সৌরজগতের মধ্যেই রয়েছে আরও একটা পৃথিবী! চমকে গেলেন বিজ্ঞানীরাও
চেনা ভূখণ্ডের মতোই এখানে রয়েছে ছোট ছোট পাহাড়, বয়ে চলেছে কল্লোলিনী নদী। পাশে কোথাও আছে টইটম্বুর দিঘি। কখনও বা আকাশভাঙা বৃষ্টি এসে ভরিয়ে তুলছে সমুদ্র। যেন সত্যি-ই পৃথিবীর অজানা কোনও স্থান এটি।
শুধু দিঘিতে জলের বদলে রয়েছে অন্য রাসায়নিক পদার্থ। জমিটি তৈরি হয়েছে বরফ দিয়ে, যার উপরিতলে তরল মিথেনের বাষ্প বয়ে চলেছে। বাতাসে মিশ্র গ্যাসের পরিবর্তে ভেসে চলেছে নাইট্রোজেন গ্যাস। সেই গ্যাসের প্রভাবে তৈরি হচ্ছে বালিয়াড়ি, ঠিক যেন মরুভূমির বালিয়াড়ির মতোই দেখতে। কিন্তু বালির বদলে তা তৈরি হয়েছে হাইড্রোকার্বন-নির্মিত কণা থেকে।
যেন মনে হবে, কল্পবিজ্ঞানে বর্ণিত কোনও এক জগতের কথা বলেছে, যা দেখতে পৃথিবীর মতো হলেও, পৃথিবীর থেকে তার বিস্তর পার্থক্য। তবে না, সেই জগত কল্পবিজ্ঞানের নয়। বরং বাস্তবের। আর নীল গ্রহের সঙ্গে মিল পাওয়া সেই জগত আপনি খুঁজে পাবেন এই সৌরমণ্ডলেই। তবে কোনও গ্রহে নয়, উপগ্রহের বুকে।
আরও পড়ুন: তাপপ্রবাহ থেকে ঝড়ঝঞ্ঝা, আরও করাল হবে প্রকৃতি! কী কারণে এত দুর্যোগ?
হ্যাঁ, টাইটানের জগতে আপনাকে স্বাগত। পৃথিবী থেকে ১,৪২৭ কোটি কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শনির একটি উপগ্রহ টাইটান। টাইটান ছাড়াও তার আরও একাশিটি উপগ্রহ রয়েছে, প্রদক্ষিণ করছে শনিকে অবিরত। শনি আর তার উপগ্রহরা যেন সৌরজগতের ভেতর আরও একটি সৌরজগৎ।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কীভাবে টাইটানের জমিতে বিভিন্ন ধরণের ভৌগোলিক গঠন গড়ে উঠেছে। সেখানে পাহাড়, সমতল কিংবা অন্যান্য জটিল ভূপ্রাকৃতিক গঠনের পিছনে কী গূঢ় প্রক্রিয়া লুকিয়ে রয়েছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এই গবেষণার থেকে জানা যাচ্ছে, টাইটানের জমিতে ছোট ছোট বালিয়াড়ি গড়ে উঠেছে গ্লোবাল স্যান্ড সাইকল বা বিশ্বব্যপী বালুচক্রের কারণে। এবং এই বালুচক্র ঋতুভিত্তিতে দেখা যায়।
সাম্প্রতিককালে জিওফিজি়ক্যাল রিসার্চ লেটার নামক জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা তুলে ধরছে এই ঋতুভিত্তিক চক্র, টাইটানের জমিতে কীভাবে বানিয়ে তুলেছে জটিল ভৌগোলিক গঠন।
অন্যদিকে পৃথিবীর বুকে কিন্তু টিলা বা ছোট ছোট পাহাড় তৈরি হয় সিলিকেটেড পাথর দিয়ে। কিন্তু বাতাসের কার্যকলাপে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় চূর্ণ হয় সেই পাথর। আবহবিকার বা ওয়েদারিংয়েরও হাত থাকে তার পিছনে। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, সুবৃহৎ পাহাড় থেকে ক্ষয়ে গিয়ে জমা হয় পৃথিবীপৃষ্ঠে। কখনও বা স্রোতস্বিনী নদীর জলে মিশে তারা পলির আকারে জমা হয় নদীর নিম্ন অববাহিকায়।
টাইটানেও পৃথিবীর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকে একাধিক। সাদৃশ্য থাকে পূর্ববর্ণিত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও। শুধু টাইটানের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জমা হওয়া পলিতে জৈব পদার্থ থাকে না। গবেষকরা দেখল, টাইটানে জমা হওয়া পলি জৈব পদার্থসমৃদ্ধ। গবেষকরা বহুকাল ধরেই বোঝার চেষ্টায় রত ছিলেন, কীভাবে এই জৈব পদার্থ শক্ত দানাতে পরিণত হচ্ছে, যারাই আবার টাইটানের বুকে এই বৈচিত্রময় ভৌগোলিক গঠন গড়ে তুলেছে তিলেতিলে।
সেই উত্তরও খুঁজে আনল গবেষকরা। স্ট্যানফোর্ডের গবেষক ম্যাথিউ লাপোত্রে জানাচ্ছেন, ঋতুভিত্তিক বালুচক্রই টাইটানের বুকে এত বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক গঠনের পিছনে দায়ী, যে ভৌগোলিক গঠনের তুলনা টানা যায় আমাদের বাসগ্রহ পৃথিবীর সঙ্গেও।
লাপোত্রে গেলেন বিষয়ের আরও গভীরে, জানালেন এই ভাসমান দানাগুলি পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তখন আরও ক্ষয় হয় তাদের। আর এই ক্রমাগত সংঘাতে দানাগুলির আকার ক্রমশ কমতে থাকে। কিন্তু এতদিন তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কীভাবে আবহমানকাল ধরে সেই দানাগুলির মোটের ওপর আকার একই থাকছে। সেই আকারের সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য আর কোনও প্রক্রিয়া কাজ করছে?
সেই উত্তরও খুঁজে পাওয়া সম্ভব পৃথিবীর দিকে তাকালে। পৃথিবীর বুকে ওয়েডস বলে একপ্রকার গোলাকার, ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যায়। মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনতিগভীর সমুদ্রে, ঠিক যেমনটা দেখা যায় বাহামাসে। এই দানাগুলো জমা হয় তখনই, যখন ক্যালশিয়াম কার্বোনেট মাটির সঙ্গে সন্নিবিষ্ট জলের গা থেকে, এই দানাগুলোর গায়ে এসে যুক্ত হয়। এই দানাগুলোর মধ্যে কোয়ার্ৎজ়ও উপস্থিত।
ঠিক এই ঘটনা গবেষকদের জানান দেয়, কীভাবে টাইটানের বুকে টিলার মতো গঠন তৈরি হয়, অথচ সেই টিলাগুলো যে উপাদান বা কণা দিয়ে তৈরি, তারা নিজেরাই কত হালকা। গবেষকদের প্রাথমিক উপাদান এই কণাগুলি পরস্পরের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। আর তার প্রভাবেই পরস্পরকে ধরে থাকা, এবং সংঘবদ্ধ হয়ে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে।
লাপোত্রের মতে এই সৌরজগতেই রয়েছে বিকল্প একটি পৃথিবী- কত আলাদা পৃথিবী আর টাইটান, তবু কোথাও গিয়ে তারা যেন এক।