যে কোনও যোগাযোগই রাষ্ট্রের হাতে? যে ভয়াবহ টেলিকম আইন ২০২৩ চালু হচ্ছে দেশে
The Telecommunications Bill, 2023: নতুন টেলিকম আইনে আবার সরকারের হাতে তার প্রয়োজনে কোনও রক্ষাকবচ ছাড়াই কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
নতুন আইন সংহিতা (তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন) চালু নিয়ে দেশ জুড়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে তখন গত ২৬ জুন (২০২৪) কিছুটা চুপিসারেই আংশিকভাবে চালু হয়ে গেল টেলিকম আইন-২০২৩। তথ্যের খাতিরে এ কথা জানিয়ে দেওয়া যায় যে, টেলিকম বিল-২০২৩ বিগত বছরের ডিসেম্বরে সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়। এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত ধারাগুলো চালু হলো, তার মধ্যে রয়েছে ধারা ১, ২, ১০-৩০, ৪২-৪৪, ৪৬, ৪৭, ৫০-৫৮, ৬১, ৬২। এই আংশিক চালু হওয়ার মধ্যে অবশ্যই আছে সরকারের হাতে সেই ক্ষমতা যার দ্বারা জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে বা সাধারণ সময়ে দেশের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নাগরিকের পাঠানো মেসেজ সরকার পড়তে পারে, টেলিকম নেটওয়ার্কের দখল নিতে পারে, ইন্টারনেট পরিষেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখতে পারে। এই আইন যে সমস্ত পূর্ববর্তী আইনকে প্রতিস্থাপিত করল, সেগুলি হলো দ্য ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট (১৮৮৫), দ্য ওয়ারলেস টেলিগ্রাফি অ্যাক্ট (১৯৩৩), টেলিগ্রাফ ওয়ারস (আনলফুল পজেশন) অ্যাক্ট (১৯৫০)। এই নতুন আইন এমন সময়ে চালু হলো যখন ভারতবর্ষ 'ফাইভ জি'-র যুগে প্রবেশ করতে চলেছে এবং ইন্টারনেট পরিষেবা ভারতবাসীর জীবনে এক অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। ন্যায় সংহিতার মতো এখানেও ঘোষণা করা হচ্ছে যে, ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত এক স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য এই নতুন আইন আনা হয়েছে। গোপনীয়তার যে মৌলিক অধিকার আমরা সংবিধানের স্বীকৃতির কারণে পেয়েছি এবং আমাদের বাক-স্বাধীনতার অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার এই আইনগুলোর মাধ্যমে সুরক্ষিত হলো কি এই আইনে? নাকি ভারত তার নাগরিকদের কাছে এক পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল?
এই আইনের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে জনসাধারণের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সরকার যে কোনও মেসেজ পড়তে পারে, মেসেজের সঞ্চালন বন্ধ করতে পারে, এমনকী যে অ্যাপের মাধ্যমে এই মেসেজ সঞ্চালিত হচ্ছে তাকেও প্রয়োজনে সাসপেন্ড করতে পারে। খুব পরিষ্কারভাবে বলা যায়, এবার থেকে সিগনাল, জুম, স্কাইপ, জিমেল এই নজরদারির আওতায় আসবে। এই আইনে মেসেজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: "any sign, signal, writings, text, image, sound, video, data, stream, intelligence or information sent through telecommunication"। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো এই আইনের আওতায় আসবে না। এই আশাবাদের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই কারণ হোয়াটসঅ্যাপ বা জিমেলের মতো প্ল্যাটফর্ম এর আওতায় পড়বে, একথা যেমন লেখা নেই তেমনই এই প্ল্যাটফর্মগুলো নতুন টেলিকম আইনের বাইরে, একথারও কোনও উল্লেখ নেই। এখানে বলা হয়েছেম "any service for telecommunication is under the law"। এই সংজ্ঞা আইনের সর্বব্যাপ্ত পরিসীমার পরিচায়ক।
আরও পড়ুন- এক্সিট পোল ও শেয়ার বাজার: যে মহা কেলেঙ্কারি ঘটালেন মোদি-শাহ
এই আইনের সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঔপনিবেশিক আইনের মতো এখানেও কোনওরকম রক্ষাকবচ ছাড়াই পুলিশ বা অন্যান্য এজেন্সি কোনও নাগরিকের মেসেজ বা ইমেল খুলে পড়তে পারবে। বর্তমানে এনক্রিপশন (Encryption) প্রযুক্তির জন্য প্রেরক ও গ্রাহক ছাড়া কেউ মেসেজ পড়তে পারে না। নতুন আইনে সরকার এই মেসেজ পড়তে পারবে। কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের পাঠানো ব্যক্তিগত মেসেজ এজেন্সির কাছে উন্মুক্ত করতে বাধ্য থাকবে। আইনে বলা হয়েছে, মেসেজের বিষয়বস্তু intelligible format-এ নিরাপত্তা এজেন্সিরগুলোর কাছে যাবে। নতুন আইনে সরকার কত 'ডেটা' সংগ্রহ করছে, কাদের ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে, কেন করা হচ্ছে— সে সম্পর্কে কোনও তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবে না। এমনকী আদালত বা সংসদের কোনও নজরদারির ব্যবস্থা থাকছে না। এক কথায় এক চরম অনির্ভরযোগ্য, দায়বদ্ধতা বিহীন গোপন নজরদারির ক্ষমতা সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
কর্পোরেট মিডিয়ার একটা অংশ দাবি করছে, প্রেস মেসেজের ক্ষেত্রে এই অধিনিয়ম কার্যকরী হবে না। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নথিভুক্ত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে একটা 'সাবক্লজ' থাকলেও আইনের কোথাও মিডিয়ার জন্য কী ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা বা রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে,তার উল্লেখ নেই। এমনকী আলাদা করে কোনও ধারা নেই যেখানে মিডিয়া কর্মীদের জন্য ব্যতিক্রমী ব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে। সোজা কথায়, এই আইনের নজরদারির আওতায় সাধারণ নাগরিকদের মতো মিডিয়া কর্মীরাও থাকবেন।
