ইমরানের মুক্তির দাবিতে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ! বাংলাদেশের পথে এবার পাকিস্তান?
Pakistan: তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সেই সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক। এই দাবি করেই রাস্তায় নেমেছেন ইমরানপন্থীরা। দাবি একটাই, দ্রুত মুক্তি দিতে হবে ইমরান খানকে।
আর্থিক ভাবে ব্যাপক টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। কার্যত দেশটা দেনায় ডুবে। পরিস্থিতি সামলাতে নাজেহাল শাহবাজ শরিফ সরকার। এর মধ্যেই উস্কে উঠল নয়া অশান্তি। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা ক্রিকেটার ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠল দেশ।
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলবন্দি ইমরান। ২০২২ সালে পাক আইনসভায় অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। তার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে জমতে থাকে পাহাড়প্রমাণ সব অভিযোগ। গ্রেফতারও করা হয় তাঁকে। তবে তার পরেও জেলে বসেই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন ইমরান। নিজে ভোটে জাঁড়াতে পারেনি বটে। তবে তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফ যে নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল, ভোচট মিটলে দেখা যায় তাঁরা ভোটে এগিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে সরকার গড়েছে পিটিআই ও পিএমএলএন-র জোট। দেশের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বলেছেন বিলাবল ভুট্টো জারদারি। আর দেশ শাসনের ভার গিয়ে নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফের হাতেই।
জেল থেকে এখনও মুক্তি পাননি ইমরান। বরং অভিযোগের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে পাকিস্তানের আদিয়ালা জেলে বন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন, এমন দাবি করে রাস্তায় নামল তাঁর অগনিত ভক্ত। উত্তাল হয়ে উঠল পাকিস্তানের রাস্তাঘাট। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বা তাঁর দাদা নওয়াজের বিরুদ্ধেও রয়েছে অজস্র অভিযোগ। অথচ তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে সেসব বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি একরত্তিও। এদিকে, রাজনীতিতে বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই ইমরান ও তাঁর দলের উপর গুচ্ছ গুচ্ছ দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পর থেকেই তাঁর ঠাঁই জেলে।
আরও পড়ুন: স্বপ্নের শপিং মল! উদ্বোধনের দিনেই লুঠ পাকিস্তানে
পাক ক্রিকেট দলের ক্য়াপ্টেন থেকে সোজা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ। ইমরান খানের রাজনৈতিক কেরিয়ার ছিল কার্যত চমকপ্রদ। কিন্তু যেভাবে ধূমকেতুর মতো উত্থান, তেমনই আচমকা পতন। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান। তার পর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন মাত্র দু'বছর। ইতিমধ্যেই ইমরানের বিরুদ্ধে রয়েছে দেড়শোরও বেশি মামলা। যার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে দোষীও সাব্যস্ত হয়েছেন তিনি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সেই সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক। এই দাবি করেই রাস্তায় নেমেছেন ইমরানপন্থীরা। দাবি একটাই, দ্রুত মুক্তি দিতে হবে ইমরান খানকে। আর সেই দাবি নিয়ে রবিবার ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে জড়ো হন অজস্র মানুষ। ক্যাপ্টেনের মুক্তির দাবিতে চলে স্লোগানিং, মিছিল। কার্যত রবিবারের এই মিছিল ছিল এই বছরের বৃহত্তম ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল।
তবে সর্বত্র যে শান্তি ছিল, তেমনটা নয়। বেশ কিছু জায়গাতেই পিটিআই সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর আসে। বিক্ষোভকারীদের বাধা দিতে প্রশাসনের তরফে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উপর জাহাজের বড় বড় কন্টেনার রেখে অবরোধ করা হয়। কয়েকটি এলাকায় পুলিশের বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পুলিশের এহেন ভূমিকার কড়া নিন্দা করে বিবৃতি জারি করেছেন ইমরানের মুখপাত্র জুলফি বুখারি।
বহু জায়গাতেই হিংসার আকার ধারণ করে মিছিল। পুলিশের দাবি, ইমরান খানের সমর্থকরা বিপুল সংখ্যক ইসলামাবাদে পৌঁছানোর পরে হট্টগোল সৃষ্টি হয়, যার জেরে সরকার শহরের সমস্ত রুট বন্ধ করে দেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে উত্তেজিত জনতা। পাল্টা গুলি চালায় পুলিশও। যার জেরে অন্তত ৭ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। গুরুতর জখম হন এক এসএসপিও। ২০ জনেক বেশি জখম হয়েছেন সেদিনের সংঘর্ষে। মৃতের সংখ্য়া বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেলও ছোড়া হয়। ইমরান খানের সমর্থকদের দাবি, সমাবেশে আসা মানুষের ক্ষোভকে পুলিশ ও প্রশাসন ভয় পেয়েছিল, তাই জনতার উপরে গুলি চালানো হয়।
ক্যাপ্টেনের মুক্তির দাবিতে ইসলামাবাদের রাজপথে নামার আগে খাইবার পাখতুনখওয়া প্রদেশেও একটি গণসমাবেশের আয়োজন করেছিল পিটিআই। ইমরানের ১০ হাজারেরও বেশি সমর্থককে দলের পতাকা নেড়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল সোয়াবিতে। সেই সমাবেশ থেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলনকে আরও তীব্র করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল পিটিআই-এর শীর্ষনেতারা। জনসমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের শীর্ষ পিটিআই নেতা আলি আমিন বলেন, ‘‘ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা শীঘ্রই ইমরান খানের মুক্তি নিশ্চিত করব।’’ ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হামাদ আজহারের মুখেও শোনা গিয়েছে একই বার্তা। তিনি জানান, ইমরান খান জেল থেকে ছাড়া না পাওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না। লাহোরের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং পিটিআই নেতা সালমান আকরাম রাজা বলেন, ইমরান খানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই দেশকে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য রাজনীতিবিদদের কবল থেকে বাঁচাতে পারেন।
গত এক বছরে একাধিক বার সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে পাকিস্তানে। পাক নির্বাচন কমিশন পিটিআইয়ের স্বীকৃতি বাতিল করায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সে দেশের সাধারণ নির্বাচনে ইমরানের অনুগামীরা নির্দল হিসাবে লড়ে ৮৪টি আসনে জিতেছিলেন। রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেল থেকেই পিটিআইকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইমরান। নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর দেশের শীর্ষ আদালত নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতি বাতিলের সিদ্ধান্ত রদ করে জানায়, পিটিআই দলগত ভাবেই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৩টি সংরক্ষিত আসন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর পর পিটিআইকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হবে বলে জানিয়েছিল পাক সরকার। পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সরকারের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লা তারার জানিয়েছিলেন, নিয়মের বাইরে গিয়ে বিদেশি অনুদান গ্রহণ, হিংসায় সরাসরি মদত দেওয়া ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য ফাঁস-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে যে সব সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তা তাদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট।
আরও পড়ুন:৪৫ দিনে ১১ বিলিয়ন ডলার ধার! যে ভাবে ডুবছে পাকিস্তান
এদিকে পিটিআই দাবি করেছে, ইমরানকে জেলে নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে। একই অভিযোগ তুলেছিলেন ইমরান-পত্নী বুশরা বিবিও। জেলে ইমরানকে খারাপ খাবার দেওয়া হচ্ছে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনিও। জেলে ইমরানের প্রাণসংশয় হতে পারে বলেও দাবি করেছিলেন বুশরা। অন্যদিকে, আদিয়ালা জেল কর্তৃপক্ষ বার বার দাবি করেছেন, ইমরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য মোটা টাকা গুনতে হয় হয় তাঁদের। সরকারি সূত্রে খবর, প্রায় ১২ লক্ষ টাকা মাসিক খরচ হয় প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। সব মিলিয়ে ইমরানের মুক্তি নিয়ে বেশ চাপে সে দেশের সরকার।
কিছু দিন আগেই গণঅভ্য়ুত্থানের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। আর্থিক অনটনে ক্লান্ত পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই সরকারবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধছে। জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, মুদ্রাস্ফিতি তুঙ্গে। অথচ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। দেনায় ডুবে দেশ। আর সেই দেনা মেটাতে মানুষের উপর নানাবিধ কর বাড়ানোর পথে হাঁটছে পাক সরকার। অথচ সরকারের খরচ কমানোর সদিচ্ছা নেই ক্ষমতাসীন দলের। এই পরিস্থিতি ইমরান খানের মুক্তির দাবিই কি গণআন্দোলনের দিতে মোড় নেবে? পিটিআইকে সামনে রেখেই কি ক্ষমতাসীন সরকারকে গদিচ্যুত করার স্বপ্ন দেখছে পাকিস্তানের বাসিন্দারা। রবিবারের এই বিক্ষোভ তুলে দিয়েছে তেমনই সওয়াল।