাণ চাপের সামনে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়রা। সেখানে কোম্যানের শটটি সেভ করার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন ডিবু। লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার, তারপর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের আরও উৎসাহিত করা। সাধারণত পেনাল্টি শ্যুট আউটের সময় গোলরক্ষকদের এই কাজটি করতে দেখা যায় না। কিন্তু কেবল ফাইনাল নয়, মার্তিনেজ এই কাজটি বহুবার করেছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধেও ছিল একই ছবি। আবার ফ্রান্সের চুয়ামেনি শট মিস করার পর মার্তিনেজের ‘ব্রেক ডান্স’ও নজর কেড়ে নেয়। তখনও ফাইনাল জেতা হয়নি।

অন্যদিকে চুয়ামেনির শটের সময় নিজের হাতে বল নিয়ে নেন এমি মার্তিনেজ। তারপর বল হাতেই দর্শকদের আরও চিৎকার করার কথা বলেন। ততক্ষণে রেফারি আর চুয়ামেনি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। তারপর বলটি আলগোছে অন্য দিকে ছুঁড়ে দেন। চুয়ামেনি সেটি নিয়ে আসেন। এইভাবেই প্রতিপক্ষের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন মার্তিনেজ। সেই পদ্ধতিতে তিনি যে সফল, চুয়ামেনির ব্যর্থ শটেই তার প্রমাণ মেলে।

এরপর যেটা করলেন, সেটাও সেই মনস্তত্ত্বের অঙ্গ। প্রতিপক্ষকে পড়ে নেওয়ার স্বভাব। চুয়ামেনির শটটি মিস হওয়ার পর ব্রেক ডান্স, তারপর বলটি নিয়ে পারাদেসের হাতে দেন এমি। তিনি জানতেন, হয়তো লরিসও তাঁর এই পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। পারাদেসকে বিপদে ফেলতে পারেন। তাই আগেভাগে বলতি হাতে নিয়ে সতীর্থের দিকে এগিয়ে যান তিনি। চোখে চোখ রেখে লড়াই করার শরীরী ভঙ্গি জানাতে থাকেন প্রতিবার। ফাইনালই নয়, ক্লাব ফুটবল থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ – সব জায়গায় এমন বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন এমি মার্তিনেজ। ফুটবল যে কেবল পায়ের যুদ্ধ নয়, স্নায়ুর লড়াইও বটে, সেটাই যেন বারবার প্রমাণ করেন তিনি।

More Articles