উল-কাঁটার নকশায় গোপনে খবর পাচার! বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন বাড়ির মেয়েরাই
Wartime Knitting for Espionage: তার মধ্যেও কেউ কেউ গোপনে হয়ে উঠতেন ধুরন্ধর গুপ্তচর। উলে-কাঁটায়, সোয়েটারের বুননে বুননেই পাচার হয়ে যেত গোপন খবর।
একটা একটা করে ঘর তুলে ঘর তুলে বানিয়ে ফেলা আস্ত একটা সোয়েটার কিংবা মাফলার, তার গায়ে শীতের দুপুরের কমলালেবু মাখা রোদ্দুরের মতোই এক আদুরে নস্টালজিয়া লেগে থাকত। এখন আর হাতে বোনা সোয়েটার পরার তাগিদ নেই। মেশিনই বুনে দেয় নিখুঁত উলের সোয়েটার, যেখানে উলের গাঁট নেই, ঘর পড়ে যাওয়া ফাঁক নেই। হাতের স্নেহস্পর্শ নেই। উল বোনা হোক বা সেলাই-ফোঁড়াই, এসব কিছুর মধ্যে বরাবরই গেরস্থপনা লুকিয়ে ছিল। অন্তত এমন একটা ধারনা তো ছিলই। কিন্তু সেই উল-কাঁটাই যে সমস্ত ধারনা ঝেরে ফেলে হয়ে উঠতে পারে সমরাস্ত্র, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
তবে এমনও হয়েছে ইতিহাসে। উল-কাঁটা এবং সেলাই হয়ে উঠেছে যুদ্ধের বিরাট হাতিয়ার। না, তার সুঁচালো মুখ বা ধারের জন্য নয়। বরং বয়নের জোরেই। ধরুন, আপনি দেখলেন ট্রেনে বা বাসে একজন নিপাট সাধাসিধে মহিলা বসে কাঁটায় ঘর তুলে তুলে সোয়েটার বুনছেন। একটা ঘর সোজা, দুটো ঘর উল্টো- নানা সমীকরণে চলছে তাঁর উল। তবে এই আপাত সরল ব্যাপারটার মধ্যেও যে কোনও রহস্য, কোনও গোপন ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন ভাবনা কি মাথায় আসবে আপনার? আসবে না, আর আসার কথাও নয়। আর এই সুযোগটাই ব্যবহার করা হত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
আরও পড়ুন: ১০০ বছর পর এসে পৌঁছল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ‘রহস্যময়’ চিঠি, কী লেখা রয়েছে সেখানে?
ওই ঘর তোলা ঘর ফেলার মধ্যে দিয়ে হাসতে হাসতে পাচার হয়ে যেত বহু গোপন তথ্য। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেত না। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এভাবেই চলত গুপ্তচরবৃত্তি। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? না হওয়াটাই স্বাভাবিক, যে উলকাঁটা বুনে দেয় শীতের আদুরে সোয়েটার কিংবা মাফলার, তা কী করে হয়ে উঠতে পারে যুদ্ধের হাতিয়ার। আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা যাঁদের গুলি বন্দুক বোমা নিয়ে লড়তে দেখি, যুদ্ধটা কিন্তু আদৌ শুধু তাঁদের নয়। বরং যুদ্ধ চলে আরও গভীরে। দেশের আরও অনেকে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কেউ রেঁধে দেয় ভাত, তো কেউ সৈনিকদের জন্য বুনে দেন বস্ত্র। তাঁরাও আসলে একেকটা যুদ্ধ লড়েন, পর্দার আড়ালে থেকে। আর কখনও কখনও এমন ভাবেই পর্দার আড়াল থেকেই হয়ে ওঠেন লড়াইয়ের ময়দানে প্রথম সারির যোদ্ধা। যাদের একেকটা পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করে অনেকটা। এমনকী যুদ্ধের হারজিতও। তেমনই ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই সব বয়নশিল্পীরা।
