একানড়ে নয়, সেদিন অন্ধকারে দুলেছিল যে গোল ছায়া...
বেচারি অসীম সে আঁধারভাগ, নির্ঘাৎ সান্তা ক্লজের ন্যায় কুঁজো হয়ে আজও ঘুরে মরে পিঠে মিসফিট-ছাপ ঘুমজল নিয়ে, আলো ছড়ানোর তরে। ওরও নাম কি কোনও জন্মে রহমৎ ছিল?
বরবিলে আমাদের বাড়িটাকে কী বলব, বাংলো-র মতোই বলি। বেশ বড়। আমাদের থাকার ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাবার অফিস, অ্যাকাউন্ট্স, অন্যদের বসার জায়গা আর লম্বা একটা ল্যাবরেটরি। সামনে ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যেই বেশ অনেকটা স্পেস, তার পর সামনে মেন রাস্তা, রাস্তার পাশেই রেললাইন, রেললাইন পেরিয়ে কিছুটা ঢালু, সে ঢালু বেয়ে উঠলেই আবার ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে সারি সারি বাংলো, পমদের বাড়ি, একটু ডান দিকে গেলে তুষারদের বাড়ি…স্মৃতি নিয়ন্ত্রণহীন। আর আমাদের বাড়ির পেছনদিকে একটা মাঠের মতো বারান্দা, বারান্দা থেকে বিশাল সিঁড়ি নেমে গেছে অন্তত ১০-১২টা, নেমেই একটা বাগানের মতো, একটা নিম গাছ, যাতে জানতাম একটা একানড়ে থাকে। তার পর পাঁচিল। পাঁচিলে এসে লাগত জল। পুকুরের। সেই পুকুরেই তো ঠাঁ ঠাঁ গরমে শান্ত মুনির মতো চোখ বুজে গলা অবধি ডুবে বসে থাকত মোষের দল, ওদের কালোয় জ্যামিতি আঁকছে রোদবাহাদুর। সে জ্যামিতি থেকে চোখ সরলেই ক্ষেত, ক্ষেতের পাশে কিছু হাটিং, মানে চাষিদের কুঁড়ে ঘর। আর সে ক্ষেত পেরিয়ে ঠাকুরানির পাহাড়। প্রশ্রয়ী বড় জেঠুর মতো যেন। তাকালেই যাকে পাব আমি যাবতীয় হিসেবনিকেশের পরেও।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
আমি ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসীম সে মায়ারোদ্দুর দেখেছি। ঝড়ে বড় ভয়, তাই যেবার মাথার ওপর থেকে গোটা অ্যাসবেস্টাস উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল সে রাক্ষস, আমি ভেতরে কঁকিয়ে একশা। কিন্তু ঝড় তো সেকালে অত অহরহ আসত না জীবনে, তাই বারে বারে ফিরে দেখি আমি ওই রোদ্দুর আর শীতের রাতে সানমাইকাওলা খাবার টেবিলে বসে জানলা দিয়ে দূরের ঠাকুরানির পাহাড়। সেখানে তখন অন্য এক জলতরঙ্গ। আগুনের বর্ণমালা। শুকনো পাতায় আগুন ধরিয়ে যেন একটা প্রকাণ্ড মালা রচা হয়েছে। আগুনের বিন্দু ওভাবে নাইট ডিউটি করবে, তার পর কখন যে একে একে নিভিবে দেউটি, আমি জানবই না। সকাল সাতটায় স্কুল, কত রাতই বা আর জাগব? ঘুমোতে যাওয়ার আগে আবছা ভেসে আসত শেয়ালের ডাক। ওরা ওই পাহাড় থেকে নেমে এসে ক্ষেতে ঢুকে পড়ত, পুকুরের এ পারে আমায় খানিক ব্যতিব্যস্ত করবে বলে? নাকি ওরা মুখের ওপরই বলে যেতে এসেছিল, বিপন্ন এক কাল কেমনে চুপিসাড়ে আগুয়ান হচ্ছে, আমিই সাহস করে উঠে যেতে পারিনি। গেলে হয়তো…
অবশ্য গেলেও বা?
