এই উদাসীন আন্দোলনের রঙ্গমঞ্চে ইলা মিত্রকে খুব প্রয়োজন আজ
Ila Mitra: মানুষকে সংবদ্ধ করে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ে যেসব মেয়েরা 'আলালের ঘরে দুলালি' হয়ে চাইলেই কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবনখানা, কিন্তু কাটাননি বলে এই সমাজটা অন্যরকম হয়েছে, ইলাদেবী তাঁদের একজন।
"তারপর ইলা মিত্র বলে, একে একে পীড়নের কথা
ঠেলে ফেলে সমস্ত সঙ্কোচ। ইলা মিত্র মর্মে মর্মে জানে
যৌন নয়, সমস্যা জমির।
তারি সঙ্গে বাঁধা আছে যত
পুরুষদের নিষ্ঠুর লাঞ্ছনা,নারীর নিকৃষ্ট অপমান। "
গোলাম কুদ্দুসের লেখা এই কবিতাকে আজ একপ্রকার ইতিহাস বলা চলে। নাচোলের রাণীকে নিয়ে যতবার কথা হয়েছে, লেখা হয়েছে, এড়ানো যায়নি কয়েকটি বাক্য। গোলাম কুদ্দুস ফের লিখছেন,
"ইলা মিত্র কৃষকের প্রাণ, ইলা মিত্র ফুচিকের বোন
ইলা মিত্র স্তালিন নন্দিনী।"
এই ছন্দবিহীন শব্দদল এক অদম্য সাহসী নারীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে বারবার উঠে আসে। ডান হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ হয়। জেগে ওঠে শিরা-উপশিরা। ঝিমিয়ে থাকা একটা জাতির কলম নিশপিশ করে স্লোগান লিখবে বলে। ইলা মিত্রদের ভোলা যায় না। ভুলতে দেন না বাংলাদেশের ফুচিক বোন। আজ যখন আরজিকর হাসপাতালে একজন মহিলা ডাক্তারকে প্রথমে ধর্ষণ এবং তারপর খুন হতে হয়, তখন ইলা মিত্রদের জানা এবং বোঝা ভীষণভাবে জরুরি।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর পেরিয়ে যখন একটা জাতি ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করতে করতে ব্লুটুথ হেডফোনে রবীন্দ্রনাথ শোনেন এবং চাঁদে জলের সন্ধান করতে মানুষ পাঠান। ভাবতে অবাক লাগে তখনও তারা মহিলাদের সমানাধিকারে বিশ্বাস করতে শেখেনি। রাতে বাড়ি ফেরা, জামাকাপড় পরা, চাকরি-বাকরি, বিবাহ সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক আজও এই মানচিত্রে। কিছু মেয়েও নিজেরাই পুরো ব্যাপারটাকে মেনে নেন অদ্ভুতভাবে।
আরও পড়ুন: অর্চনা-লতিকা কিংবা ননীবালাদের লড়াই মনে রাখে না ইতিহাস
সেই কবে, কত বছর আগে প্রীতিলতা, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, কল্পনা দত্ত, ইলা মিত্ররা শিখিয়েছিলেন সমানাধিকারের পাঠ, সেই কবে একটি মেয়ে বেথুন স্কুল থেকে ফার্স্ট ক্লাস গ্র্যাজুয়েট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কৃষক আন্দোলনে, মানুষের আন্দোলনে। সেই কবে তিনি গাঁয়ের সাঁওতাল মা-বোনেদের বুঝিয়েছিলেন, মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলে প্রতিবাদ করতে হয়, নিজের হক বুঝে নিতে একজোট হতে হয়। নিজের ফলানো ফসল জমিদারের লেঠেল বাহিনী লুট করতে এলে লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হয়। ঝাঁটা হাতে বলে দিতে হয় 'আমরা পিছাবনি'।
