জ্যান্ত বিষধর সাপের পুজো! এই মন্দিরে মানুষ ও সাপের সম্পর্ক আজও অটুট

ঝঙ্কেশ্বরী সাপের মাথার নিচে ঘাড়ে দু'টি চোখের মতো ছাপ রয়েছে। বড় মাপের ঝাঁকলাই ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি ফণা তুলতে পারে। তীব্র বিষে ভরা বিষথলি আছে, আছে বিষদাঁতও।

বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সাপের যোগ বহু দিনের। শহরের মানুষ সাপ দেখলে ভয় পান বটে, গ্রামাঞ্চলে কিন্তু সাপে-মানুষে সহাবস্থান নতুন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই খালি পায়ে কাঁচা পথের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে মানুষ। আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। আলের গায়ে গর্ত, জমিতেও সাপ থাকার সম্ভাবনা। বাঁশঝাড়ের বা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ হোক বা মাটির মেঝে, সাপ দেখা দিতেই পারে সেসব জায়গায়। হালে মাটির মেঝে অনেক জায়গায় পাকা হয়েছে বটে- তবু এই সহাবস্থানের ইতিহাস বাতিল হয়ে যায়নি। এখনও বহু গ্রামে বাস্তুসাপ দেখা যায়। মানুষের বিশ্বাস, এই সাপ মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। মঙ্গলকাব্যের দেশ। মনসার প্রতীকও বটে। ফলে বাংলার বেশ কিছু জায়গায় সাপকে পবিত্র মনে করা হয়। এমনই একটি ক্ষেত্র হল বর্ধমান। বর্ধমানের ভাতার, মঙ্গলকোট সীমান্তের সাতটি গ্রাম, বড় পোষলা, ছোট পোষলা, শিকরতোড়, মইদান, পলসনা, নিগন, মসুরিতে সাপে-মানুষে গড়ে উঠেছে এক বিশেষ সম্পর্ক। এখানে ঝঙ্কেশ্বরী সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লোকে বলে ঝাঁকলাই। তবে এখন এই সাপের সংখ্যা কমে গিয়েছে অনেকাংশে।

প্রতি বছর মঙ্গলকোটের ছোট পোষলা, পলসান ও মসারু এবং ভাতারের বড় পোষলা গ্রামে আষাঢ় নবমীতে পুজো করা হয় এই ঝঙ্কেশ্বরী সাপের। মহা ধুমধামে পুজো হল এই বছরও। গ্রামগুলিতে ঝঙ্কেশ্বরীর মন্দির রয়েছে। সেখানেই পুজো হয়। দীর্ঘদিনের এই পুজো বর্তমানে বিখ্যাত উৎসবের রূপ নিয়েছে। প্রায় দুর্গাপুজোর মতোই মর্যাদা পায় এই পুজো। বড় মেলাও বসে গ্রামে। গ্রামের ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তীর মতে, দুর্গাপুজোর সময় যেমন ঘরে ফেরেন বাইরে চাকরি করা ছেলেমেয়েরা, তেমনই আষাঢ় নবমীতেও আসেন সকলে। গ্রামের লোকেদের বিশ্বাস, এই সাপ কাউকে কামড়ায় না। কোনও কারণে কাউকে ছোবল দিলে দেবীর মন্দিরের মাটি তাঁর শরীরে লেপে দিলেই তিনি বিষমুক্ত হয়ে যান।

তবে বাস্তব তেমন নয়। এই সাপ খুবই কম কামড়ায়, কিন্তু কামড়ের ফলে কয়েকজনকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়েছে। গ্রামের রান্নাঘর থেকে বিছানা– সর্বত্রই বিচরণ এই সাপের। এলাকাতে এই সাপ নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত। অনেকে বিশ্বাস করেন, ঝাঁকলাই আসলে কালনাগিনী। লোহার বাসরঘর এড়িয়ে লখিন্দরকে কামড় দেয় সে, পালানোর সময় বেহুলা তাকে লক্ষ্য করে কাজললতা ছুড়ে মারেন। কাজললতার আঘাতে কালনাগিনীর লেজ কেটে যায়। সেই কারণেই ঝাঁকলাই প্রজাতির সাপের লেজও নাকি কাটা। পলসোনার বাসিন্দাদের মতে, লখিন্দরকে কামড়ানোর অপরাধে বেহুলা কালনাগিনীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই অভিশাপেই মর্ত্যে নির্বাসিত হয় কালনাগিনী। পলসোনা গ্রামে খুনগোর নামে একটি ডাঙা রয়েছে। সেই ডাঙাতেই বসবাস শুরু করেন ঝাঁকলাই। গ্রামের বাসিন্দা মুরারিমোহন চক্রবর্তীকে স্বপ্ন দেন দেবী। পুজো চান স্বপ্নে। সেই থেকে পুজোর শুরু।

আরও পড়ুন: তিস্তা নদীর তিন ধারার মাঝে অবস্থান দেবীর! এই শক্তিপীঠে পূজিত হয় সতীর বাম পা

