শহর কলকাতায় বাঘের উৎপাত! গাঁজাখুরি নয়, সেদিন যা হয়েছিল...
'এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ'। শহর ঘুরে দেখবার শখ হয়েছিল তার। সারাক্ষণ জঙ্গলে বসে মশার কামড় খেতে আর কারই বা ভালো লাগে? দক্ষিণরায় সোজা এসে উপস্থিত হলেন কলকাতায়, ছাড়লেন এক বেদম গর্জন। তারপর? 'তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ বা হাঁকে পুলিশ, কেউবা বলে, "কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।" এমনটাই ছিল কলকাতার 'রয়াল বেঙ্গল রহস্য'। সে গল্প আজকের নয়, বহুদিন আগেকার।
কলকাতার ঠিক পাশে তখন ছিল সিমুলিয়া। সেখানে পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। অর্থাৎ, এক কথায় বললে সুখে শান্তিতে বসবাস করে মানুষজন এমন এক নিরাপদ গঞ্জ। কিন্তু বেশিদিন সুখ আর করই বা সয়? 'যেখানেই যাও চলে', পদে পদে বিপদের ভয়। আর সেই নিয়মেই ১৮৪৯ সালের এক রোহমর্ষক ঘটনায় সিমুলিয়ার মানুষের রাতের ঘুম গেল ছুটে। এলাকায় নেকড়ে বাঘের উৎপাত শুরু হল। ১৯ এপ্রিলের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় বাঘ বাবাজীর আগমনের খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। তিনি নাকি ইতিমধ্যেই ঘটিয়ে ফেলেছেন ভয়াবহ সমস্ত কাণ্ডকারখানা। ১৩ এপ্রিল সন্ধের ঠিক পরে বাঘটা এসে পৌঁছয় বাবু শিবনারায়ণ দাসের গলিতে। এবং সোজা হানা দেয় নফর বাগদীর বাড়িতে। নফরের সাত মাসের কন্যা কোনোভাবে বাঘের সামনে এসে পড়ে এবং আর কোথাও কিছু না পেয়ে তাকেই মুখে করে বাঘটা পালানোর তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু সে যাত্রা সে পুরোপুরি সফল হয়নি। আশেপাশের মানুষজন ঘটনাটা দেখে ফেলায় হাহাকার আরম্ভ করে এবং সেই পরিত্রাহি শব্দে ভয় পেয়ে শিকার ফেলেই বাঘ পালায়। নফরের সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে অবশ্য জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়নি। বাঘের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটেছিল।
এ ঘটনার ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল, পাশের পাড়াতেই ঘটে গেল ফের এক ভয়ানক কাণ্ড। তখন সবে অন্ধকার নেমেছে, এমন সময় এক রাজপুতের দেড় বছর বয়সি পুত্রসন্তানকে তুলে নিয়ে গেল দক্ষিণারায়। এ যাত্রাও তার শিকারের সাধ পুরোপুরি মিটল না। পাড়ায় 'গেল গেল' রব ওঠায় শিকারের আশা ছেড়ে দিয়ে বাঘ গা ঢাকা দিল, কিন্তু গোলমাল বাধল অন্য জায়গায়। রাজপুতের শিশুসন্তানের শরীরের স্পর্শকাতর কোনও এক জায়গায় বাঘটা দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে সেখান থেকে অনবরত রক্তপাত আরম্ভ হয়। তারপর মাত্র কয়েক ঘন্টা। বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।
চারদিনের মাথায় ব্রিটিশ সরকার বাঘটাকে ধরার কোনোরকম চেষ্টা না করলে দুটো ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি খানিকটা অভিযোগের সুরেই ঈশ্বর গুপ্তের পত্রিকায় লেখা হয়, " এইক্ষণে পুলিসাধ্যক্ষ মহাশয়েরা ও পল্লীস্থ লোকেরা কথিত ভয়ানক জন্তুর নিপাত বিহিত মনোযোগ করুন।"
কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বাঘের উপদ্রবের ঘটনা নতুন নয়। ১৮১৯ সালে 'সমাচার দর্পনে' প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়, সে বছর সুন্দরবন থেকে থেকে বেরিয়ে একটা বাঘ এসে উপস্থিত হয়ছিল গৌরীপুর গ্রামে। গৌরীপুরের অবস্থান ছিল এখনকার দমদমের পাশে। বাঘটা শুড়িটোলা, বাগমারী এবং বেলগাছী এই তিনটে গ্রামে আনাগোনা করে শেষে গৌরীপুরে এসে হাজির হয় এবং এক মহিলাকে হত্যা করে। হরিপদ ভৌমিক তাঁর 'কলির শহর কলকাতা' বইতে দেখিয়েছেন কী ভাবে সুন্দরবনের জঙ্গল বুজিয়ে তার উপর রাতারাতি গড়ে উঠেছিল শহর কলকাতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় শিয়ালদহে এক পুকুর খোঁড়ার সময় মাটির তলা থেকে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী গাছের গুঁড়ি উদ্ধার করা হয়। ফলত, বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না যে এ অঞ্চলে একসময় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিল সুন্দরবন।
তারপর তার উপর নেমে এলো ঔপনিবেশিক সভ্যতার ইমারত শোভিত আগ্রাসন। বাস্তুহারা হল অসংখ্য পশুপাখি। কেউ বা প্রাণ বাঁচাতে পালালো গভীর জঙ্গলে। নগরায়ণের কংক্রিটের তলায় ঘটল এক বাস্তুতন্ত্রের সলিল সমাধি। তারপর একদিন শুরু হবে প্রত্যাবর্তন। সভ্য লোকালয়ের বাসিন্দাদের মনে ত্রাস জাগিয়ে মাঝে মধ্যেই গহিন বনের জীবদের আনাগোনা ঘটতে লাগল কলকাতার রাজপথে। ব্যস্ত হয়ে উঠল পুলিশ প্রশাসন। এভাবেই তো চলতে থাকে। নগরায়ণ থেকে গোলকায়ন। ঊনবিংশ থেকে একবিংশ শতাব্দী। এলিফ্যান্ট করিডোরের উপর তৈরি হয় রেলপথ। আমাজনের বিস্তীর্ণ জঙ্গলের উপর ছড়িয়ে পড়ে বিধ্বংসী দাবানল। 'অরণ্যের অধিকার' ছেড়ে 'লুব্ধক' সম্প্রদায় চলে যায় অনিশ্চিত অজ্ঞাতবাসে।
বন ক্রমে ছোট হয়ে আসে। আর জনারণ্যে ঢুকে পড়ার জন্য় আমরা বাঘকে শাপশাপান্ত করি। কে কার ভিটে খেল, একবার ভেবে দেখবেন!