সেসময়ে অনেকেই সেনাবাহিনীর জন্য বুনে দিতেন সোয়েটার, মোজা, পোশাক। সেটাই ছিল তাঁদের যুদ্ধে যোগদান। আসলে দেশে যুদ্ধ লাগলে বাড়ির সমস্ত পুরুষদের ধরেই টানাহেঁচড়া পড়ত। বাধ্যতামূলক ভাবেই সমস্ত আঠারো পেরনো পুরুষকে যেতে হত যুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের উষ্ণতা, আরামের কথা ভেবেই কাপড় বুনতে বসতেন মেয়েরা। কিন্তু তার মধ্যেও কেউ কেউ গোপনে হয়ে উঠতেন ধুরন্ধর গুপ্তচর। উলে-কাঁটায়, সোয়েটারের বুননে বুননেই পাচার হয়ে যেত গোপন খবর। সেলাইয়ে বুনে তোলা নকশা-ফুলে লুকানো থাকত নানা সঙ্কেত। উলবোনা বা সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দুটো চোখ ঘুরত বনবন করে। আর সেই চোখকে ফাঁকি দেওয়া মোটেই মুখের কথা ছিল না। শুধু কি গোপন সঙ্কেত পাঠানো, বহু সময়েই সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের কাজও বর্তাত তাঁদের কাঁধেই।
কীভাবে পাঠানো হত এমন বার্তা? এ ব্যাপারে মানা হত স্টেগানোগ্রাফি বা শর্ট হ্যান্ডের নিয়মকানুন। তথ্য আদানপ্রদানের একটি গোপন ও প্রাচীন পন্থা এই স্টেগানোগ্রাফি। অনেকটা মর্স কোডের মতোই। নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সেলাই করে করে লেখা হত সেই কোডগুলি। খালি চোখে দেখে মনে হবে সাধারণ কোনও রুমাল বা কাপড়ের টুকরো। কিন্তু তার ভিতরে ভিতরে যে কী সাংঘাতিক খবর পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা বলা মুশকিল। '১৯৪২ বুক আ গাইড টু কোডস অ্যান্ড সিগন্যালস' নামে একটি বই থেকে এমনই জানা যাচ্ছে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে পার্ল হারবারে বোমা ফেলল জাপান বাহিনী। এবার সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নেমে গেল আমেরিকা। শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যোদ্ধার পাশাপাশি খবর আদানপ্রদানের জন্য খবরিও তো প্রয়োজন। তার জন্য় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হল বাড়ির মেয়েদের। শুধু মেয়েরাই নয়, হাসপাতালের রোগী এমনকী শিশুদেরও শেখানো হল সেই গোপন তথ্যপাচারের ফর্মুলা।
সেই সময়ে এমন অনেক মহিলা গুপ্তচরেদের কিসসাই বেশ জনপ্রিয়। ফিলিস ল্যাটর ডয়েল নামে এক গুপ্তচর ছিলেন, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কাজ করতেন ব্রিটিশ সেনার হয়ে। তিনি জার্মান সৈন্যদের বন্ধু সেজে তাদের গোপন খবর পাচার করতেন ইংরেজদের কাছে। আর সেসব খবর কীভাবে পৌঁছত ইংরেজদের কাছে। অবশ্যই সেলাইয়ের মাধ্যমে। সিল্কের সুতোর গোলায় গোপন খবর ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হত ব্রিটিশ সৈন্যের কাছে। মর্স কোডের মাধ্যমে যা অনুবাদ করে নিতে হত। মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মলি মম রিঙ্কার নামে এমনই এক মহিলা গুপ্তচরের কথা জানা যায়। ব্রিটিশ সেনা তখন আমেরিকাকে সব দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। একের পর এক বাড়িঘরের দখল নিচ্ছে ব্রিটিশ সেনা। সেসবকে ক্রমে বানিয়ে তোলা হচ্ছে সেনাঘাঁটি। মলি থাকতেন ফিলাডেলফিয়ায়। একদিন তাঁর বাড়িতেও এভাবেই ঢুকে পড়ল ব্রিটিশ সেনা। বাড়ির সমস্ত পুরুষকে জোরজাবস্তি টেনে হিঁচড়ে বের করে দেওয়া হল বাড়ির বাইরে। থেকে গেলেন শুধু বাড়ির মেয়েরা। থেকে গেলেল মলি। ইংরেজ সেনাদের তো যত্নআত্তি প্রয়োজন। সেই জন্যই মেয়েদের আটতে রাখা। তাদের কাজকর্ম করে দেওয়ার ফাঁকে ইংরেজদের কথাবার্তা সবই কানে যেত মলির। সেসব দেশের সেনাদের কান অবধি পৌঁছে দিতে মলি নিলেন উলের সাহায্য। একটি কাগজে লিখে ফেলতেন সেসব। তারপর সেই কাগজটি দিয়ে পাথর মুড়ে তার উপর উল জড়িয়ে যেতেন। অচিরেই তৈরি হয়ে যেত উলের গোলা। যা জানলা দিয়ে কৌশলে তিনি পৌঁছে দিতেন ব্রিটিশ সেনার কাছে। কাকে-পক্ষীতেও টের পেত না তা।