" ৫ই জানুয়ারি, ১৯৫০ সাল। নাচোলের অফিসার রিচার্জ-সহ পাঁচ-ছ'জন পুলিশ তারা সশস্ত্র গ্রামের দিকে এগোতে থাকে। সাঁওতালরা তা দেখতে পায়। তারপর তারা দামামা বাজিয়ে গোটা গ্রামকে জানায়। আমরাও সেখানে ছিলাম। তাদেরও শিক্ষা ছিল কীভাবে বন্দুক ছুড়লে আত্মরক্ষা করতে হয়, কীভাবে বন্দুক কেড়ে নিতে হয় ইত্যাদি। যাই হোক, পুলিশ এত সাঁওতাল ঘেরাও দেখে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। সাথে সাথেই কয়েকজন মারা যান। তখন তীর-ধনুক নিয়ে এরা পুলিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে। সেই পুলিশদের তারা মেরে ফেলে, বন্দুক ছিনিয়ে নেয়, এবং তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে দেয়। এই শিক্ষাই আমরা কৃষকদের দিয়েছিলাম- ওরা মারলে আমরাও মারব।"
উপরের কথাগুলো স্বয়ং ইলা মিত্রের। ইউটিউব ঘেঁটে অনেক কষ্টে একটি সাক্ষাৎকার পাওয়া গেল। সেখানেই তিনি এই কথাগুলি বলেছেন এবং সব শেষে যে কথাটাও বলছেন, " ওরা মারলে, আমরাও মারব "! হাঁসখালি, হাথরাস, কামদুনি, উন্নাও, আরজিকর— ঘটনার শেষ নেই। নেই বেঁচে আমাদের আপনজন। 'বিচার' হবে আর হচ্ছে-র ফস্কা গেরোয় আটকে গিয়ে আজও হাওয়াই চটির ফিতে বদল করাচ্ছে। নিজের মেয়ের জন্যে বিচার চেয়ে জমিজমা, জমানো টাকাপয়সা খুইয়ে, কত মানুষ আজ চুপ করে গিয়েছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে চোখের কোণে বালি জমেছে। কোর্টের 'তারিখ পে তারিখ'-এর ফাঁদে লুটেপুটে খেয়েছে উকিল। তবু বিচার পাননি ওঁরা।
একটার পর একটা হত্যা, ধর্ষণে যখন জ্বলছে দেশ, রাজ্যে তখন কি "ওরা মারলে আমরাও মারব"— এই দৃঢ়তার প্রয়োজন নেই? এখনও কি আমরা রাস্তায় নেমে মৌনমিছিল আর 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' চেয়ে ঘরে ফিরে ঠান্ডা মেশিনে ঘুমিয়ে পড়ব? আমরা কি জেনেও জানব না এই জাস্টিস আসলে আমরা কার বিরুদ্ধে চাইছি? কীসের বিরুদ্ধে চাইছি? ইতিহাস কি ফের আমাদের নিয়ে অনেকটা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো করেই প্রশ্ন করবে, 'ছিনিয়ে খায়নি কেন?'
ইলাদেবী লিখছেন, "তাঁকে নগ্ন করে শুইয়ে দেওয়া হয়, গরম ডিমসেদ্ধ এনে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, জ্ঞান যখন ফেরে তখন ধূম জ্বর, তখন তাঁর গোড়ালিতে পেরেক পুঁতে দেওয়া হয়, একজন একজন করে তিন চার জন কনস্টেবল তাঁকে ধর্ষণ করে"। পুলিশ জানতে চেয়েছিল, সংগঠনের নেতাদের হদিশ। জানতে চেয়েছিল, আন্দোলনের মাথারা কোথায়? ইলা মিত্র অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু একটা কথাও বলেননি।
ইলা মিত্ররা ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। মানুষকে সংবদ্ধ করে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ে যেসব মেয়েরা 'আলালের ঘরে দুলালি' হয়ে চাইলেই কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবনখানা, কিন্তু কাটাননি বলে এই সমাজটা অন্যরকম হয়েছে, ইলাদেবী তাঁদের একজন।
আজ যখন আন্দোলন হচ্ছে ধর্ষকের বিরুদ্ধে, আমরা কি পেরেছি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্রদের স্বপ্নে দেখা সমাজের জন্ম দিতে? আমরা কি বিয়ের দিনে গায়ে হলুদটা আগে ছেলের গায়ে না ছুঁইয়ে, পেরেছি মেয়ের গায়ে ছোয়াঁতে?' আমরা কি পেরেছি অনেক রাতে বাড়ি ফেরা মেয়েটাকে নিয়ে প্রশ্ন না করে বরং ছেলেটাকে করতে? আমরা কি পারলাম, এমন একটা সমাজের জন্ম দিতে যেখানে একটা মেয়ে তার পরিবার, অফিস, স্কুল-কলেজ, রাস্তায় দৃঢ়ভাবে বলতে পারবে—
Wherever I go
However I dress
No means no
Yes means yes?
পারিনি।
আজও এদেশের মাত্র ৩২ শতাংশের কিছু বেশি মহিলাই অফিসে, দোকানে, বাড়িতে, স্কুলে চাকরি করেন। অর্থ উপার্জন করেন। দেশে প্রচ্ছন্ন মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ঠিক কত, তার হিসেব নেই। যারা চাকরি করেন, তাঁরাও ঘুম থেকে উঠে সংসার সামলে তারপর কাজে বের হন। আঠেরো বছর পেরোতে না পেরোতেই একদল বাবা-মা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লাগেন। ভাবেন 'বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চাইলে পড়াশুনো করবে, না হলে করবে না'
কেন প্রীতিলতা, ইলা মিত্রদের জানা জরুরি আজ? কারণ তার বাবা মা-ও তাঁকে বিয়ের জন্যে চাপ দিয়েছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। তাঁকেও ধিঙ্গি বলেছিলেন কিনা পাশের মানুষজন, আমরা জানি না। লাজলজ্জার গয়নাগাঁটিতে তাঁকেও সাজানো হয়েছিল, তারপরেও একুশের তরুণী পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে যে ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্ম দিয়েছিল. এই দেশে তা দেখেই তো পরবর্তীকালে হাজার হাজার মেয়ে মিছিলগামী হয়েছে। আওয়াজ তুলেছে এক্কেবারে পার্লামেন্ট পর্যন্ত।
আরও পড়ুন:গীতা, ইন্দিরা, মমতা…|| সংসদের অন্দরে যে মেয়েদের পদধ্বনি দামামা হয়ে বেজেছে
রাইটার্সের এক্কেবারে অলিন্দে পৌঁছে এক বোবা-কালা মেয়ের ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছিলেন যিনি, যাঁকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে মহাকরণ থেকে বের করে দেয় পুলিশ, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও মেয়ে। সেদিনের বিরোধী নেত্রী আর আজকের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে বিস্তর ফারাক। দশ লক্ষ টাকায় তিনি আজ ধর্ষণের মাসুল দেন।
কিছু মানুষ আজও গোটা ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির যোগ খুঁজে পান না। অরাজনৈতিক থাকার ভান করেন। 'উই ওয়ান্ট জাস্টিসে'র শুধুমাত্র স্লোগান দিয়ে যে কোনও রকম সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয় তা তাঁরা জানেন। তবু নিশ্চুপ থাকেন।
আচ্ছা ওঁরা কি ইলা মিত্রকে চেনেন না? ওঁরা কি জানেন না, "ওরা মারলে আমরাও মারব" এই শব্দবন্ধ? ওঁদের কি রাগ হয়না? জানি না।
শুধু জানি ইলা মিত্ররা রাজনীতি করতেন। জানতেন রাজনীতির মধ্যে দিয়েই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। কোনও ব্যবস্থার বদল আনতে গেলে একটা ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলতে হয়। এই অসময়ে, এই উদাসীন আন্দোলনের রঙ্গমঞ্চে বোধ করি একজন ইলা মিত্রকে ভীষণ দরকার!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)