বরবিলের সেই রাত আর ‘অমিতাক্ষর’ ছন্দ

Lessons of Life: সে রাতে বাবা খেল না। অদ্ভুত আহত চোখ করে আমাদের ময়দানের মতো চওড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে গেল।

রাতের নিশ্চিত ভাবেই একটা আলাদা কোড অফ কন্ডাক্ট থাকে, যে ওরা কীভাবে পরত খুলবে। অন্তত বরবিলে যে রাতেরা আসত (নাকি আসতেন? কে জানে বাবা কী বলে সম্বোধন করব!), তাদের যে ওই ভিন্ন কোড অফ কন্ডাক্ট ছিল, তা আমার খুব জানা। না মানে, এই যে প্রায় সমস্ত বিপদ বা মাথায় বাজ ভেঙে পড়া ঠিক অন্ধকার না হলে আসে না, এটার কথা শুধু বলছি না। এই যে এখন লিখছি এই ধারাবাহিক, যেই না স্মরণের খাতা খুলছি, অধিকাংশ একেবারে যাকে বলে ডার্ক ম্যাটার বেরোচ্ছে গাদাগাদা। ফরসা যেগুলো আসছে সামনে, সেগুলো অনেকটা ওই অনুষ্ঠান-মাঝে বিজ্ঞাপন বিরতিসুলভ।

জানি না, তবে সবার মতোই প্রকৃতিও বোধ হয় চায় (নাকি চান?!) ড্র্যামাটিক যখন কিছু একটা ঘটবেই, আবহটাও যেন যুৎসই হয়। এই যেমন দৃপ্ত কোনও ওয়েস্টার্ন সিম্ফনির মতো তারাভরা আকাশ (এমনই যে স্বয়ং ডেভিড গাওয়ার বা সৌরভ-ও ফুল ফর্মে অফ সাইডে গ্যাপ খুঁজে পেতেন না!), দূরের পাহাড়ে ছোট টিপের মতো ইতিউতি পেরিয়ে যাওয়া গাড়ির আলো, রেললাইনের ধারে দম চেপে, কান পেতে থাকা ডাঁই হওয়া আয়রন বা অ্যালুমিনিয়াম ওর, হাওয়া দিক বা না-দিক ঠিক দুলে দুলে মহাজাগতিক কোনও প্রেরণাকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া বুনো নয়নতারা, পুকুরে কেউ না থাকা সত্ত্বেও গোল গোল করে ডাঙার দিকে ছড়িয়ে পড়া জলের অনুরণন আর আমাদের পাশের ওই নিম গাছটায় বাসা বাঁধা কোনও রাতচরা পাখির একই সাথে উদাস ও উদ্যোগী ডাক থামিয়ে মৃদু ইন্টারভ্যাল, যে কই! যা হওয়ার তা কি ইতিমধ্যেই ওভার?

এমন করে ওৎ পেতে থাকা রাতেই বরবিলে হয়ে যেত অল্প খিটিরপিটির, দু’দান মহাকাব্যিক, মোহান্তি জেঠুর ছেলের দূরের এক হাইওয়েতে বাইক অ্যাক্সিডেন্টের পর বহুক্ষণ কাতরে পড়ে থেকে অবশেষে শূন্য হয়ে যাওয়ার বাড়ি বয়ে আসা খবর বা ইস্টবেঙ্গলকে নোয়ামুণ্ডির মাঠে খেলে আসতে দেখে বাড়ি ফিরে বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম গিটার। এমন করেই… রাত, বরবিল, বরবিল, রাত, আমি, মা, বাবা, রাত, বরবিল…

আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল

এমন কিছু মধ্যেই এক দিন, সরি রাতে, দেখেছিলাম বাবাকে অসম্ভব উত্তেজিত হতে। যাকে বলে রগচটা, বাবা আদপেই তা ছিল না। কিন্তু রেগে গেলে সাংঘাতিক হত। ওই অল্প কিছুক্ষণের জন্যেই, তবুও সাংঘাতিক। মুখটা লাল হয়ে যেত, আবার পরক্ষণেই মনভোলানো সেই হাসিটা। দেখলেন হয়তো চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করছে বা সাগর সেনের মতো। কিন্তু সেই রাতে মনে আছে মুখের লাল আর কমছেই না। মা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছে, সব বিফলে। সে রাতে বাবা খেল না। অদ্ভুত আহত চোখ করে আমাদের ময়দানের মতো চওড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে গেল। আহত কেন, আমি বুঝিনি তখন। আমার তখন ৮/৯। আসলে তার কিছুক্ষণ আগে আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডে একটা গাড়ি এসেছিল আর গাড়ি আসার মিনিট দু'য়েক আগে একটা ফোন।