কালের মন্দিরা কারই বা চোখের ইশারার পরোয়া করে!
তো, ওই শেয়ালগুলো ছাড়াও এই শীত কালে সিঁধ কেটে ঢুকতো আরও কেউ। না, ওদের সঙ্গে সিঁধ কাটা-টা ঠিক যায় না। আসছি তাতে।
যে সন্ধের কথা বলছি, লোডশেডিং কুটুমবাড়ি বানিয়েছে চৌহদ্দি, অলরেডি। মাঝের ঘরে একটা ইয়া মোটা কার্পেটের ওপর লালচে একটা গায়ের চাদর অল্প জড়িয়ে বাবা মুড়ি-চানাচুর খাচ্ছে আর মায়ের সঙ্গে ইতিউতি গল্প। আমি সোফায় আধ-শোয়া। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছি আবার ওই ভয়ঙ্কর চিমা কোন তাণ্ডবনৃত্যটি নাচলেন! রেডিও-য় স্থানীয় সংবাদ ধরেছে বাবা আর ইস্টবেঙ্গল আবার ৪ গোল দিয়েছে, হয় উয়াড়ি নয় হাওড়া ইউনিয়নকে, ঠিক মনে পড়ছে না। চিমা’র দুই তাতে। সে চিরশত্রু যা ইচ্ছে করুক গে যাক, আমার তাতে কী। ঝঞ্ঝাটটা হল, আগের ম্যাচে মোহনবাগান ড্র করেছে খিদিরপুরের সঙ্গে, যদিও উত্তম মুখার্জি’র ক্রস থেকে একটা ক্লিয়ার গোল নাকি অফ-সাইড বলে শিশির ঘোষের নামের পাশে বসেনি। লিগে আমাদের পয়েন্ট ওদের চেয়ে কম। আর দু'টো ম্যাচের পর বড় ম্যাচ, কী যে হবে এ সব ভাবছি! বাবা যদি খানিক খেই ধরিয়ে দেয়, তা না হঠাৎ বাইরের জানলার কাছে একটা থুপ করে আওয়াজ শুনে..
মায়ের সঙ্গে গল্প গল্প করতে করতেই বাবা আমায় বলল, যা কাগজটা নিয়ে আয়। আসলে সে দিনের আনন্দবাজার বরবিল আসত ওই সন্ধে নাগাদ। জানলা দিয়ে কাগজওলা কাকু ফেলে দিত।
তো আমি গিয়ে দেখি, কই কোথায়, কিছু তো নেই। চলে এলাম। তত ক্ষণে বাবা-ও বোধ হয় ইস্টবেঙ্গলের বাড়বাড়ন্ত শুনে রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়েছে আর মুখ বদলাতে খোলা গলায় চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরেছে। চিন্ময়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে তাঁর মতো করে গাওয়া আর কী। লং প্লেয়িংটা বাজতে শুনেছি আমি আগে দিন দু'য়েক। বাবা অপূর্ব গাইত, নিঃসন্দেহে, তা বলে তখন চিন্ময়? আমার তো মাথায় ঘুরছে, 'জি লে লে জি লে লে আয়ো আয়ো জি লে লে'… এনিওয়ে, খানিক পর আবার একটা থুপ আওয়াজ, আবার গিয়ে দেখি, ভোঁ ভাঁ, কোথায় আনন্দবাজার! বিরক্তি যত লাগছে, তার চেয়ে বেশি ভয়। আমার অন্ধকার কেন প্রবল আলোতেও ভূতের বীভৎস ভয়। ঘর থেকে বাবার অফিসের জানলা অবধি আসতে যেতে হচ্ছে, আবার লোডশেডিং- খুনখারাপির টেম্প্লেট যাকে বলে। তার পর তো আমি আবার জানি যে, সেই বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্জাবন, এক বার নাকি এসেছিল। আমি ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানেই। তৃতীয় বার থুপ থুপ আওয়াজটা শুনলাম, দ্বিতীয় বার ফিরে আসার সময়ই। ওটা কাগজ ফেলার শব্দ যে নয় ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছি, তবে কি ওই পঞ্জাবন? বা নিম গাছের একানড়ে? বা এনিথিং, যা পেছনে অপেক্ষারত, আমার মুখ ঘোরাবার? কেমন যেন অসাড় মনে হচ্ছে। 