মানুষখেকো বাঘ বলে কিছু হয় না...
২০২১-২২ ব্যাঘ্রশুমারি শুরু হচ্ছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায়। কখনও তার চকিতে দেখা মেলে বক্সার জঙ্গলে, কখনও আবার শার্দুলসুন্দরী প্রলয়নাচন দেখান সুন্দরবনের জনবসতি অঞ্চলে। বাঘ কি সত্যিই মানুষখেকো? হাজার বছর ধরে সহাবস্থানের যে মন্ত্র বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি রন্ধ্রে সেও কি অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলেনি? বাঘের মন বদলাচ্ছে নাকি আমরাই তাঁকে বাধ্য করেছি স্বভাববদল করতে, এই সব সাত পাঁচ নিয়ে আমরা কথা বললাম সুন্দরবন টাইগার রিজা়র্ভের প্রাক্তন রিসার্চ অফিসার তিষ্য দাশগুপ্তের সঙ্গে।
বাঘ গণনার একদম গোড়ার কথাটা কী, মানে ওয়ার্ম আপ থেকে জানতে চাইছি ?
বাঘ গণনার জন্যে প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজন একটি বাঘকে আরেকটি বাঘের থেকে আলাদা করা। দু'টি মানুষের যেমন আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট আলাদা, তেমন দু'টি বাঘের গায়ের ডোরা কাটা দাগ সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা দুটি বাঘের মধ্যে তফাৎ বুঝতে পারি তাদের গায়ের ডোরা কাটা দাগের ধরনের ভিত্তিতে। এর জন্যে আমরা বাঘের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে বাঘ শনাক্ত করি, এই পদ্ধতিকে আমরা বলি ক্যামেরা ট্র্যাপিং।
শুধু তাই-ই নয়, আজকাল বাঘের ডিএনএ শনাক্তকরণের মাধ্যমেও বাঘ গণনা করা হয়। ডিএনএ মূলত সংগ্রহ করা হয় বাঘের মল থেকে। তবে এই পদ্ধতি অত্যন্ত সময় এবং খরচসাপেক্ষ। তাই সাধারণ ডিএনএ চিহ্নিতকরণ করা হয় না।
এত বড় জঙ্গলে ক্যামেরায় সমস্ত বাঘের ছবি তোলা তো খুবই কঠিন কাজ! গোটা অপারেশানটা সামলান কী করে?
ক্যামেরা ট্র্যাপিং-এর জন্যে পুরো জঙ্গলকে ছোটো-ছোটো অঞ্চল বা গ্রিড অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এক একটি গ্রিডের আয়তন রাখা হয় দুই বর্গ কিলোমিটার। আর প্রত্যেক গ্রিডে এক জোড়া ক্যামেরা মুখোমুখি বসানো থাকে; আর ক্যামেরাগুলি মানুষের হাঁটুর উচ্চতায়, কোনো শক্তপোক্ত গাছপালার গায়ে বসানো থাকে। এই উচ্চতায় রাখলে বাঘের পেটের কাছাকাছি যে ডোরাকাটা দাগগুলো, সেগুলো ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
অনেকের ধারণা রয়েছে যে বাঘের গলায় ক্যামেরা বসানো হয়। এটি কি সত্যি?
বাঘের গলায় ক্যামেরা বসানো হয় না। ক্যামেরা বসানো হয় সেই সমস্ত এলাকার গাছের গায়ে, যে এলাকা দিয়ে বাঘ চলাচল করে। বাঘশুমারির সময়ে আমরা বাঘের ধারেকাছেই যাই না।
সাধারণ মানুষের চোখে ডোরাকাটা দাগগুলি একই রকম লাগে। আপনারা দুটি বাঘের গায়ের ডোরা কাটা দাগের তফাৎ কী ভাবে করেন?
ক্যামেরায় যত ছবি ধরা পড়ে, প্রত্যেক ছবিকে পাশাপাশি ফেলে আমরা চোখে দেখে মেলাই - দেখি যে এই ডোরা দাগগুলোর ধরন একই, না-কি একটির থেকে আরেকটি আলাদা। এই পদ্ধতি চলছে ২০০৬ সাল থেকে, আগেই বললাম। এতদিনে আমাদের কাছে তথ্য আছে এদের গায়ের ডোরাদাগের ধরনগুলি কী রকম, এবং একটির থেকে আরেকটি কতটা আলাদা। ছবিগুলি চোখে দেখে মেলানোর পর আমরা এক্সট্র্যাক্ট কম্পেয়ার নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করি। এই সফটওয়্যার WII অনুমোদিত এবং একমাত্র তারাই ব্যবহার করতে পারে।
এই সফটওয়্যারটি বাঘের গায়ের দাগগুলিকে আরও বড় করে দেখে এবং ডোরাকাটা দাগের পিক্সেল বাড়িয়ে তুলে, খুঁটিয়ে দেখে ডোরা দাগগুলির পার্থক্য। যখনই দেখা যায় দুটি বা ততোধিক ছবি ডোরা দাগের ধরন মিলে গিয়েছে, আমরা ধরে নিই যে এটি একটি বাঘেরই গায়ের ডোরা দাগ।
হাড়কাঁপানো শীতের দিনে বাঘশুমারির কাজ, এ তো রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার!
