পথ বেঁধে দিল...
জীবন আসলেই এমন। কাঠবেড়ালির এদিক ওদিক টান। তাকে ধরা যাবে না, কিন্তু সর্বনাশী টানবেই।
যা কিছু কার্যকারণ যুক্তির পৃথিবী থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে পয়লা নাম ঘুড়ি। সে ঘুড়ি যে ওড়ায়, তাকে কেউ বোঝাতে পারবে না, যে সময় শ্রম মন সে বিনিয়োগ করছে, তার বিনিময়ে কিছুই ফেরত পাওয়া যাবে না। জিতে ফেরা নেই। আছে হারানোর ভয়। যে আকাশে একটা চাপরাশ বা বলমার বেড়ে বসে আছে, সে কিছু ফেরত চাইছে বলে এ কাজ করছে, এমনটা নয়। অহেতুকেই তার আনন্দ। এই অকারণের সুখের জন্যে সে জীবন বাজি লাগাতে পারে। কার্ণিশ ঘেঁষে মুখপোড়ার দিকে চেয়ে আছে আরেক মুখপোড়া, বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো। পায়ে পেরেক ফুটে যাবে, ফুটুক। গাছে আটকানো ঘুড়ি নামাতে গিয়ে পড়ে পা ভাঙবে, লেংচে বাড়ি ফিরে চুনহলুদ আর তিরস্কারের মধ্যে বৈরাগ্যভাব আসবে মনে, কিন্তু ঘুড়ির পিছনে দৌড় থামবে না। এইসব অহেতুক অনেকটা প্রেমে পড়ার মতো। না পড়লেও চলে। না পড়লেই ভালো, মেলা কাজ, ডেডলাইন। মনকে বলো, না। তারই মাঝে কে যেন ধপাস! হাতি কাদায়, কেউ তুলতে পারবে না, হাতি নিজেও না। সর্বস্ব চলে যাবে দেখতে দেখতে। ভাবলে দেখা যাবে নিয়মে বাঁচা মানুষ আসলে শ্বাস নেয়, ছায়া পায় এই অকারণেই। অনিয়ম, বেখেয়াল ছিল বলেই সে আছে, নিয়মে তো যন্ত্রও চলে। শঙ্খ ঘোষের ছড়ার পঙক্তি মনে আসে।
একটা আছে কাঠবেড়ালি আমার দিকে তাকায় খালি
এদিক-ওদিক টানতে থাকে আমায়
যেই না তাকে ধরতে যাব ভুলিয়ে দেয় সব হিসাব ও
ছুট দেয় আর কেই-বা তখন থামায়।
(একলা, আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত)
জীবন আসলেই এমন। কাঠবেড়ালির এদিক ওদিক টান। তাকে ধরা যাবে না, কিন্তু সর্বনাশী টানবেই।
বন্ধুরা দীর্ঘদিন বলছে, নিজের কাগজে ধারাবাহিক চাই। কাজের চাপ, সময়াভাব, শারীরিক সমস্যা ইত্যাদি যেসব তুক সামাজিক অনুষ্ঠানে কাজে লেগে যায়, সেসব দিয়ে যখন ম্যানেজ দেওয়া গেল না, তখন অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা এল মনে। কী নিয়ে লিখব? কাজের কথা, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, সে তো ফেসবুকই আছে তার জন্যে। তাহলে ওই অকারণের সুখের কথা ভাবি, যার কোনও দিকনির্দেশ নেই, যার আট কুঠুরি নয় দরজা খোলা? রোদে, ঝড়ে, জলে যা অবাধগামী, সেই মনের কথা?
আরও পড়ুন-প্রেম আসলে নিষ্ঠুর, আদিম! মানিক, বনফুল, তারাশঙ্করের না-ভালোবাসার তিন আখ্যান
লিখব সেই মনের স্মৃতি সত্তা সংশয় নিয়ে। লিখব আ-কথা, কু-কথা। অহেতুক প্রশ্নমালা যা মনকে রক্তাক্ত করে চলে অবিরল, যে কথা স্রোতের অনুকূল নয়, যে কথা তিতকুটে, না বললেও চলত। যে কথায় মিশে আছে আমার বিস্ময়, ভ্রমণ, যাপন, একাকীত্ব। কেউ দেখছে, এই ভেবে কেউ ঘুড়ি ওড়ায় না, রাত জেগে মাঞ্জা দিতে গিয়ে কাচগুঁড়োয় হাত কেটে রক্তারক্তি করে না। ফলে এ লেখা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। কখনও কোনও বই, প্রদর্শনী, গান যদি আমার মনের দখল নেয় তবে তা নিয়েও লিখতে পারি, কিন্তু চাইব এই ভেবে কেউ যেন আমায় বই না পাঠান, প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ না করেন। কারণ তাতে ইচ্ছেমতো ঘুড়ি ওড়ানোর শর্ত বিঘ্নিত হবে।
কী লিখব, কী লিখব না- এই সব যুক্তিজাল সাজাচ্ছি, ফোন পেলাম জয় গোস্বামীর। কাজের ফোন। কাজের কথা শেষ করে তাঁকে অভিপ্রায় বলতেই তিনি তিন চারটে নাম প্রস্তাব করলেন। তার মধ্যে একটা, উল্টোপাল্টা ঘুড়ির মাঞ্জা। তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে আমার মনের বাইরেটা। ভেতরটা তখন চলে গিয়েছে সরস্বতী পুজোর দিনে, একেবারে জাম্পকাট। প্রতি বছর সকলে পুজোয় ব্যস্ত আমার কেবল কতক্ষণে বেরবো, সেই তাড়া। আমার কাজ- লাটাই ধরা। ঘুড়ি ওড়াবে যে, সে আমার থেকে ধারে ভারে বড়। তার জয় আমার জয়। তার প্রস্তুতিতেই মাঞ্জা দেওয়ার সময়ে হাত কেটেছি আগের সন্ধ্যায়। আমার পাড়াতুতো বন্ধু-দাদা। সে জীবনের যাবতীয় অনিয়ম নিষ্ঠাভরে প্র্যাকটিস করে করে হাত পাকিয়ে একদিন শেষ অনিয়মটা ঘটিয়ে ফেলল। তুবড়ির বারুদের পাহাড়ে বসে সে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটের ফিল্টারটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে পড়ল ওই বারুদস্তুপে। মহাভারতের জতুগৃহের মতো জ্বলে গেল গোটা বাড়ি, কিন্তু আমার ছোটবেলার প্রধান পাণ্ডব প্রাণ নিয়ে আর বেরোতে পারল না। কী হতো আমার জীবনে ওর লাটাই ধরা ফুটবল মাঠে মার খাওয়াটা না থাকলে, কী হতো মধ্যবয়সে বাজি বানানোর অকারণ খেয়াল না থাকলে!
অর্থাৎ জীবনে যা অহেতুক তার ফলাফল অকিঞ্চিৎকর নয়। তা প্রাণঘাতীও কখনও সখনও। তাকে এড়িয়েও যাওয়া যায় না, সে আসে, দখল নেয়, সর্বস্ব খেয়ে চলে যায়, পরিত্রাণহীনতা ছাড়া মানুষের আর কোনও সার্বজনীন অভিশাপ নেই। এই উল্টোপাল্টা ঘুড়ির মাঞ্জার যাবতীয় লেখা আমার পরিত্রাণহীনতাই হবে।
লেখার টেবিলে বসে আছি, পরিকল্পনা করছি, স্থির হলো ইনস্ক্রিপ্ট রবিবারের রোয়াকে সংখ্যা হবে চুম্বন বিষয়ে, নাম চুমুর দিব্যি। লিখবেন নানাজন। চুম্বন, ঠোঁট ছুঁতে চাওয়া কি অনিবার্য না অহেতুক, প্রশ্ন করে আমার মন। মনের সাথে কথা বলি।
আরও পড়ুন- গৃহী রবিঠাকুর ও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ; প্রেমের অলিন্দে অচেনাই রয়ে গেলেন স্বামীজি
আমার মনে হয় চুম্বন একটা অপারগতা।
- কীসের অপারগতা?
-ভাষার, শব্দের। শব্দ ব্রক্ষ্ম হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও বড় নৈঃশব্দ্য, শরীরী ভাষা, আদিম রিপু। শব্দে যা হয় না, অধরদ্বার খুললে তাই হয়। সমর্পণের সেতু তৈরি হয়।
- সহযোগীও তো হতে পারে? যেমন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর রায় অ্যান্ড মার্টিন?
- সহযোগী তো বটেই। কিন্তু শব্দেরা শেষমেষ রণে ভঙ্গ দেয়, শরীরকে বলে, ভাই সদলবলে আপনি ব্যাট করুন, মরণবাঁচন ম্যাচ। ওপেনিং করে ঠোঁট। তাতে বরফ গললে সর্বনাশ। আক্ষরিক সর্ব নাশ।
- আসলে কিন্তু গোটাটা চালাচ্ছে মন, শব্দ তার বর্ম ছিল। মনের নানা ভাষা, মুখের ভাষা, ঠোঁটের ভাষা...
- হ্যাঁ, তা ঠিক, মনই কথা বলে অস্ফুটে, অভিব্যক্তিতে, ছোঁয়ায়, চুম্বনে
-পরীক্ষাও নেয়
-ঠোঁট পরীক্ষক! কীসের পরীক্ষা!
- স্যালাইভা আসলে তো বার্তাবাহক, খবর নিয়ে গিয়ে দেবে হেড এক্সামিনারকে। এই যে গ্রন্থি বাঁধা শুরু হচ্ছে তা কতদূর যাবে, খবর নেয় মন।
-যে চুমুটা খাচ্ছে সে এসব জানে?
-সে এখানে তুচ্ছ, তাকে দিয়ে সমস্তটা করাচ্ছে মন। মন না বললে এমনি এমনি কেউ চুমু খায় না।
-কেউ এমন আছে যে ছিটকে সরে আসে?
- তার মানে মন তাকে বলছে ওদিকটায় অন্ধকার। যেও নাকো মোটে।
- সে যদি ঠোঁটে জড়িয়ে থাকে, দমবন্ধ হলেও...
- তার মানে সে সমুদ্রদ্বার আবিষ্কার করে ফেলেছে। এখন ডুবে গেলেও আপত্তি নেই। মুক্তো আছে সমুদ্রের অতলে। মন জানে।