কোথাও গরু, কোথাও করোটি! পূর্বজদের উদ্দেশ্যে বিচিত্র তর্পণের রেওয়াজ রয়েছে বিদেশেও

Death Festivals: অসমে মরেও সুখ। অন্তত খানা ও পিনা নিয়ে বিশেষ ভাবনা চিন্তা করতে হয় না অহম ধর্মীয় গোষ্ঠীর পূর্বজদের।

এ বিশ্বে কিছুই নিশ্চিত নয়, এই জাতীয় গুরুগম্ভীর কথার উপর বসে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। বসে আছেন, আর এই চার আনার জীবনের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলছেন, এ বিশ্বে কেবল দুইখানা বস্তুই নিশ্চিত। মৃত্যু এবং ট্যাক্স! উদাস গলায় না বললেও পারতেন। অন্তত ট্যাক্স বিষয়ে যথেষ্ট উদাস হওয়ার থাকলেও মৃত্যু বিষয়ে উদাস হওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি। আসলে মৃত্যু নিয়ে যতখানি ভয় ও আশঙ্কা বেঁচে থাকতে মানুষ করে ততখানি মরে গেলে করার মতো অবকাশ বা সুযোগ থাকে না। হয়তো করার মতো কারণও থাকে না। মরণ এক উদযাপনের নাম। শুধু এ ভারতে নয়, বিশ্ব জুড়েই। বছর বছর মৃত মানুষদের নিয়ে উদযাপন আসলে এক বিরাট উৎসবই। এই যে মহালয়া, অভ্যাসের রেডিওতে ভেসে আসে “তোমায় হারা জীবন মম, তোমারই আলোয় নিরুপম”, কতজনের ফেলে যাওয়া আলো কুড়িয়ে যে আমরা হাঁটছি গন্তব্যহীন সড়কে, ইয়ত্তা নেই। দেহটুকু নেই, আলোটুকু আছে। আলো নাকি দেহ বদলে বদলে ছদ্মবেশ ধরে এসে উত্তরসূরির বারান্দায় বসে। অথবা নদীর পাড়ে, স্রোতের পাড়ে। গোল্লা করে চটকানো পিণ্ডি মুখে উড়ে যায় স্মৃতির বায়স। নিরুপম কাশের বন, ভোরবেলার দামোদর বা গঙ্গা বা অজয় বা নাম না জানা নদী, পুকুরের পাড়ে এই যে গুনগুন মন্ত্রোচ্চারণ, এই যে পূর্বজদের উদ্দেশে হাত থেকে গলে পড়া জল, এতে শোক নেই। আছে বলতে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার এক ছিমছাম আয়োজন। কোথাও ছিমছাম, কোথাও বা উল্লাস। তর্পণের রকমফের সারা বিশ্বজুড়ে নানা জাতি, উপজাতির সংস্কৃতিতে বহমান। পূর্বজদের স্মরণে কত আয়োজন, কত উৎসব! জন্মিলে যখন মরিতেই হইবে তখন ঘটা করে মরাই ভালো। বছর বছর মরণের এক কার্নিভাল আয়োজন তাই নতুন কিছুই নয়। এবং, মোটামুটিভাবে এই আয়োজনগুলো একই সময় আয়োজিত হয় অধিকাংশই।