ওই ফোনটা করেছিল কোনও এক আগরওয়াল বলে ভদ্রলোক। তাঁর নাম ইতিউতি আমিও শুনেছি, ওই বাবাদের কোম্পানির সঙ্গে কোনও একটা কাজের সূত্রে। তো ফোনটা এল, আর বাবার মুখভঙ্গী বদলে যেতে লাগল, মনে আছে। দু’মিনিটের মধ্যেই সেই গাড়ির আগমন। এবং গাড়ি থেকে নেমে ওই আগরওয়ালের এক সহযোগী হাসি মুখে বাবার দিকে এগিয়ে এলেন। আসা মাত্রই বাবা তাঁকে প্রথমে শান্ত ভাবে চলে যেতে বলল। তিনি আরও কিছুটা এগিয়ে আসলে পরে, বাবা গলা চড়াল। তাতে সেই ভদ্রলোক তেমন না দমে আরও এগিয়ে এলেন যেই, বাবা ফেটে পড়ল। মা ততক্ষণে ছুটে গিয়ে বাবাকে সামলাচ্ছে আর আমিও জানলা গিয়ে উঁকি মারছি, যে কী এমন রয়েছে ওই গাড়িতে যে বাবা নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না?

What is the difference between gift and bribe how Barbil tought that lessions on that starry night by Anirban Bhattacharya Choto Town Proper Noun Robibarer Royak

দেখেছিলাম আমি সেই বস্তুটির এক ঝলক, আর আমার চোখে নেমে এসেছিল ওই তারাভরা আকাশ। তখন ‘আটারি’ বলে একটা কোম্পানির টিভি’র বিজ্ঞাপন আমার অসম্ভব ভাল লাগত। আর আমাদের বাড়িতে তো ছিল কোনার্ক-এর একটা শাটার দেওয়া টিভি, ওই যেটার মধ্যে মাঝেমাঝে একটা টিকটিকি দিন কাটাত, শাটার খুললেই তড়াক বহির্বিশ্বে। এনিওয়ে। তো গাড়ির মধ্যে আটারি টিভি, আবার ওই সহযোগী ভদ্রলোকের কথায় শুনেছি, ওটি কালার টিভি, কোনও শাটার নেই, ওপরে টিকির মতো বেরিয়ে থাকা আরও সব কী যেন! এবং ওটি আগরওয়াল বলে ভদ্রলোক (আমি অবশ্য মনে মনে তখন তাঁকে আঙ্কল ডাকছি!) আমাদের জন্যে বিশেষ ভাবে পাঠিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘অমিতজি, এক বার দেখ তো লিজিয়ে, প্যাকিং ইঁয়েহি পে খুলওয়াতে হুঁ…’ (আমার বাবার নাম অমিত। কিন্তু বাবা রাগে উন্মাদ? সমান্তরাল দুটো ঘটনা ঘটছে কিন্তু। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার তাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা আর দরজার ঠিক পাশে জানলার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে আমার দেখা, হাতে পাওয়া চাঁদ কেমন করে অস্ত যায়! আমার তখন বাবা’র ওপর রাগ হচ্ছে, বা ওটা হয়তো রাগ নয়, চরম অভিমান। আর সব যখন চুকেবুকে গেছে আর বাবা সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে, আমি সেই অভিমানে ভর করেই বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াইনি। নিজেই শুতে চলে গিয়েছিলাম। খুব মন খারাপ হয়েছিল, হয়তো চোখে জলও, এখন আর মনে নেই! ঘরে একটা কী অপূর্ব কালার টিভি আসছিল, ওতে ‘চিত্রহার’-এর গান আলবাৎ আরও বেশি ক্ষণ শোনাত, ওতে রবিবার সকালের ‘হি-ম্যান’ নিশ্চিত আরও আমার কাছে চলে আসত, ওতে ‘সুনিল গাভাস্কার প্রেজেন্ট্স’-এ গাভাস্কার একমাত্র আমাকেই হাত ধরে বুঝিয়ে দিত নির্ঘাৎ ভি-গ্রিপটা কী ভাবে ধরব বা হাই এলবো না হলে কোন বিপদটা হবে…তা-ও হতে দিল না বাবা।

