বেহেশতের এই উপত্যকায় কে শোনে ‘মন কি বাত’!
Kashmir Election: সেপ্টেম্বরের বিকেলে ৫-৬ ডিগ্রি ঠান্ডা গায়ে মেখে চা, ম্যাগি, ডিম সেদ্ধ, চিপস-এর প্যাকেট বিক্রি করে। বছরে ছ'মাস চলে বেচাকেনা। পাশাপশি সে ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র। দোকানেই খাওয়া, দোকানেই পড়াশোনা তারপর ঘুম।
আপ জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস দু'ঘন্টার বেশি লেট। ট্রেনে যেতে যেতে কিংবা ট্রেন থেকে নেমে যে প্রত্যাশা সব বাঙালিই করে, সেই প্রত্যাশায় জল ঢেলে একজনও বাঙালি খুঁজে পেলাম না গোটা যাত্রায়। জম্মু স্টেশন থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। অগত্যা মোটা টাকা খরচ করে গাড়িতেই উঠতে হল। জানতে পারি, জম্মুর সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি রেল স্টেশনটির নাম বানিহাল। যেখান থেকে লোকাল ট্রেনে শ্রীনগর পৌঁছতে দেড় ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগবে। সবুজ মেরুন- মোহনবাগান রঙের বাংলোর মত 'রেলবাড়ি' দেখে যে কেউ ইউরোপীয় কোন স্টেশনের সাথে তুলনা টানবেন। কিন্তু যেহেতু জম্মু ও শ্রীনগর রেল যোগাযোগটা সম্পূর্ণ হয়নি, তাই এ যাত্রায় ভুস্বর্গের রেলগাড়ি চাপা অধরাই থাকল।
রাস্তার দু'ধারে পাকা ধানের গায়ে বিকেলের সূর্য দেখে মনে হবে বীরভূমের অগ্রহায়ণ মাস। পশ্চিমবঙ্গের মত আউশ-আমন-বোরোর নিয়ম মেনে এখানে ধান হয় না। বছরের প্রায় অর্ধেক সময়টাই যেহেতু বরফের নিচে থাকতে হয়, সেহেতু এখানে ধানের রোয়া বোনার সময় এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে মে পর্যন্ত। আর ধান কাটার সময় এই সেপ্টেম্বরের পুরোটা জুড়েই।
সেই সোনালী রঙের ধানের সাথে আরও কয়েকটা রং চোখে পড়ছিল যেতে যেতে। যার সাথে খানিকটা আমাদের রাজ্যের মিল রয়েছে। লাল-সবুজ -গেরুয়া। দশ বছর পর নির্বাচনের বাদ্যি বেজেছে ভূস্বর্গে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়: সংবিধানের দিকে তাকিয়ে রণক্লান্ত ভারতীয়রা
গাড়ি ছুটছে। দেশের দীর্ঘতম শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি টানেল পেরোই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হরেক রঙের পতাকা। নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বলয়ের মাথায় পত পত করে উড়ছে আশা-নিরাশার অনেক রং। আমাদের চেনা লাল পতাকার সাথে উপত্যকার অবশ্য একটু অমিল রয়েছে। এখানে লালের মাঝে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা নয়, আছে লাঙলের নিশান। ইতিহাসে প্রথমবার বিজেপি কাশ্মীরের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরেও ভালো রকম প্রভাব ফেলতে চলেছে এই নির্বাচনে। জোট করেছে এনসি, কংগ্রেস আর কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। কুলগাম আসনটি দীর্ঘদিন ধরে লাল ঝান্ডার। ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে জিতে আসছেন ইউসুফ তারিগামি, ফলত কাশ্মীরি কমিউনিস্টদের এই আসনটি থেকে প্রত্যাশা অনেক। 'কাশ্মীরি কমিউনিস্ট' কেন বললাম আলাদা করে? সে কথায় আসছি একটু পরে।
কিন্তু এগুলো তো সবই ইন্টারনেট ঘাঁটা রাজনীতিক গবেষণা মাত্র। যেখানে টানা এক বছরের বেশি সময় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল, দিনের পর দিন আঁধার কার্ড দেখিয়ে যাঁদের স্বজনের বাড়ি যেতে হত, তাঁদের খবর কী? তাদের কতটা প্রত্যাশা এই নির্বাচনে?
ফুফুর বাড়ি ছিল পাকিস্তানের মুলতানে। তাঁর ছেলে মারা যাবার খবর হোয়াটস অ্যাপ কলে নেওয়ার জন্যে যাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল 'অ্যান্টি ন্যাশনাল', তুলে নিয়ে গিয়ে চলেছিল অকথ্য অত্যাচার। সেই পরিবারের কী যায় আসে এই নির্বাচনে? তাঁরা কি ভোট দিতে যাবেন আদৌ?
চলেছি শ্রীনগর, ডাল লেক, উল্লার, ঝিলম পেরিয়ে। চলেছি দেশের শেষ সীমানায়। অদূরে পাকিস্তান সীমান্ত। বর্ণময় সবুজ, অস্তরাগের সূর্য, ভেড়ার পাল। পৃথিবী যেন যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে এটুকুই নিজের জন্য। জায়গাটা বান্দিপোরা বিধানসভার আওতায় পড়ে। ২০১৪ সালে শেষ বিধানসভায় এখান থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছিলেন আব্দুল মজিদ। এ বছর ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমর্থনে কংগ্রেসের হয়ে লড়ছেন নিজামুদ্দিন ভাট। তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির নাসির আহমেদ লোন। পিডিপির তরফে লড়ছেন সৈয়দ তাজামুল ইসলাম।
কথা হচ্ছিল হামিদুল ইসলামের সাথে। হামিদ রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান চালায়। সেপ্টেম্বরের বিকেলে ৫-৬ ডিগ্রি ঠান্ডা গায়ে মেখে চা, ম্যাগি, ডিম সেদ্ধ, চিপস-এর প্যাকেট বিক্রি করে। বছরে ছ'মাস চলে বেচাকেনা। পাশাপশি সে ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র। দোকানেই খাওয়া, দোকানেই পড়াশোনা তারপর ঘুম। ফের ভোর ৬ টায় দোকান খোলা। বড় হয়ে উকিল হওয়ার স্বপ্ন দেখ হামিদুল। জানতে চাইলাম জীবনের প্রথম
ভোটটা কাকে দেবে?
— কোনও হেলদোল নির্বাচন নিয়ে। দিলেও হয়, না দিলেও হয়। কোন দলের কে প্রার্থী তা নিয়েও মাথাব্যথা নেই।
এখনকার মানুষের মূল সমস্যা কী?
—জলদি উত্তর আসে বেরোজগারি।
এখানে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পর তাহলে কী করে?
— কেউ হোটেলে কাজ, কেউ খেতি বাড়ি। ডবল এমএ করে মুরগির দোকান চালাচ্ছে কেউ, কেউ বা গ্র্যাজুয়েট হয়ে ডাল লেকের শিকারা চালক। তবু স্বপ্ন দেখে কেউ কেউ। সাধারণ মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে চোখে পড়ে প্রচুর সেনাবাহিনী। ভারী বন্দুক কাঁধে কেউ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে, কেউ জিরিয়ে নিচ্ছে আপেলওয়ালার চেয়ারে। জন্মের পর এখনকার বাচ্চারা মা, বাবা, পরিবারের সাথে সেনাবাহিনী দেখতেই অভ্যস্ত।
আচ্ছা পর্যটনের কী খবর? ৩৭০ ধারা তুলে দেবার পর কি পর্যটন ব্যবসা বেড়েছে?
— কিঞ্চিৎ বেড়েছে। তবে সেটা শ্রীনগর, পেহেলগাম, সোনমার্গ ও গুলমার্গকেন্দ্রিক। গ্রামে নয়। গুরেজ, তুলেল ভ্যালির মত প্রত্যন্ত কাশ্মীরে বিদেশি টুরিস্ট আসা মানা। আর বিদেশি টুরিস্ট না এলে রোজগার কোথায় বলুন স্যার!বলছিলেন ড্রাইভার ফারুক আহমেদ।
সামনে তো ভোট। কী হবে এবার?
— কেয়া পতা কেয়া হোগা! ইসমে কুছ ইন্টারেস্ট নেহি হ্যায় কাশ্মীরিয়োকা।
দু'বছর আগে এই চত্বরেই এসেছিলাম। জানার চেষ্টা করেছিলাম, কেমন আছেন কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা। দু'বছর আগেও যাঁরা শপিং মল কাকে বলে জানতেন না, মাটির তলা দিয়ে রেলগাড়ি শুনলে যারা প্রায় আকাশ থেকে পড়তেন ২০২২ সালের আগষ্ট মাসেও, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁদের কেউ কেউ শ্রীনগরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়। অনন্ত সবুজের মাঝে ক্ষেতের রাজমা তুলতে তুলতে আফরিন জানায়, সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। মেয়েদের এই সামাজিক উন্নতির নেপথ্যে কি ৩৭০ ধারার উচ্ছেদ? সম্ভবত।
তবে পরিবারে, সমাজের পর্দা প্রথা থেকে আজও বেরোতে পারেনি আফিরন, অতিকা বানোরা। এখনও ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে নিজের নয়, গোলাপ ফুলের ছবি রাখতে হয় তাঁদের। ক্যামেরার সামনে মুখ দেখালে পাছে পাড়ায় বদনাম হয়, পুরুষ মানুষ চটে যান। তাই এই ইন্টারনেট যুগেও মুখ দেখান না তাঁরা । গোটা জম্মু-কাশ্মীর ঘুরলে মহিলাদের জন্য সুলভ শৌচালয় আপনি দেখতে পাবেন না বললেই চলে। পুলিশ, প্রশাসনেও মহিলাদের যোগদান নৈব চ। হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগ, সেখানে রোগী আছে। কিন্তু একজনও মহিলা ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী নেই। সাংবাদিক দেখলে মোটামুটি এড়িয়েই চলেন 'হাব্বা কাতুনের' পরবর্তী প্রজন্ম। যে ক'জনের সঙ্গে কথা বলা গেল, মনে হল না তাদের মধ্যে কেউই ভোট নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান। ভোট দিতে যাবেন কিনা সে নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা কিছুটা এগোলেও নতুন প্রশ্নচিহ্ন দানা বাঁধছে, ‘পড়াশুনো তো করলাম। চাকরি কোথায়?’ একটু বাজারের দিকে এগোই। সেলুনের সামনে বসে কয়েক জন মুরুব্বী। ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ পরবর্তী কাশ্মীরে কী কী পরিবর্তন হয়েছে?— জানতে চাইলাম।