বিচিত্র সব আয়োজন। কোথাও কোথাও আয়োজনের ঘটা এতই বেশি যে তাতে পূর্বজদের হাড়-করোটি ঝিনঝিনিয়ে যাওয়ার দশাও প্রায়। পশ্চিম ভারতে পূর্বজদের দুধ দিয়ে স্নান করানোর প্রথা আছে। মৃত্যুবার্ষিকীতে শুধু নয়, শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাসের মধ্যে নানা তিথিতে গুজরাতে পালিয়া স্মৃতিপ্রস্তরখণ্ডগুলো দুধে স্নাত হয়ে সিঁদুর কুমকুম মেখে বসে থাকে। কেউ কেউ অত্যুৎসাহী আত্মীয়, তারা স্মৃতির মাথায় পতাকা গুঁজে দেন। হাওয়ায় পতপত শব্দ তুলে মৃত স্বজনের স্মৃতি দুলে ওঠে, কেঁপে ওঠে। কেউ কেউ রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন। তবে অসমে মরেও সুখ। অন্তত খানা ও পিনা নিয়ে বিশেষ ভাবনা চিন্তা করতে হয় না অহম ধর্মীয় গোষ্ঠীর পূর্বজদের। তাঁদের বিশ্বাসে ‘দাম’ বা মৃতের আত্মা চোদ্দ প্রজন্ম পরে ঈশ্বর বা ‘ফি’ হয়ে যায়। রীতি অনুযায়ী অনেকেই পূর্বজদের শ্রদ্ধা জানাতে রান্নাঘরের উত্তর পূর্ব দিকে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন, যার নাম ‘দাম খুটা’। সেখানে পূর্বজদের উদ্দেশে বাড়িতে তৈরি ওয়াইন থেকে শুরু করে ভাত, মাছ, মাংস, প্রসাদ সকলই থালা ভরে থাকে। সাধারণত ৩১ জানুয়ারি অহম জনগোষ্ঠীর মানুষ মৃত স্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই আয়োজন করে থাকেন।

আরও পড়ুন- নেই দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক, মহালয়াতেই কেন তবে পিতৃতর্পণের ঢল

তবে অহম লোকজন এমন শান্তশিষ্ট বলেই মৃত স্বজনদের বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিছু কিছু জাতির স্মৃতিচারণে পূর্বজদের মানে মৃতদের রেগে যাওয়ারই কথা। যেমন বলিভিয়ার তর্পণ! সে এক সাংঘাতিক হইচই ফেলা কাণ্ড। মৃত স্বজনের কবর থেকে করোটিটুকু শুধু খুলে নিয়ে আসা হয়। এনে সেই হাস্যমুখ খুলি ভরা হয় একটা কাঁচের বাক্সে। বাক্সের মধ্যে ফুল, সুগন্ধের মধ্যে স্থাপিত স্মৃতির খুলি নিয়ে আয়মারা গোষ্ঠীর মানুষজন ভিড় করেন প্রার্থনাস্থলে। খাদ্য ও পানীয় দুই করোটির উদ্দেশ্যে অর্পিত হয় নভেম্বরের এক বিশেষ দিনে। পূর্বজদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয় এতকাল ধরে তাঁদের ছায়া অটুট রাখার জন্য। তবে মুণ্ডু গেলে খাবেনই বা কী আশীর্বাদই বা কী করবেন এ কথা জানেন কেবল উঠে আসা স্মৃতিভাণ্ড, কোথাও করোটি, কোথাও যার ডাকনাম শিকড়।

তবে মৃত পূর্বজদের স্মরণে এগিয়ে রয়েছে মেক্সিকো। পিছিয়ে নেই গোটা লাতিন আমেরিকাও। পয়লা এবং দোসরা নভেম্বর  Día de los Angelitos আর Día de Muertos পালন করা হয়। চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় মিনি করোটি। গুয়েতামালায় ওড়ানো হয় বিশাল সব ঘুড়ি। অনুষ্ঠানের নাম 'ব্যারিলেত'। মানুষের বিশ্বাস, মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম এই সব দৈত্যাকার ঘুড়িরা। পয়লা নভেম্বর আয়োজন হয় এই এল ফেস্টিভ্যাল দে ব্যারিলেতস জায়ান্টিস।

জার্মানি বরাবর কঠোর দৃঢ়, নিয়ম আর অনুশাসনের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্তে। মরার বেলাতেও অত জাঁকজমক মোটেও পছন্দ নয় তাদের। জার্মানের প্রোটেস্ট্যান্টরা সেখানে পালন করে মৃতের রোববার। অনেকে অবশ্য নীরব দিন নামেও ডেকে থাকেন। স্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গান বাজানো বা নাচ করার মতো হুজ্জুতি সেখানে একেবারেই বারণ।

হিন্দুদের নিয়মে স্বর্গে ১ দিন আর পৃথিবীতে ৩৬৫ দিন সমান হলেও কম্বোডিয়ার স্বর্গে এমন সংবিধান নেই। টানা পনেরো দিন ধরে সেখানে পূর্বজদের স্মরণে পালিত হয় বিশেষ প্রথা। চোদ্দ দিন ধরে চলে কান-বেন বা স্মৃতিচারণ, আর পনেরো নম্বর দিনে বা চুম-বেনের সময় সারা কম্বোডিয়া জুড়ে মৃত আত্মীয়দের আত্মার উদ্দেশ্যে খাবার অর্ঘ্য নিবেদন।