নতুন টেলিকম আইনে আবার সরকারের হাতে তার প্রয়োজনে কোনও রক্ষাকবচ ছাড়াই কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই জানি, পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ নিজেদের ইচ্ছেমতো ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কুখ্যাত,তার মধ্যে ভারত সামনের সারিতে। গত বছর দেশে এই পরিষেবা বন্ধের ৮৪টি ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে শুধু জম্মু- কাশ্মীরে হয়েছে ৪৯ বার। জম্মু-কাশ্মীরের পরে আছে মণিপুর, রাজস্থান, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ। কোনওরকম রক্ষাকবচ ছাড়াই জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারকে খর্ব করার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে (কাশ্মীরের সাংবাদিক ও সমাজকর্মী অনুরাধা ভাসিন বনাম ভারত সরকার) এবং সেই মামলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এমনকী আইটি আইনের সংশোধনের জন্য সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি নির্দেশ দেয়। এত কিছু সত্ত্বেও এই আইনে কোনও সংশোধনী আনা হয়নি বরং পূর্বতন 'টেলিকম সাসপেনশন রুল' (ধারা ৬১) বহাল রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন-মোদির তৃতীয় দফায় কি বিকল্প মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা হবে?
এই আইন ভারতে এক নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ তৈরি করার চেষ্টা করছে টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে। এর পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশন (হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি) এই লাইসেন্স মানতে বাধ্য থাকবে। এই আইন যে কোম্পানি মানবে না,তাদের নিষিদ্ধ করা হবে, যেমনটা হয়েছিল টিকটকের ক্ষেত্রে। এই সোশ্যাল মিডিয়া যারা ব্যবহার করবে তাদের বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন আবশ্যক করা হয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই আইনের মাধ্যমে ভারতের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় 'KYC Raj' চালু হলো। এই ব্যবস্থায় বিষয়টা কেমন দাঁড়াবে তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, কৃষক আন্দোলন চলছে, কৃষকরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। দিল্লি পুলিশের হাতে এই আইনের মাধ্যমে যে ক্ষমতা এল, তাতে তারা প্রত্যেক কৃষকের পরিচয় সংগ্রহ করতে পারবে, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কোনও নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগের খবরের চলাচল বন্ধ করতে পারে, এমনকী সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী তাঁর নিজের অ্যাকাউন্ট খুলতে পর্যন্ত পারবেন না। এই আইন পুলিশ ও বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সিকে সরকারের বিরোধীদের (কৃষক বা ছাত্র বা সমাজকর্মী বা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা) যাবতীয় টেলি যোগাযোগের উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির ক্ষমতা দিয়েছে।
নতুন আইন জরিমানার মাধ্যমে সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে কোনও ভুল মেসেজ শেয়ার করলে তার জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টেলিগ্রাফ অ্যাক্টে এই জরিমানার পরিমাণ ছিল ৫০ টাকা যা ২০২২ সালের টেলিকম বিলে বেড়ে হয় ২ লাখ টাকা। নতুন আইনে অনথিভুক্ত টেলিকমিউনিকেশনের ব্যবহারে জরিমানা হবে ১০ লক্ষ টাকা।
আরও পড়ুন-মোদির কথা শুনতে চাইছে না মানুষ! কেন সোশ্যাল মিডিয়াতে হু হু করে কমছে মোদির ‘ভিউ’?
শুধুমাত্র মেসেজ বা পরিষেবা নয়, নতুন আইনে টেলি কোম্পানিগুলির পরিকাঠামো তথা যন্ত্রপাতির উপরেও সরকারের কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে। এই আইনে (ধারা ৪৩) একজন সরকারি অফিসারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে: "search any building, vehicle, vessel, aircraft or place in which he has reason to believe that any unauthorised telecommunication network...in respect of which an offence punishable under sec 42 has been committed, is kept or concealed and take possession thereof"।
এই নতুন আইনকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে চলবে না। ব্রডকাস্টিং সার্ভিস বিল, ডাটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট অ্যান্ড পোস্ট অফিস বিল, ক্রিমিনাল প্রসিডিওর আইডেন্টিফিকেশন অ্যাক্ট- ২০২২, আইটি রুলস- ২০২১ (বর্তমানে এর বেশিটাই আইনে পরিণত হয়েছে) — সব মিলিয়ে আমাদের ডিজিটাল জীবনকে নজরবন্দি রাখতে রাষ্ট্রের আয়োজন সম্পূর্ণ। বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকারকে স্তব্ধ করতে এই সমস্ত আইন আগ্রাসীভাবে ব্যবহার হবে। চরিত্রের বিচারে বলা যায় এই নতুন আইনগুলো ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে নতুন অবতারে উপস্থিত করেছে। ভারতে একটি কথা বহুল প্রচলিত, "There is freedom of speech in India, but there is no guarantee of freedom after speech"। নতুন টেলিকম আইনের এই সর্বগ্রাসী সেন্সরশিপ আরেকবার এই কথাকেই মান্যতা দিল।