রেশনে আগে ৫ কেজি চাল দিত, এখন ১ কেজি। তেল, চিনি, আটা কিছুই পাওয়া যায় না আর। এটাই পরিবর্তন। হাসপাতাল আছে। কিন্তু সামান্য এক্স-রে করতেও ৮০ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সরকারি বাস পরিষেবা নেই গুরেজ, তুলেল-এর মত প্রত্যন্ত গ্রামে। শহর যেতে ভরসা শেয়ার গাড়ি। শ্রীনগরগামী সেই গাড়ির ভাড়া ৮০০-১০০০ টাকা জনপ্রতি।
নীল, ঘন নীল, খয়েরী, সবুজ— নকশীকাঁথার মাঠের মত দেখতে উপত্যকায় যত এগোই, বুঝতে পারি বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া কাশ্মীর আর এখনকার মানুষের জীবন, এ দু'টোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। বেশিরভাগ মানুষেরই ৩৭০ ধারা থাকল নাকি উঠে গেল সে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। ভোটে হার-জিত নিয়ে প্রত্যাশাও কিঞ্চিৎ। এখানে মূল সমস্যা হল বেরোজগারি। পর্যটন ব্যবসায় সরকারি সাহায্য না থাকা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এই সমস্যাগুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। আমরা দেশভাগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার বাংলা, পঞ্জাবের কথা বলি, কিন্তু কাশ্মীরের বহু মানুষের গা থেকেও কিন্তু দেশভাগের দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি। বিশেষত আটের দশক থেকে বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির আবহে পাকিস্তান নামটাই যারা উচ্চারণ করতে ভয় পান, অবাক লাগলেও এটা সত্যি যে ওই দেশটা একদিন ওদেরও ছিল। কিংবা লাহৌরে, মুলতানে, ঝিলমের ধারের মানুষের কাছে এটাও ছিল বাপ-দাদার দেশ। গণতন্ত্রের মহোৎসব নিয়ে আমাদের মত সাংবাদিককূল, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাতামাতি আছে। থাকবেও। কিন্তু সেই উৎসবের মূলে যে মানুষ, সে মানুষ কি ১০ বছর পর উৎসবের ভাগীদার হবেন? সেই উত্তর মিলবে ভবিষ্যতে?
আরও পড়ুন: হাজার হাজার মানুষ বুঁদ নেশায়! কয়েক বছরে কাশ্মীরে কেন হু হু করে ছড়াল মাদক মহামারী?
লেখার শুরুতে কাশ্মীরি কমিউনিস্টের কথা বলেছিলাম। কুলগাম আসনটি ১৯৯৬ সালে থেকে ইউসুফ তরিগামী জিতেছেন। তাঁর কল্যাণেই দেশের উত্তরে লাল ঝান্ডা ওড়ে কিছু কিছু জায়গায়। কিন্তু আমরা যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে চিনেছি, তার সাথে এখানকার কমিউনিস্টদের বিস্তর ফারাক। সে রাজ্যের পিএইচডি পড়ুয়া তথা এসএফআই নেতা মনসুর মালিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এবার কী হবে? জামাতিদের সমর্থনে দাঁড়ানো সায়ার আহমেদ রেশিকে হারাতে পারবেন আপনারা?
উত্তরে তিনি বললেন, "হামলোগ জরুর জিতেঙ্গে ইনশাল্লাহ"
বোঝা গেল যাদবপুর, মৌলালি, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের নিয়ম মেনে কাশ্মীরের কমিউনিস্ট পার্টি চলে না। এখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত-ধর্ম অন্যতম উপজীব্য। তারিগামির র্যালিতে একজন মহিলা বাদে আর কাউকেই চোখে পড়ল না। তবে কূলগাম ঘুরে বোঝা গেল, কাশ্মীরে কমিউনিস্টদের প্রভাব ভীষণভাবে রয়েছে। উন্নয়নের প্রশ্নেও তারিগামি ছক্কা হাঁকাচ্ছেন। কিন্তু যেহেতু বিজেপি এই আসনে প্রার্থী না দিয়ে খানিকটা সুবিধে করে দিচ্ছে জামাত প্রভাবিত প্রার্থীকে, তাই চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
এই আসনে কি ইউসুফ তারিগামি জিতেছেন এত বছর ধরে? নাকি সিপিআইএম? উত্তরে সূর্যকান্ত মিশ্র, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়দের মত করে পুরো কৃতিত্বটাই পার্টিকে দেন না তারিগামি। বলেন, “দুটোই ঠিক।”