প্যারিসের মিউজিয়াম থেকে চুরি গেল মোনালিসা ছবি
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা একটি বিশ্বখ্যাত ছবি মোনালিসা। শোনা যায় ছবিটি আঁকতে তিনি সময় নিয়েছিলেন চোদ্দো বছর। ১৫০৩ সালে ইতালির ফ্লোলেন্সে তিনি ছবিটি আঁকা শুরু করেন এবং ১৫১৭ সালে ফ্রান্সে এসে পোট্রেটটির কাজ সমাপ্ত হয় । মোনালিসা আদৌতে কার ছবি কিংবা মোনালিসার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব ছিল কিনা, তা নিয়ে আজও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়। কিন্তু আপনাদের যদি বলা হয় এই মোনালিসা ছবিটির বিখ্যাত হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল ছবিটির চুরি যাওয়ার ঘটনা, তবে নিশ্চয়ই আপনারা অবাক হবেন। ১৮১৫ সালে প্রথম মোনালিসা ছবিটি ল্যুভের মিউজিয়ামে সবার দেখার জন্য রাখা হয় কিন্তু ১৯১১ সালে প্রথমবারের জন্য ছবিটি বিশ্বের সকল মানুষের গুরুত্ব আকর্ষণ করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কী হয়েছিল সেই সময়ে।
১৯১১ সালের ২২শে আগস্ট। সকাল ন’টায় চিত্রশিল্পী লুইস বেরোদ ল্যুভর মিউজিয়ামে এসেছিল কিন্তু ছবিটির জায়গায় গিয়ে দেখেন, ছবিটি সেখানে নেই। আতঙ্কিত লুইস মিউজিয়ামের প্রধান নিরপত্তারক্ষীকে জিজ্ঞেস করেন, ছবিটি কোথায়? প্রধান নিরপত্তারক্ষী উত্তরে বলেছিলেন হয়তো ছবিটি অন্য কোথাও প্রদর্শন করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে আসল বিষয়টি সকলেই বুঝতে পারেন এবং মুহূর্তের মধ্যেই খবরটি পৌঁছে যায় সংবাদপত্রগুলির অপিসে। পরেরদিনই ফরাসি কাগজগুলির মাধ্যমে এই দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা ফ্রান্সে এবং পরে গোটা বিশ্বে। মোনালিসা তখনও বিখ্যাত হয়নি ঠিকই কিন্তু এই মিউজিয়ামে মোনালিসার সঙ্গেই ছিল রাফায়েল, বোতিচেল্লি থেকে শুরু করে ভ্যান গখের সব বিশ্বখ্যাত ছবি। খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে মিউজিয়ামের নিরপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। ফ্রান্সের প্রশাসনকে ভত্সনা করতে থাকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলি। প্রশাসনে এইবার একেবারে নড়েচড়ে বসে। এরপরেই ফ্রান্সের বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়েছিল, ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ নাকি বিক্ষোভ দেখিয়েছিল সেদিন এবং সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল মোনালিসা যিনি খুঁজে এনে দেবেন তাঁকে কোনরকম প্রশ্ন না করেই পুরস্কার বাবদ দেওয়া হবে ৪০ হাছার ফ্রাঁ। আবার অন্যদিকে একই উদ্দে্শ্যে প্যারিস জার্নাল ঘোষণা করেছিল ৫০ হাজার ফ্রাঁ। প্রশাসন নিজের কাজের সুবিধার কারণে মোনালিসার ইম্প্রেশন ছবি ছাপা শুরু করে, আর এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে ধীরে ধীরে খ্যাত হয়ে ওঠে ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’। রেনেসাঁর যুগের ছবি বলতেই মানুষের মধে স্থান কাড়ে মোনালিসা।
এতো নিন্দার মুখে ফ্রান্সের পুলিশের তো জীবন একেবারে ওষ্ঠাগত। চোরকে খুঁজে বের করতে তারা একেবারে বদ্ধপরিকর। এইসময় নাকি পুলিশের জেরা এবং বলা ভালো, রীতিমতো হেনস্থার থেকে রেহাই পায়নি স্বয়ং পাবলো পিকাসোও। অবশেষে ১৯১৩ সালের ২৯ শে নভেম্বর একটি চিঠি আসে ফ্লোরেন্সের শিল্পব্যবসায়ী আলফেদ্রো গেরির হাতে। চিঠিতে ছিল না প্রেরকের নাম, এমনকি চিঠিটি কোন ভাষায় লেখা তাও প্রথমে তিনি বুঝতে পারেরনি। কিন্তু পরবর্তীতেই গেরি ধরে ফেলেন, চিঠিটি কীভাবে লেখা হয়েছে। চিঠিটিকে আয়নার সামনে ধরতেই ফুটে উঠল ইতালিয় সব