'মা' বা 'বাবা' বলে ডাকও বেরচ্ছে না গলা থেকে। কিন্তু একই সঙ্গে কী যেন একটা হল, মানে কেমন যেন একটা সাহস এল, পিছনে ঘুরলাম, এগিয়েও গেলাম, গিয়ে জানলার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে চোখ সওয়ালাম। কেউ কোথাও নেই তো, ওই থুপ শব্দ-ও আর হচ্ছে না। খান সাতেক তারা দেখতে পাচ্ছি শুধু ওই অবস্থায়, আকাশে।
দৌড়ে ঘরে ঢুকে যেতে যাব, এমন সময়ে, জানলার ডান দিকে, মানে যেখানে সদর দরজা, সেখানে একটি অদ্ভুত ছায়াকে নড়তে দেখলাম। একটা ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকে। পঞ্জাবন? আবার? এ ভাবেই কি সে আমায় নিয়ে চলে যাবে? নিয়ে গিয়ে কী করবে? আমিও কি পঞ্জাবন হয়ে যাব? ভেবে মরার মধ্যেই দেখি, সে ছোট্ট গোলগাল ছায়ার একটি লেজ আছে। পুঁচকে। এ বার সে মিটি মিটি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। কতক্ষণ যে ও ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল নেই, কিছু ক্ষণ পর আলো এল। আমি তন্ন তন্ন করে নয়নতারা ফুলের সারির দিকে, বাঁ দিকে গুদামঘরের (ওখানে বলত সাইডিং) দিকে খুঁজলাম, ছোট্ট দলছুট হাতিটিকে খুঁজে পাইনি। অনেক বছর পর, মেয়েকে কোন ছবি দেখাব খুঁজতে গিয়ে ডিজনি’র ‘ডাম্বো’ দেখে থমকে গিয়েছিলাম। সে সন্ধের লোডশেডিংয়ে এ-ই আমাদের দরজায় এসে থুপ আওয়াজ করছিল না?
আরও পড়ুন:শোকের বিগ্রহ
আমার স্কুলের বন্ধুরা পর দিন কেউ আমায় বিশ্বাস করেনি, সত্যিই তো একটা হাতির ছানা অন্ধকারে আছে আর আলো এলেই হাওয়া, হয় নাকি? আশপাশেও আর কেউ দেখল না। সত্যি, যুক্তি কাটতে পারি না আমি, বাড়ি ফিরে আসি বিশ্বাস-অবিশ্বাস উভয় নিয়েই, কান্না পায়, ঠোঁট ফুলে ওঠে অভিমানে। সেদিন এই আজকের আমি ধারেকাছে থাকলে অভিমানী আমিকে অন্তত খেই ধরিয়ে দিতাম, ও আমার লিপ রিড করে বুঝে নিত নিশ্চিত, আঁধার আপন জঠরে নিয়ে নিয়ে ফেরে সহস্র ধূসর জন্মদাগ, লক্ষ অব্যক্ত ভাবনাদিন, হাজারো তাচ্ছিল্যফুল। তার কোলেকাঁখে যত্নে লালিত হয় সেই সব। রেকারিং হিসেবে গচ্ছিত-ও থেকে যায় তথাকথিত এ খুঁতসকল। অন্য কোনওখানে ফের ঘুম ভাঙাবে বলে কোনও হতভাগার। সই পাতানো খেলায় মজবে বলেও যে। আমরাই চিরবুরবক বা কৃতঘ্ন, তবুও অন্ধকারকে ভাবি অ্যানাথেমা। অপ্রিয়, দূর হটো।
বেচারি অসীম সে আঁধারভাগ, নির্ঘাৎ সান্তা ক্লজের ন্যায় কুঁজো হয়ে আজও ঘুরে মরে পিঠে মিসফিট-ছাপ ঘুমজল নিয়ে, আলো ছড়ানোর তরে। ওরও নাম কি কোনও জন্মে রহমৎ ছিল?
ভাবি বসে।