চিনে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পালিত হয় কুইংমিং বা পূর্বজদের দিন। কবরস্থান ঝাড়াই পোঁছাই চলে লম্বা সময় জুড়ে, আর নানা ধরনের ডাম্পলিং তৈরি হয় পূর্বজদের নিবেদনের উদ্দেশ্যে। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হল ঘুড়ি ওড়ানো। যাতে আকাশ থেকে আমাদের (মানে চিন দেশের মানুষদের আর কী) ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষরা দেখতে পান তাই বিশাল সব ঘুড়ি ওড়ানো হয় এই দিনে। সেই সব ভোকাট্টা ঘুড়ি আমাদের পূর্বজরা কুড়িয়ে নেন কী না, স্বর্গের ছাদে লাটাই ধরা নিয়ে চোটপাট হয় কী না সেই গল্প চিনের রূপকথারা জানতেও পারে।

কোরিয়ান তর্পণের সময়ও আবার এই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদই। তবে শুধুই পূর্বজদের স্মরণ নয়। কোরিয়ার এই উৎসবে স্মৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি। সু-আবাদের আনন্দফসলে যেন ছেড়ে যাওয়া মানুষদের ঘ্রাণ। কৃষির মাসগুলো পার করে তাই তিন দিন ধরে চলে নাচ আর খাওয়া দাওয়া এবং ভালো আবাদের জন্য পূর্বজদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন। চালের পিঠে সংপ্যেয়ন দিয়েই আপ্যায়ন করা হয় স্মৃতিধারকদের।

জাপানের ওবন উৎসবের পিছনে আবার লুকিয়ে রয়েছে বৌদ্ধ সূত্র। বলা হয়, গৌতম বুদ্ধের এক অনুগামী তার মায়ের মৃত্যুর পর বুঝতে পারেন যে মা ক্ষুধার্ত আত্মালোকে খিদে আর তেষ্টায় ছটফট করছেন। এই শিষ্য যখন মায়ের খিদে মেটাতে এক বাটি ভাত নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হন, দাউদাউ করে সেই বাটিতে আগুন ধরে যায়। গৌতম বুদ্ধ তখন শিষ্যকে নির্দেশ দেন ওই বাটি ভর্তি আগুন নিভিয়ে প্রতি সপ্তম চন্দ্রমাসের পঞ্চদশতম দিনে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অর্ঘ্য দিতে। এই একটিমাত্র পথেই তাঁর মায়ের আত্মা খিদের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে পারেন। জাপানে ১৩ থেকে ১৫ অগাস্ট, তিনদিন ধরে এই ওবন উৎসব পালিত হয়। আগুন জ্বালিয়ে, বাতাসে হাউই উড়িয়ে পূর্বজদের আত্মাদের বাড়ির পথ চেনানো হয়। বিভিন্ন জায়গায় লোকনৃত্য বন ওডোরির আয়োজন করা হয় মৃত্যুর এই উৎসব পালনে। তারপর মৃতের সঙ্গে যাপন সাঙ্গ হলে শেষ দিনে আবারও আগুন জ্বেলে, আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে সেই আত্মাদের বিদায় জানানো হয়।

আরও পড়ুন- আজও মহালয়ার ভোর মানেই রেডিও! আকাশবাণী থেকে এফএম, অব্যাহত নস্টালজিয়া

খানিক এমনই উৎসব পালিত হয় চিনেও, নামই ভূত উৎসব বা ঘোস্ট ফেস্টিভাল। অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই আয়োজিত হয় চৈনিক এই তর্পণ। বিশ্বাস অনুযায়ী, সপ্তম চন্দ্রমাসের পনেরো নম্বর দিনেই জীবন আর মরণের সীমারেখা সবচেয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে। একইভাবে আগুন জ্বালিয়ে আকাশপ্রদীপ উড়িয়ে আকাশ থেকে নিজ গৃহের পথ চিনিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় পূর্বজদের।