যারা সেলাই জানেন না বিন্দুমাত্র, তারা ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না এসব ব্যাপারে। এই সেলাই দেখে সেলাই শিখতে গেলেও কম গোল পাকবে না। কারণ এতে যত না বননের ব্যাকরণ থাকত, তার চেয়ে বেশি থাকত সঙ্কেত। আসলে এই গুপ্তচরেরা এমনভাবে সঙ্কেতবহ নকশাগুলি তৈরি করতেন, যা কোনওভাবেই সন্দেহ তৈরি করতে না-পারে। পরবর্তীকালে এইসব বননশিল্পীরা দেখেন, মর্স কোডে এই ধরনের সঙ্কেত লেখার জন্য উলের চেয়ে সুতোই বেশি কার্যকরী। লুসি অ্যাডলিংটন তাঁর স্টিচেস ইন টাইম বইতে জানিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ছিল এমন গুপ্তচরবৃত্তির রীতি। তিনি এ-ও লেখেন, ১৯১৮ সালে জার্মানরা গোপন তথ্য পাচারের জন্য বুনে ফেলত নাকি গোটা একটি সোয়েটার। তবে তাঁর সেই কথা অনেকেই মানতে চাননি। বিষয়টি অতিকথন বলেও মেনেছেন অনেকে। গোটা সোয়েটার বোনা হত কিনা জানা নেই, তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও যে নানা সঙ্কেত ব্যবহার খবর পাচারের কাজ চলত, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ম্যাডাম লাভেঙ্গল এক ফরাসি মহিলার কথা জানা যায়, যিনি নাকি সারাদিন জানলার ধারে বলে উল বুনে চলতেন। আর তারই ফাঁকে চোখ ঘুরত আশপাশে। জার্মান সেনার সমস্ত কার্যকলাপ চোখে চোখে রাখতেন তিনি, আর সেই সমস্ত তথ্য মেঝেতে পা ঠুকে ঠুকে তিনি পৌঁছে দিতেন নিচের তলায় থাকা ছেলেমেয়েদের কাছে। আসলে সেই পা ঠোকার মধ্যে থাকত একএকটি কোড। যা নিচে বসে পড়াশোনার ভান করতে করতে নথিবদ্ধ করে ফেলত তাঁর ছেলেমেয়েরা। জার্মান সেনা সেই বিষয়টির আঁচও পায়নি এতটুকু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই পদ্ধতিতেই খবর পাচার করতেন এলিজাবেথ বেন্টলে নামে এক মহিলা। শুধু কি তাই, দু-দু'টি গুপ্তচর সংস্থাও চালাতেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত খবর আমেরিকার কাছে পৌঁছে যেত সময়ে সময়ে। বার্তাবহ হয়ে পৌঁছে যেত উল। এই কাজের জন্য বেশ কয়েকজন মহিলাকেও তিনি নিযুক্ত করেছিলেন বেলজিয়ামে। যাঁরা রেলগাড়ির কামরায় বসে দিনরাত উল বুনে চলতেন। আর তাঁর ফাঁকেই শত্রুপক্ষ কোথায় কোথায় যাচ্ছে, কী কী পরিকল্পনা আঁটছে, তার নকশা তৈরি হয়ে যেত উলকাঁটায়। যা পৌঁছে যেত মার্কিন সেনার কাছে। এই ভাবেই একটি হাতে বোনা ব্যাগের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বি-২৯ বোমা ও একটি বিমান তৈরির পরিকল্পনা আমেরিকার কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন বেন্টলি।
আরও পড়ুন: নর্তকী সেজে ঘোল খাইয়েছিলেন পুলিশকে, ভারতের প্রথম মহিলা গুপ্তচর সরস্বতীকে জানুন
শুধু মর্স কোড নয়, ডিউই ডেসিমেল সিস্টেম, কম্পিউটারে ব্যবহৃত বাইনারি প্রোগ্রামিং ভাষাও ব্যবহার করতেন গুপ্তচরেরা। সেই সব কোড ফুটে উঠল গ্লাভস বা স্কার্ফে। যা দেখে যে কেউ মনে করবে এসব একজন নবিশের হিজিবিজি সেলাইয়ের কাজ। কিন্তু তার ভিতর দিয়ে যে লেখা হত একেকটা যুদ্ধজয়ের গোপন ফর্মুলা, তা জানত না অনেকেই। আপাত দৃষ্টিতে তা অর্থহীন হলেও, তার গূঢ় অর্থ যদি খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে আপনি ভেবেই নিতে পারেন আপনার শরীরেও বইছে গুপ্তচর হওয়ার সেই গোপন প্রবৃত্তি। কী, একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি!