দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন, টাইগার শ্রফের বাঙালি দাদুর গল্প স্তম্ভিত করবে!

জানেন কি তাঁর দাদু অর্থাৎ মাতামহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন? আজ আপনাদের জন্যে রইল রঞ্জন দত্তের অজানা কিছু তথ্য।

ভারতীয় সিনেমার জগতে টাইগার শ্রফ একটি পরিচিত নাম। বাবা জ্যাকি শ্রফের অভিনয় দীর্ঘদিন মাতিয়ে রেখেছিল বলিউডের দর্শকদের। তুলনামূলক ভাবে টাইগারের অতটা জনপ্রিয়তা নেই। মিম, রোস্ট লেগেই থাকে তাঁকে নিয়ে। অথচ তাঁর বক্স অফিসের ফলাফল কিন্তু সে কথা বলছে না। যে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করে হিট করেছে টাইগারের সিনেমা, তাতে বোঝা যায় নিজের ফ্যানবেস তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কিন্তু আপনারা কি জানেন তাঁর অদ্ভুত বংশগাঁথা? জানেন কি তাঁর দাদু অর্থাৎ মাতামহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন? আজ আপনাদের জন্যে রইল রঞ্জন দত্তের অজানা কিছু তথ্য।

টাইগারের ঠাকুর্দা, মানে জ্যাকি শ্রফের বাবা ছিলেন গুজরাটি, মা তুর্কমেনিস্তানি। মঙ্গোলিয়ান-চাইনিজ এক মুসলমান ঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। টাইগারের মা আয়েসা দত্তের জন্ম বাঙালি পরিবারে। বাবা রঞ্জন দত্ত ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলট ছিলেন। আয়েশার মা আবার ফরাসী। আরবাজ খানের শো ‘পিঞ্চ’-এ এসে টাইগার জানিয়েছিলেন এই অদ্ভুত মিশ্রণের কথা। এবং তাঁর প্রশ্ন ছিল, “তাহলে আমার পরিচয় কী? এর কোনও উত্তর নেই।” কিছুদিন আগে ইনস্টাগ্রামে আয়েশা নিজের বাবাকে নিয়ে একটি পোস্ট করেন। সঙ্গে কয়েকটি পুরনো ছবি। তাতে সৈনিকের বেশে দেখা যাচ্ছে রঞ্জন দত্তকে। আয়েশা লিখেছেন, এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন রঞ্জনের বয়েস বড় জোর আঠেরো উনিশ। টাইগারের দাদু তখন টাইগার ফ্লাই নামক যুদ্ধবিমান উড়াবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। রঞ্জনের মেয়ে হিসেবে গর্ব বোধ করেন বলেও জানান আয়েশা। এই পোস্টের পর থেকেই ঝড় উঠেছে নেটিজেনদের মধ্যে, কেউ করছেন প্রশংসা, কেউ জয় হিন্দ বলে সম্মান জানাচ্ছেন, অনেকে আবার এ নিয়ে সন্দিহান।

সত্যিই রঞ্জন দত্ত ভারতীয় সেনায় ছিলেন। তিনি সেই সমস্ত হাতে গোনা ভারতীয় পাইলটদের মধ্যে একজন, যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের আকাশে যুদ্ধবিমান উড়িয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। রঞ্জন দত্ত এয়ার ভাইস মার্শালও হয়েছিলেন। ১৯২২ নাগাদ জন্মান রঞ্জন। দেরাদুনের প্রিন্স অফ ওয়ালেসেস রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। স্কুলে পড়তে পড়তেই চুপিচুপি প্লেন চালানো শিখে ফেলেন রঞ্জন। লাইসেন্সের পরীক্ষায় ‘এ’ পেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়েস মাত্র ষোল বছর। ১৯৪০ সালের পয়লা আগস্ট ভারতীয় বায়ুসেনার চতুর্থ পাইলট কোর্সে ভর্তি হন। যদিও নিজের বয়েস বছর খানেক বাড়িয়ে বলেছিলেন রঞ্জন, নৈলে সুযোগ মিলত না। যে ২৪ জন ভারতীয় অফিসারদের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পিছন পিছন সে বছরই ব্রিটেইনে পাঠায় সরকার, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁদের কাজ ছিল নিজেদের সাপ্লিমেন্টারি র‍্যাফ প্রশিক্ষনে এবং র‍্যাফ স্কোয়াড্রন সার্ভিসে শিক্ষিত করে তোলা। তিনিই সম্ভত প্রথম ভারতীয়, যিনি জেট প্লেন চালিয়েছিলেন। ব্রিটেনের ৩২ নম্বর স্কোয়াড্রন তখন বিখ্যাত। পিট ব্রাদার্স এবং বব স্ট্যানফোর্ড-টাকের কথা তখন জেনে গিয়েছে সারা বিশ। তাঁদেরই পাশাপাশি লড়েছেন রঞ্জন। মাত্র তিনজন ভারতীয় পাইলটকে নেওয়া হয়েছিল ৩২ নম্বর স্কোয়াড্রনে। রঞ্জন তাঁদের মধ্যে একজন। প্রথম দিকে তাঁদের কাজ ছিল মূলত প্রতিরক্ষার। কিন্তু ফ্রান্সে যুদ্ধের সময় আক্রমণাত্মক চরিত্রের জন্যেই তারা খ্যাতি লাভ করে। দিনের বেলাতেও ফ্রান্স ও ডাচ উপকূলের আকাশে চক্কর কাটা, বোম্বারদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করত এই স্কোয়াড্রন। এরপরে সামান্য কিছুদিনের জন্যে ৯৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের সঙ্গে মধ্য প্রাচ্যেও যুদ্ধে অংশ নেন রঞ্জন। এরপরে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