ইতিহাস বলছে, ভাতার এবং মঙ্গলকোট ব্লকের এই মৌজাগুলি পরগনা থেকে থানা গঠনের আগে অবধি ধৈঞা পরগণার অন্তর্গত ছিল। আর এই ধৈঞা পরগণার প্রাচীন নাম ঝঙ্ক পরগণা। ঝঙ্ক পরগণার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী জাঙ্গুলী, ঝঙ্কেশ্বরী নামে এলাকায় প্রতিষ্ঠা পায়। “নয়শো এগারো সালে কৃষ্ণা প্রতি পদে,/ প্রথম বরিখা কালে পড়িয়া বিপদে,/ প্রকটিত হন দেবী ডাঙা খুনগড়ে।” বিমল সামন্তর একটি চটি বইতে উল্লেখিত এই প্রবাদের সঙ্গে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনির মিল রয়েছে। অনেকে মনে করেন, জাঙ্গুলি দেবীই লোকের মুখে মুখে ঝাংলাই বা ঝাঁকলাই হয়ে গিয়েছে। পরে তা থেকে ঝঙ্কেশ্বরী নামটির উদ্ভব। অষ্টনাগ মন্ত্রে পূজিত হন দেবী।

 

Jhankeswari temple

ঝঙ্কেশ্বরী মন্দির

বাবলা-ডিহি এলাকার রাইতা দিঘি থেকে যে ন্যাংটেশ্বর শিবের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, ঐতিহাসিকরা তাকে জৈন তীর্থঙ্কর শান্তিনাথের মূর্তি বলে মনে করেন। পাশের কুন্দা গ্রামের কামারপুকুর থেকে মহাবীরের দিগম্বর মূর্তি উদ্ধার হওয়ায় এই মত আরও জোরালো হয়ে ওঠে। গ্রামে সেই মূর্তি ব্রহ্মেশ্বর নামে পুজো পায়। এছাড়া ওই এলাকায় তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি কালরুদ্র হিসেবে পূজিত, কুন্দার ঘোষপুকুর থেকে উদ্ধৃত লোকেশ্বর মূর্তিকেও কেশ পদবিধারীদের আরাধ্য বিষ্ণু করে তোলা হয়েছে। ফলে জাঙ্গুলি থেকে ঝাংলাই বা ঝাঁকলাই উদ্ভবের সম্ভাবনাটিই সঠিক বলে মনে হয়। ভাতাড়ের ভাটাকূলে শঙ্খিনী নামে, কসিগ্রামে নর-নাগিনী নামে, খুন্নাগ্রামে যমুনা নামে, মেমারির মণ্ডলগ্রামে জগৎগৌরী নামে ও শিলা মূর্তিতে, মঙ্গলকোটের কাঁকোড়া গ্রামে কর্কট নাগ নামে— অঞ্চলভেদে বহু নামে পুজো পান ঝাঁকলাই। বিগ্রহ উচ্চতায় ৯ ইঞ্চি, দ্বিভুজা, কষ্টিপাথরে খোদাই করা। বিগ্রহের একহাতে সাপ এবং অন্য হাতে গদা। বড় পোষলার এই মূর্তিই মান্য বিগ্রহ। এছাড়া ছোট পোষলা, পলসোনা, মুসুরির মন্দিরেও কষ্টিপাথরের বড় বিগ্রহ বিদ্যমান।

ঝঙ্কেশ্বরী সাপের মাথার নিচে ঘাড়ে দু'টি চোখের মতো ছাপ রয়েছে। বড় মাপের ঝাঁকলাই ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি ফণা তুলতে পারে। তীব্র বিষে ভরা বিষথলি আছে, আছে বিষদাঁতও। তবে বিষ ঢালার জন্য এবং ছোবল দেওয়ার জন্য চোয়ালে সাহায্যকারী টেমপোরালিস ও ডাইগ্রাসটিক পেশি যতটা সক্রিয় থাকার দরকার, ততটা নয়। এই জন্যই খুব বেশি বিষ ঢালতে পারে না সাপটি। কাজেই সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা এই অঞ্চলে শোনাই যায় না প্রায়। সাপের লেজ সরু হয়ে আসার আগেই শেষ হয়েছে। সম্ভবত সেখান থেকেই লেজ কাটার জনশ্রুতি। খুব একটা দৌড়ঝাঁপ করে না এই ধরনের সাপ, দিনের বেলাতেই বেরোয় প্রধানত। অন্য সময় উনুনের খাল, মড়াইয়ের তলা, গোয়ালের মাচা, খড়ের পালুই ইত্যাদি স্যাঁতসেঁতে জায়গায় থাকে। তবে গত কয়েক বছরে সাপের সংখ্যা আশ্চর্যরকমভাবে কমে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলে মানুষের কাছে সাপ এতটাই পবিত্র যে, মৃত সাপ ভাগীরথীতে বিসর্জন দেওয়াই রীতি। কিন্তু একটি বা দু'টি সাপ মারা গেলে মানুষ মাটির হাঁড়িতে ভরে তা বাঁশতলায় রেখে দেয়। সেখান থেকেই গ্রামে এঁটুলি ছড়িয়ে পড়ছে। সুস্থ সাপের শরীরেও বাসা বাঁধছে তারা। ফলে অ্যানিমিক হয়ে মৃত্যু হচ্ছে সাপের। তাই সাপ বাঁচাতে একটি সংরক্ষণশালা খোলার দাবি করেছিলেন ভাতারের ধীমান ভট্টাচার্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ-গবেষক হিমাদ্রি ঘোষ। মানুষ এবং সাপের এমন সহাবস্থানের জুড়ি মেলা ভার।

 

 

More Articles