রাতে ঘুমের মধ্যে বুঝেছিলাম, বাবা আমার চুলে বিলি কেটে দিয়েছিল আর অনেক দূর থেকে শুনেছিলাম, মা-বাবা প্রায় ভোর অবধি কথা বলে গিয়েছিল। বুঝতে পারিনি কী। পরের দিন সকালে, ৭-টায় স্কুল চলে গেলাম, বাবাকে বলে গিয়েছিলাম বলে তো মনে পরে না। মা ডিসিপ্লিন করেছিল, বাবা মুচকি হেসে মা-কে ইশারা করেছিল, ইট ইজ অলরাইট। দিন দুই পর, কোথায় যেন আমাদের একটা এমনিই যাওয়া ছিল। তখন, মানে মাঝ আশি বা নব্বইয়ের শুরুর দিকে এগুলো খুব হত। নেমন্তন্ন ছাড়াই আমরা সন্ধেবেলায় বন্ধু-পরিচিতদের বাড়ি যেতাম আর তাঁরাও আসতেন। বড়দের গল্পগুজব, ছোটোদের দৌড়োদৌড়ি খেলা বা ‘বিজনেস’বলে একটা বোর্ড গেম আর ঘুগনি-টুগনি ইত্যাদি। তো সে রকমই একটা বাড়ি থেকে ফিরছি আমরা, ওই যে পাহাড়টা আমাদের বারান্দা থেকে জেগে থাকতে দেখা যেত— ঠাকুরানির পাহাড়, আমরা তখন সেখান দিয়ে উল্টোপথে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাবা একটা অদ্ভুত কাজ করল। আমাদের গাড়ির চালক, আহমেদ দাদাকে ওই পাহাড়ের এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। মা অবাক, আহমেদ দাদা তো বটেই। খামখা রাতের বেলায় এখানে দাঁড়াবেই বা কেন? বাবার ওসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমায় গাড়ির পেছন থেকে নামতে বলে, পেঁচিয়ে যাওয়া রাস্তার ধারে এসে দাঁড়াল। আমি একটু ভয়ে ভয়েই গেলাম। বাবা আমায় দূরে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, বল তো ওদিকে কী? দূরে বরবিল, জানি আমি। বাবা আরও স্পেসিফিক ভাবে বলল, প্লাস-মাইনাস দু’তিন হাত, আমাদের বাড়িটা ওই দূরে। মা ততক্ষণে নেমে এসেছে আমাদের কাছে। বাবা ওদিকটা দেখিয়ে বলেছিল…

বাবা - দেখ, আগরওয়াল আঙ্কল সেদিন আমাকে ‘ভেট’ হিসেবে একটা খুব সুন্দর টিভি পাঠিয়েছিল।

আমি – আমাদের টিভিটায় কেমন লাইন লাইন আসে আর ভেতরে টিকটিকি থাকে…

বাবা – (হেসে) ভেট মানে কী বল তো?

আমি – গিফ্ট। গিফ্ট কেউ ফেরায়?

বাবা – কিন্তু সে গিফ্ট যদি কেউ না-ভালোবেসে দেয়?

আমি – না-ভালোবেসে গিফ্ট, সেটা কী?

বাবা – যেটা কাউকে কখনও করতে নেই মন্টা।

এর পর-ও কিছু কথা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু বহু দিন পর বুঝেছি, বাবা সে রাতে কেন বলেছিল, ‘যেটা কাউকে কখনও “করতে” নেই। না ভালোবেসে কাউকে গিফ্ট দিতে নেই নয়, করতে নেই।

অপমান।

করতে নেই অন্যকে, ছোট।

আরও পড়ুন:ক্রিসমাস কেক ও থলকাবাদের বাঘ

কী জানি ওভাবে, এক প্রকার নিজের (বাড়ি) থেকে দূরে বেরিয়ে পড়ে যে ছেলেকে বাবা ঘুষের গূঢ় অর্থ বোঝায়, বোঝায় আত্মসম্মানের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ, সে ছেলে কতটা পথ পেরোলে ‘অমিতাক্ষর’ ছন্দে ফাইনালি বিলীন হতে পারে!

More Articles