শীত বা গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই বাঘশুমারি হতে পারে, কোন সময়ে এই কাজটি করা হবে তা কিন্তু নির্ভর করছে অঞ্চল ভিত্তিতে। কারণ গরম কালে ওদের চলাচলের পথ থাকে, শীতকালে তা কিন্তু বদলে যায়। তাই যদি ত্রুটিমুক্ত ভাবে বাঘ গুণতে হয়, একটি নির্দিষ্ট জঙ্গলে কিন্তু যে ঋতুতে কাজ বাঘ গণনার কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে সেই ঋতুতেই পুরো কাজটা শেষ করতে হবে।
আর অঞ্চল ভিত্তিতে কিন্তু বাঘ গণনার পদ্ধতিও বদলে যায়। আর সেই জন্যে দিনযাপনও ভিন্ন হয়। ধরুন আমি মধ্যপ্রদেশের মত শুষ্ক জায়গায় এই কাজ করছি, সে ক্ষেত্রে বাঘ গণনার পদ্ধতি এবং সুন্দরবনের মত জায়গায় বাঘ গণনার পদ্ধতি কিন্তু একদম আলাদা। আর বাঘের চলাচল তখনই বাড়ে, যখন শিকারের আনাগোনাও বাড়ে। তাই বাঘ গোনার পাশাপাশি অন্যান্য পশুও আমরা গণনা করি। ধরা যাক মধ্যপ্রদেশের মত অঞ্চলে সূর্যের প্রথম আলো যখন এসে পড়ে, তখন হরিণের আনাগোনাও বাড়ে। হরিণ শিকারের লোভে বাঘের আনাগোনাও বাড়ে তখনই। আর ক্যামেরা ট্র্যাপিং-এ আমাদের লেগে যায় সারাদিন। তবে দিনের আলো থাকতে থাকতেই সব কাজ সেরে ফেলতে হয় আমাদের।
সুন্দরবন তো শুষ্ক কোনো জঙ্গলের থেকে একেবারেই আলাদা, সেখানে তাহলে পদ্ধতিটা কী?
সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিং হয় নৌকোর সাহায্যে। আমরা নদী এবং খাঁড়ি সংলগ্ন জঙ্গলের গাছে ক্যামেরা লাগাই। বন দপ্তরের নিষেধে পার থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মিটারের বেশি গভীরে আমরা ঢুকতে পারি না। কারণ বাঘের আক্রমণের ভয় আছে।
জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করে ক্যামেরা না বসালে বেশিরভাগ বাঘই তো ক্যামেরায় ধরা পড়বে না! ড্রোন ব্য়বহার করেন?
সুন্দরবনের জঙ্গল এতই ঘন যে, সেখানে ড্রোন ব্যবহার করে বিশেষ লাভ হবে না। সব বাঘ গুনতে গেলে সেই র সংলগ্ন অঞ্চলে লাগানো ক্যামেরাই ভরসা। তবে এখানে একটা মজা আছে। বাঘ যাতে তীরের কাছাকাছি আসি আমরা তার জন্যে টোপ ফেলি বাঘের জন্যে।
বাঘের জন্যে টোপ! গভীর জঙ্গল থেকে এত দূরে বাঘ সাড়া দেয় টোপে?
হ্যাঁ। ছাগল বা মুরগির দিন সাতেকের পচা মাংস, আর তার সাথে পচা ডিম। গন্ধে গন্ধে বাঘ হাজির হয়!
আচ্ছা আপনি যে বাঘের আক্রমণের আশঙ্কার কথা বললেন, বাঘ কি সত্য মানুষখেকো?
অন্য অঞ্চলের বাঘের তুলনায় সুন্দরবনের বাঘের কিন্তু আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। যেহেতু সুন্দরবনের বাঘের খাবারদাবারের বৈচিত্র কম, তাই মানুষ দেখলে আক্রমণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে কিছু ভাববার সময়টুকুও দেবে না। অন্য জায়গার বাঘ মানুষকে দেখলে, দূর থেকে দেখেই সে নিজের পথে চলে যাবে। সুন্দরবনের বাঘ ছাড়া, পৃথিবীর অন্য কোনো জঙ্গলের বাঘ মানুষকে আক্রমণ করে না, কারণ মানুষ তাদের খাদ্য নয়। বাঘ মোটেই মানুষখেকো নয়। সুন্দরবনে খাবারের অভাবই মানুষকে আক্রমণের কারণ। খাবারের অভাবে সুন্দরবনের বাঘ তো মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদিও খায়। কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে মানুষখেকো বলা যায় না। মানুষখেকো বাঘ বলে কিছু হয় না।
এ তো খুবই ঝুঁকির বিষয়! আপনারা সুরক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা নেন?
