কখনও শেখ হাসিনা, কখনও জাক দেরিদা || বইমেলাই আন্তর্জাতিক করেছে বাঙালিকে

বইমেলা... বইমেলা অমর একুশে বইমেলা/ তোমায় পথচলা, মন উতলা, ভাবি সারাবেলা

কিছুদিন আগেই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের মরণপণ সেই লড়াইকে বাঙালির মনের ভিতর আরো একবার জ্বালিয়ে দিয়ে গেল তারিখটি। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো স্মৃতির কোলাজ সঙ্গে নিয়েই একুশে ফেব্রুয়ারির কিছুদিন পরেই শুরু হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা।১৯৭৬ সাল থেকে বিজয়গাথা লেখার শুরুতেই ইতিহাসের, তার চলা থামেনি আজও। বরং প্রতিবারই যেন পাঠকের দরবারে নতুন মোড়কে হাজির হয় সে। আর পাঠকরাও যেন প্রতিবারই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন বছরের এই সময়টার জন্য। কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক বইমেলা। সালটা ১৯৭৫। প্রকাশক বিমল ধরের উদ্যোগে প্রায় ১৪টি প্রকাশনা সংস্থা এল এক ছাতার তলায় - তৈরি হল পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। যদিও প্রথমে এই সংস্থা পরিচিত ছিল পাবলিশার্স গিল্ড নামে। এই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের হাত ধরেই বর্তমানে আয়োজিত হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা।

কলকাতা বইমেলার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে হাজারো গর্বের ইতিহাস, ঠিক তেমনি কিছু লজ্জার ইতিহাসেরও অংশীদার সে। এমনই এক লজ্জার বছর ১৯৯৭। সে বছর ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়ে যায় কলকাতা বইমেলার নিরাপত্তা নিয়ে।১৯৯৭ সালে কলকাতা বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স, সেই বছর বইমেলার উদ্বোধন করেন বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক জাক দেরিদা। অথচ সমস্ত আয়োজন সেবার যেন একমুহূর্তে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল একটি অনভিপ্রেত ঘটনায়। মেলা চলাকালীন হঠাৎই একদিন আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গন। ঘটনায় মৃত্যু হয় এক দর্শকের। তবে তা আগুনে পুড়ে নয়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। নিহত দর্শকের নাম ছিল যতীন শীল। না আগুন লাগার মূল কারণ জানা না গেলেও এর পিছনে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়নি পুলিশ।

সালটা ১৯৯৮।" যাক যা গেছে তা যাক" - পুরাতনকে পিছনে ফেলে নতুনের পথে এগিয়ে চলার সংকল্প গ্রহণ করল বইমেলা। ফেলে আসা বছরের গ্লানি, লজ্জাকে আগামীর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলল সে।১৯৯৮ সালে বইমেলার উদ্বোধন করেন রিচার্ড ডকিন্স। সঙ্গে ছিলেন ওয়ালস্টেয়ার নিভেন্স।

অবশ্য ফ্রান্স বা ব্রিটেনকে থিম কান্ট্রি করা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি তৎকালীন সময়ে। সেই সময়ের বামপন্থীরা এ নিয়ে বিঁধেছিলেন বইমেলা কর্তৃপক্ষকে। তাদের যুক্তি ছিল বেছে বেছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে থিম কান্ট্রির সম্মান দেওয়ার পিছনে গিল্ডের সম্পাদকের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এবং একইসঙ্গে অসাধু উদ্দেশ্য কাজ করছে। যদিও এই অভিযোগের সারবত্তা ছিল না আদৌ।

১৯৯৮ সালে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ সাক্ষী ছিল এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের। প্রাণঘাতী বন্যা ভাসিয়ে দিয়েছিল সোনার বাংলার সব স্বপ্নকে। দুঃস্বপ্নের দিনগুলিতে ভারত সর্বতোভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে বইমেলার থিম কান্ট্রি হল বন্যাবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। বহু বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে দর্শকদের নজর কাড়ল সোনার বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। কলকাতা বইমেলা সাক্ষী আরও এক মাইলস্টোনের। শেখ হাসিনা এমন এক প্রধানমন্ত্রী যার হাত ধরে উদ্বোধন হলো কলকাতা বইমেলার। এর আগে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী আসেননি বইমেলা উদ্বোধন করতে। হাসিনার হাত ধরে কলকাতা বইমেলা স্পর্শ করে ফেলল সেই গর্বের ইতিহাস।

' গেস্ট অফ অনার ' - ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার এই ধারণাটির আদলেই কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসেছিল ফোকাল থিমের ভাবনা। প্রথম বছর বইমেলার ফোকাল থিম ছিল আসাম।

আগেই বলেছি কলকাতা বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু না জানা গল্প, না জানা ইতিহাস। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হয় কলকাতা বইমেলা। তবে ১৯৮০ সালে বর্তমানে মোহরকুঞ্জ অঞ্চলে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা।১৯৮০ সাল থেকে শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে প্রথম কয়েক বছর নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়নি পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা। তবে ১৯৮৪ নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই মেলা। ঘটনাচক্রে এই বছরেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে কলকাতা পুস্তকমেলা।১৯৯৪ সালের পর রাজ্য সরকার কলকাতা বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা।

এমনই বহু জানা অজানা গল্প ভিড় জমায় কলকাতা বইমেলার আনাচে-কানাচে। আনকোরা বইয়ের ডালি সাজিয়ে প্রতিবারই যেমন হাজির থাকেন দেশ-বিদেশের প্রকাশক তেমনি নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে দেশের আনাচে-কানাচে থেকে কলকাতায় ছোটেন পাঠকরা, ব্যতিক্রম নন বিদেশের বইপ্রেমীরাও। কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে অনুষ্ঠিত এই বইমেলার আরেক গর্বের বিষয় বৈকি!

More Articles