নেপালের মানুষজনের সঙ্গে তাঁদের পূর্বজদের স্মৃতিচারণের সম্পর্ক আবার পালিত হয় টানা আট দিন ধরে। আট দিনব্যাপী এই কার্নিভালের নাম গাই যাত্রা। বলা বাহুল্য, এই উৎসবে গরুর ভূমিকা আত্মীয়দের থেকেও জোরালো। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, কেউ মারা গেলে তাঁর নিরাকার আত্মাকে নাকি গরুই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সেই কারণেই নেওয়ার গোষ্ঠীর মানুষরা স্বজন বিয়োগের পর সাধারণত এই অগাস্ট সেপ্টেম্বর নাগাদই গাই যাত্রায় একটি গরুকে সাজিয়ে গুছিয়ে পথে হাঁটান। এক্ষেত্রেও লোকবিশ্বাস খানিক একইপ্রকার। একটি বিশেষ দিনেই নাকি মৃতদের আত্মাকে আপন করে নিতে খুলে যায় স্বর্গের দুয়ার। যদি মৃতের স্বজনরা এই গাইযাত্রায় গ্রাম-শহরের পথে পথে হাঁটেন তাহলে তাঁদের প্রিয়জনের আত্মা সেই অলীক দরজা অবধি সহজেই পৌঁছে যায়, পার হয়ে যায় বৈতরণী। তবে বাজেট বালাই। মৃত প্রিয়জনের জন্য গরু জোগাড় করা তো পকেটবান্ধব নয় মোটেও। কিন্তু দরজা খোলার সেই অমোঘ হাতছানি আমাদের স্মৃতিদের তাড়িয়ে বেড়ায় আনাচে কানাচে। গরু নেই তো কী আছে, ঘরের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সদস্যকেই গরুর সাজে সাজিয়ে এই শোভাযাত্রায় হাঁটানোর বিকল্প রীতিও তো আছে।

জীবনের হাজিরা খাতায় যাদের রোজ দাগ পড়তে থাকে, একদিন সকলেই ড্রপ আউট হয়ে অভ্যাসের দেওয়ালে ছবি হয়ে ধুলো-ঝুল মেখে জেগে থাকেন। তবু, আমাদের এমন নাছোড়বান্দা স্মৃতি, তাদের কিছুতেই যেতে দিই না। রোজ রোজ যারা মনে পড়ে, একদিন ঘটা করে আয়োজন করে তাঁদেরই তো মনে পড়াই ফের। তর্পণে হোক বা ওবনে, গাই যাত্রায় হোক বা কুইংমিংয়ে, সুর তো একটাই। যেতে নাহি দিব। কিছুতেই যেতে নাহি দিব। স্মৃতি অ্যালবামে হোক, মগজে হোক, সাদা কালো ছবিতে হোক, মানিব্যাগের কোণায় ঘষটে যাওয়া ছবিতে হোক ধরে রেখে দেব। তারপর একদিন পেয়ালা সাজিয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, আঁজলা ভরে নদীর জল ধরতে চেয়ে সকলেই বুঝব ধরা তো যায় না কিছুই। নিজেরই মুঠোর ফাঁক গলে নিজেরই স্বজন-স্মৃতি ভেসে যাবে। একটা টলমলে ভেলায় কত পুরনো দুপুর, বাজখাঁই ঝগড়া, নিরীহ শ্রদ্ধা, এলোমেলো সব দেরাজ-তোরঙ্গ ফাঁকা করা বায়ু জমা হয়ে এগিয়ে যাবে। শোক কই! এ তো স্রোতে ভাসার উল্লাস। জন্মের উৎসব আর মরণের উদযাপনের মাঝে যেটুকু স্থান সেখানেই আমাদের অনিশ্চিত যাপন। কেবল ট্যাক্স আর মৃত্যু বাদ দিয়ে যেখানে অনিবার্য কিছুই না।

 

তথ্যসূত্রঃ

  • Obon : The festival of the dead By Terry Watada
  • Barrilete : A kite for the day of the dead By Claudia M Lee & Elisa Amado
  • Documentaries & Articles of National Geographic
  • Remembering the dead around the World : Anita Ganeri
  • Day of the Dead in Mexico By Mary J Andrade

More Articles