সুন্দরবনের ক্ষেত্রে একটি দলে আমাদের সাথে আট থেকে দশ জন থাকে। প্রথমে নৌকো থেকে নেমেই গাছের ডাল সাফ করতে থাকে কিছু শ্রমিক। সেই কাজ হলেই দ্রুত ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়। এই পুরো কাজটা কিন্তু শেষ করতে হয় দশ থেকে পনেরো মিনিটে, বাঘের টের পাওয়ার আগেই। আর পুরো কাজের সময় অন্তত চারজন লোক বন্দুক হাতে তৈরি থাকেন। তবে তাতে বাঘকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে ট্যাঙ্ক্যুলাইজা়র থাকে।
ট্রাঙ্কুলাইজার যদি কাজ না করে ?
ট্র্যাঙ্কুলাইজার কাজ না করার ঘটনা আছে, আমি স্বচক্ষে না দেখলেও শুনেছি এরকম ঘটনা। তবে সুন্দরবনের বাঘেদের ক্ষেত্রে ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিয়ে বিশেষ লাভ হয় না। কারণ আপনাকে সে সময় দেবে না, এত দ্রুত এসে আক্রমণ করে। তবে আমরা ডাঙায় নেমে চিৎকার করি, পটকা ফাটাই, যাতে কাছাকাছি বাঘ থাকলেও আওয়াজে পালিয়ে যায়।
সুন্দরবনের মানুষদের তো জীবনধারণের জন্যে জঙ্গলের উপর নির্ভর করতেই হয়, এই ধরনের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা কতটুকু? দোষটা বাঘের না প্রশাসনের?
দুঃখের বিষয়, এই মানুষগুলির সামাজিক সুরক্ষা নেই বললেই চলে। বন দপ্তরের অধীনে কিছু জায়গা আছে, সেই অঞ্চলে মাছ ধরলে বা বনজ পদার্থ সংগ্রহ করতে গেলে যদি কিছু অঘটন ঘটে, সেক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হল, বন দপ্তরের অধীনস্থ এই জায়গাগুলি এতই সীমিত, গ্রামবাসীদের জীবিকা নির্বাহের জন্যে তা যথেষ্ট নয়। এখানে বেশি মাছও পাওয়া যায় না, ফলে গ্রামবাসীদের খাঁড়ি ধরে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতেই হয়। আর সেই অঞ্চলগুলি বনদপ্তরের অধীনস্থ নয়। ফলে গ্রামবাসীরা পেটের দায়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই থাকেন, এবং তাঁরা এটাও জানেন তাঁদের কিছু হলে বনদপ্তর চাইলেও কিছু করতে পারবে না।
অনেকের মধ্যেই ধারণা আছে এখনও বাঘ গণনা বাঘের পায়ের ছাপ বা পাগ মার্ক দেখে করা হয়। কিন্তু এখন আদতে তা হচ্ছে না। বাঘশুমারির এই পদ্ধতি বদলের কারণ কী?
আগে ধারণা ছিলো পায়ের ছাপ যদি ছোট হলে তা বাঘিনীর, আর বড় হলে সেই ছাপ বাঘের। এই বিষয়টা কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে বেশ ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু এই পদ্ধতিতেই ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাঘ শনাক্তকরণ চলেছে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে কোনো জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা মোটামোটি আন্দাজ করা গেলেও কিন্তু সঠিক ধারণা পাওয়া যেত না।
২০০৬ সাল থেকে ন্যাশানাল টাইগার কনজা়রভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) গঠন করা হল। তখন থেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা শুরু হয়। তার পর থেকেই কিন্তু বাঘের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে বাঘ শনাক্ত করা হয়, এই পদ্ধতিকে আমরা বলি ক্যামেরা ট্র্যাপিং।
কবে থেকে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে গণনা শুরু হল?
এর জন্যে আমরা পিছিয়ে যাব ১৯৭২ সালে, যখন বাঘ সংরক্ষণের পরিকল্পনা শুরু হয় - বাঘ শনাক্তকরণের পদ্ধতির কাঠামো খুব নির্ভরযোগ্য ছিলো না। তখন মূলত বাঘের পায়ের ছাপ বা পাগ মার্ক দেখেই বাঘ শনাক্তকরণ হত।
কিছুদিন আগে বক্সাতে বাঘ নেমে এসেছিল। শোনা যাচ্ছে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। সুন্দরবনও কি কোনো সুখবর দেবে?
বাঘের সংখ্যা আলবাত বাড়ছে, সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও তাই। ২০১৮-১৯ সালে অল ইন্ডিয়া টাইগার এস্টিমেশনে সুন্দরবনের মোট বাঘের সংখ্যা ছিল ৮৮। ২০২০ সালে আমি দায়িত্বে ছিলাম সুন্দরবনের বাঘশুমারির, সেই বছর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৯৬। সুন্দরবনের আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গায় (যা মোটামোটি বাঘ গনণার আওতায় রাখা ছিল) ৯৬ টা বাঘ থাকা কিন্তু মুখের কথা নয়! সেই বছর কিন্তু বাঘের ছানার উপস্থিতিও আমরা খেয়াল করেছি, মানে বোঝাই যাচ্ছে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বাকি উত্তর তো ২০২১-২২ এর বাঘশুমারিই দেবে।