অক্ষর। গেরি বুঝতে পারেন এইবার হয়তো মোনালিসার চোরকে ধরতে পারা যাবে। তাই তিনি ফাঁদ পাতলেন ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত উফিজি সংগ্ৰহশালার ডিরেক্টর জোভানি পেগপির সঙ্গে এবং এভাবেই একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ল ইতালিয়ন এক রাজমিস্ত্রি ভিনসেঞ্জো পেরুগিয়া ওরফে মোনালিসার অপহরণকারী। পেরুগিয়া নিজের মুখেই পরে বর্ণনা দিয়েছিলেন কীভাবে তিনি একটি আলমারির মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন এই পোট্রেটটি চুরি করার জন্য এবং এই চুরির কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি চাইতেন ইতালির সম্পদকে ইতালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আসলে পেরুগিয়া গল্প শুনেছিলেন রাজা ফ্রান্সিস নাকি এই মোনালিসা ছবিটি অপহরণ করেন লিওনার্দোর কাছ থেকে। পরে অবশ্য তিনি জানতে পারেন যে লিওনার্দো নিজেই ছবিটি ফ্রান্সের রাজার কাছে বিক্রি করেছিলেন, শুনে সে খানিক মর্মাহতও হয়েছিলেন। কারাবাস শেষ করে সে আবার দেশে ফেরে এবং মোনালিসা ল্যুভরে ফিয়ে আসে ১৯১৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ হয় না।
এরপরেও মোনালিসা চুরি নিয়ে নানা গোয়েন্দা এবং সাংবাদিকেরা নানান প্রশ্ন তুলতে থাকেন। ততদিনে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে একাধিক মোনালিসার ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। যারা ছবিগুলি কিনেছিলেন তারা প্রত্যেকেই ভেবেছিলেন তাদের কাছেই রয়েছে ল্যুভর থেকে চুরি যাওয়া লিওনার্দোর আঁকা আসল মোনালিসা ছবিটি। সুতরাং মোনালিসার ল্যুভরে প্রত্যাগমনের কাহিনিতে তাদের মাথায় হাত। ক্রমেই মানুষের মনে আবারও একবার নতুন করে জট পাকতে থাকে, তারা অনুভব করে এই ঘটনার পিছনে বৃহৎ কোন ষড়যন্ত্র কাজ করছে।
অবশেষে ১৯৩২ সালে এই অমীমাংসিত ঘটনায় বিরামচিহ্ন টানতে প্যারিসে আসেন মার্কিন সাংবাদিক মার্টিন ডেকার। তাঁর প্রশ্নের ঝড়ে একধাক্কায় সামনে আসে চুরির আসল ঘটনা। পেরুগিয়া স্বীকার করেন ৪৫ হাজার ফ্রাঁয়ের বিনিময়ে মোনালিসা চুরি করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার পিছনে আসলে ছিল আর্জেন্টিনার ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড ওয়ালফিয়েরনো এবং ফরাসী শিল্পী ইভেস সান্দ্রো। এরা দুজনে আগের থেকেই মুরিল্লো, ভার্মিয়ার, ড্যুরারের মতো গোটা দশেক শিল্পীর আঁকা আসল ছবিগুলির প্রতিকৃতি বানিয়ে, সেগুলিকে আসলের মূল্যে বিক্রি করতেন কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই বেআইনি কারবার ধরা পড়ে যাচ্ছিল। তাই এই ব্যবসা গোটানোর আগে শেষবারে একাবারে বড়ো দাউ মারতে চেয়েছিল ওয়ালফিয়েরনো। প্রথমে এই চুক্তিতে রাজি হয়নি সান্দ্রো তবে পরে তিনি রাজি হন। এরপরেই চুরি করানো হয় মোনালিসা এবং নকল মোনালিসা ছবি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন এই দুই ব্যক্তি। যখন এই খবর পাওয়া যায়, তখন এডওয়ার্ড আর সান্দ্রো কোন দেশে, কেউ জানে না। মোনালিসার এই কাহিনি প্রায় সাত দশক ধরে ঘুরতে থাকে লোকের মুখে আর এভাবেই ল্যুভের এক সাধারণ পোট্রেট থেকে মোনালিসা হয়ে ওঠে রেনেসাঁর উত্কৃষ্ট উদাহরণ।
তথ্যসূত্র:
- https://bangla.aajtak.in/specials/photo/1911-vincis-mona-lisa-was-stolen-pablo-picasso-was-list-suspects-sud-292928-2021-08-23
- https://www.prohor.in/the-theft-that-made-the-mona-lisa-a-masterpiece
- https://thewall.in/feature/magazine-feature-when-mona-lisa-was-stolen-in-1911-the-police-arrested-and-questioned-pablo-picasso/