মন তার মরে গেছে কবেই
The Soul Of Kolkata: গাড়ি এগোতেই চোখে পড়ে পুরনো নিলামঘরটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারি যে কলকাতা শহরের নেশায় ভেসে ভেসে এতদূর এসেছি, সে শহরটার চোখে মুখে বীভৎস মেকআপ, রূপ তার জ্বলে গেছে।
একটা শহর কেমন আছে, তা বোঝা যায় শহরটার পানশালা, বেশ্যাপাড়া আর বইয়ের দোকানের রকমসকম দেখে। তিনটে জায়গায় চোখ রেখেই বুঝি, কলকাতা শহরটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে সমস্ত নিজস্বতা। সারাদিন শহরটায় কাটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মন খারাপ হয়। মনে হয়, নালা দিয়ে সব রং ধুয়ে চলে যাচ্ছে।
কোভিডের আগে থেকেই কলকাতার যৌনপল্লিগুলি ধুঁকছিল। শহরতলি থেকে আয়ার কাজ, কল সেন্টার বলে শহরে আসা ফ্লাইং যৌনকর্মীদের পসার বাড়ছিল। মাসাজ পার্লারগুলি পালের হাওয়া কাড়ছিল অনেক দিন ধরেই। কফিনে শেষ পেরেক মারে কোভিড। দীর্ঘ দু'বছরের অদর্শনে এই পথই ভুলে গেছে রোজের খদ্দেররা। শরাফ আলি এই পাড়ার ট্যাক্সিচালক, আমার চেনা, গল্পের ছলে বলছিলেন সপ্তাহের কোন দিন কাকে কোথায় পৌঁছে দিতেন। তাদের কাউকেই আর দেখতে পান না। এর মানে কি তারা কেউই আর আসেন না নাকি আসলেও অ্যাপ ক্যাব ধরেন, আমার জানা নেই। যৌনকর্মীদের, যাঁদের ধার নেই, বৈধ কাগজপত্র আছে, পায়ের তলায় সামান্য মাটি আছে, তাঁরা অনেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যৌনপল্লি থেকে বেরিয়ে অন্য কাজে চলে গিয়েছেন। দু'বছর চালিয়ে নেওয়ার পুঁজি তাঁদের ছিল না। সরকার রেশন দিয়েছে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভাত,ওষুধের জোগান দিয়েছে, কিন্তু রোজের ঘরভাড়া, সে পয়সা আসবে কী ভাবে? ফলে রয়ে গিয়েছেন তাঁরাই, যাঁদের গারদভাঙার অবকাশ নেই। আধার কার্ড নেই। ফেরার জায়গা বন্ধ। মুখে স্নো-পাউডার, গায়ে চকমকে সিল্কের শাড়ি, দেখা হয়ে যায় বাড়ি ফেরার পথে। একে অন্যেকে দেখি। আর ভাবি, আর কতদিন! এখন তো অ্যাপ আছে, চাইলে অ্যাপেই যৌনকর্মীকে ডেকে নেওয়া যায় সুবিধেমতো জায়গায়। পর্দায় ঘেরা, পাতলা তোষকের খাটে অন্যের যৌনতার ছায়া দেখতে দেখতে যৌনতার স্বাদ নিতে আর কতদিন কেউ আসবে!
আরও পড়ুন: এ পৃথিবী একবার পায় তারে
পানশালাগুলির অবস্থাও আজকাল মরা মাছের মতো। পানশালায় মদ্যপানে খরচ বেশি। কিন্তু মানুষ যায় মূলত পানশালার মেজাজ ভালবেসে। যে যার রুচি, অভ্যেস অনুযায়ী বেছে নেয় নিজস্ব পানশালা। পানশালার ভিতরটা কেমন, কী খাবার পাওয়া যায়, পানশালায় যাঁরা খাবার/মদ দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠছে- এসব দেখেই মদ্যপায়ীরা পানশালাকে নম্বর দেন। চরিত্র গড়ে ওঠে। যতবারই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পুরনো চেনা পানশালায় যাই, দেখি চরিত্র বিসর্জন হলো বলে।
ধরা যাক ব্রডওয়ের কথা। কোভিডের পর থেকে যতবার গিয়েছি হতাশ হতে হয়েছে। দেশি বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে মুখ চুন হয়েছে। খাবারের মান বেশ খারাপ হয়েছে ব্রডওয়েতে। মৌরলা মাছ ভাজা কখনও পাওয়া যায় না। তেলচপচপে ফিশ ফিঙ্গার মুখে পুরে মুখ বিস্বাদ হয়ে যায়। পান শেষ করার আগেই ওয়েটাররা টিপস চাইতে চলে আসছেন। একজনকে টিপস দিলে অন্যজন অখুশি হচ্ছেন, এক টেবিলে তিনজন দাবিদার। সব মিলে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। এর মধ্যে শুরু হয়েছে গান। তুমি চাও বা না-চাও সপ্তাহান্তে গেলে গান শুনতে তুমি বাধ্য। নিভৃত কথাবার্তার আর জায়গা থাকবে না। কান ফাটিয়ে গান মর্মে প্রবেশ করবে। অথচ সবটা এমন ছিল না। বছর চারেক আগেও ব্রডওয়েতে জানলার ধারের মিঠে আলোটার জন্য ঢুঁ মারতে ইচ্ছে হতো। মনে হতো, কোনো একান্ত কোণ বেছে নিয়ে লিখি। এখন অতি দুঃস্বপ্নেও সে কথা ভাবা যাচ্ছে না।
দু'পা পেরোলেই চাংওয়া। আনন্দবাজারের কর্মিবৃন্দ, কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডার জায়গা। সাহিত্য অনুরাগী তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের স্বপ্নের বার। তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটিরও মৃত্যু হয়েছে। যতবারই গিয়েছি, দেখেছি অতি রুক্ষ ব্যবহার করছেন কর্মীরা। খাবারের মানও অত্যন্ত খারাপ। সম্প্রতি এক বন্ধু জানালেন, পত্রিকার পরিকল্পনার জন্য তিনি কেবিনে বসতে চাইছিলেন। কর্মীরা জানান, কেবিনে বসতে হলে ঘণ্টাপ্রতি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বিল হতে হবে। ওঁরা এমনিতে বারে গেলে বিল এর থেকে বেশি অঙ্কেরই হয়। কিন্তু সেদিন এই অপ্রত্যাশিত রুক্ষতায় বেরিয়ে আসেন। বেরিয়ে অন্যত্র যান।
আরও পড়ুন: যে কবিতায় অন্ধকার নামে সহসা
সুরজিৎ সেনের মুখে শুনেছি অলিপাবই ছিল রুচির যোশি অফিস। এখন অলিপাবে ওয়েটারদের বারংবার তাগাদায়, বেজার মুখে সে কথা ভাবাও কঠিন। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম সম্প্রতি অলিপাবের উল্টোদিকে সিলভারগ্রিলে গিয়েও। সিলভারগ্রিলের মালিক থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মচারীদের হাতেই দোকানের রাশ। দোকানে অতীতে যে খাবারগুলির সুখ্যাতি ছিল, প্রায় কোনওটাই আর পাওয়া যায় না। কর্মীরা সাড়ে দশটার মধ্যে সব বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে চান। পার্কস্ট্রিটের মতো জায়গায় কেন সাড়ে দশটায় বার বন্ধ হবে, প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে না। শুনতে পাই বারটা ভেঙে নতুন অন্দরসাজ দিতে চাইছেন মালিক। বুঝি এই বারটা আর অস্ট্রেলিয়ার একটা বারের মধ্যে আর কোনও ফারাক থাকবে না। কলকাতার যে নিজস্ব ঢিমেতালের বার-কালচার, সবটাই ধুয়েমুছে যাবে অচিরেই। থাকার মধ্যে থাকবে শুধু হার্ডরক ক্যাফে, হপিপোলা- যেখানে উইকেন্ডে কর্পোরেটরা যায়। স্ট্রেস্টুকু ঝেড়ে ফেলার রুটিনমাফিক দাওয়াই। একটা মেদুর দুপুর, দু'টো বন্ধু, বেলা গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত, মদ আর নিরন্তর কথকতা, সংলাপের গভীরতর সম্ভাবনা- এ শহরে আজ বড় বেশি চাওয়া।
মন খারাপ হয় বইয়ের দোকানগুলি দেখলেও। কলেজ স্ট্রিটে প্রতিক্ষণ দারুণ একটা বইঘর করেছে। নাম রেখেছে বইচাঘর। কিন্তু আন্তর্জাতিক বইয়ের ঠেক কলেজস্ট্রিট নয়। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের জন্য যে ঠেকগুলি পরিচত-- অক্সফোর্ড বুক স্টোর, সদ্য গজিয়ে ওঠা বাহরিসনস, স্টোরি-- কারও কোনও নিজস্ব চরিত্র নেই। সকলেই দাপিয়ে বিক্রি করছে এলন মাস্ক, সদগুরু, ওশোর জীবনী। দশটি জেন বিধি যা পড়লেই জীবন বদলে যাবে। গীতাঞ্জলি শ্রী চাইলে পাওয়া যাবে না। হোসাং মার্চেন্ট -পাওয়া যাবে না। যে বইটা পেন আমেরিকা পুরস্কার পেল এবার, আছে? যে বইটা বুকার পেল? কেউ কিছু উত্তর দিতে পারেন না। শূন্যদৃষ্টিতে মুরাকামির বই এগিয়ে দেন। আমি বাড়ি ফেরার পথে বইগুলি আমাজনে অর্ডার করে দিই।
গাড়ি এগোতেই চোখে পড়ে পুরনো নিলামঘরটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শহরের সব নিজস্বতাগুলি ধুয়েমুছে যাচ্ছে রোজ। বিষণ্ন বিউগল শুনতে পাচ্ছি যেন। যে কলকাতা শহরের নেশায় ভেসে ভেসে এতদূর এসেছি, সে শহরটার চোখে মুখে বীভৎস মেকআপ, রূপ তার জ্বলে গেছে। মন তার মরে গেছে, কে জানে কবে!