আরও পড়ুন-বৃদ্ধ বিমানেই কেন বারবার ভরসা রাখছে বামেরা?

১৯৪২ সালে ভারতে ফিরলে, তাঁকে ভারতীয় বায়ুসেনার ৪ নম্বর স্কোয়াড্রনে মোতায়েন করা হয়। কোহাটে তাঁদের দায়িত্ব ছিল একটা ওয়েস্টল্যান্ড লাইজ্যান্ডার বিমানে করে সারাক্ষণ কড়া নজর রাখা। পরে নির্দেশক হয়েছিল। প্রথম ভারতীয় ইন্সট্রাক্টরদের একজন ছিলেন। ১৫১ ও টি ইউ, রসুলপুরে তখন পোস্টিং। ১৯৪৪-এ চলে গেলেন বার্মা। আরাকানে কুড়ি নম্বর স্কোয়াড্রনের সদস্য করে প্রথমে পাঠানো হল তাঁকে। ইম্ফলের যুদ্ধ হল পুরোটাই মাটিতে, তখন কাজ বিশেষ ছিল না কয়েকদিন। ফের ডাক পড়ল। আই এ এফের এক নম্বর স্কোয়াড্রনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এই স্কোয়াড্রনের প্রধান ছিলেন অর্জন সিং, যিনি পরে ভারতীয় বায়ুসেনার মার্শাল হয়েছিলেন। আই এ এফের দশ নম্বর স্কোয়াড্রন তখন হারিকেন নিয়ে যুদ্ধে যেত। সেই হারিকেনও উড়িয়েছেন রঞ্জন তাঁদের সঙ্গে। পরের বছর ইংল্যান্ডে প্রথম কয়েকজন ভারতীয়কে ডে ফাইটার লিডারস কোর্সের জন্যে বাছা হয়। সে সময় এই কোর্সে নির্বাচিত হওয়া ছিল খুবই গর্বের বিষয়। সেখানেও নির্বাচিত প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে ছিলেন রঞ্জন। ডিস্টিংশন পেয়ে কোর্স সম্পূর্ণ করেন। সে সময় কিংবদন্তি পাইলট ডগলাস বেডার নাকি খুব তারিফ করেছিলেন রঞ্জনের।

সে সময় ট্যাংমেয়ার শত্রু পক্ষের বিমান চালানোও শেখাত। যুদ্ধবন্দি জার্মান বিমানের সঙ্গে ব্রিটিশ জেটের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন তখন বিজ্ঞানীরা। রঞ্জন এতেও সুযোগ পান। গ্লোস্টার মেটিওর ফাইটার জেটের একেবারে প্রথম দিকের একটা মডেল চালাতে শেখেন। এমনকি জার্মান ফোক-উলফ এফ ডব্লিউ ১৯০-ও চালিয়েছিলেন। দশক দুয়েক বাদে ব্যাঙ্গালোরে এই বিমানের ডিজাইনার ডঃ কার্ট ট্যাঙ্কের সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে গিয়ে রঞ্জন একে “অপূর্ব বিমান” বলে আখ্যা দেন। সে বছরেরই অগাস্টে ফের বার্মায় পোস্টিং করা হয় তাঁকে। এবার কমাণ্ডার হিসেবে। ট্যাংমেয়ারে শেখা নানান বিদ্যা কাজে লাগিয়ে আট নম্বর স্কোয়াড্রনকে স্পিটফায়ার পনেরো-তে বদলে ফেলেন তিনি। স্বাধীনতার পরেও সেনাবাহিনীতে নিজের কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন রঞ্জন। ১৯৪৭-৪৮-এ আই এ এফের এস এ এস ও হিসেবে বহাল করা হয় তাঁকে। কাশ্মীরের কিষেনগঙ্গা ব্রিজের উপর বহু আক্রমণ তিনি করেছেন নিজে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে। দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করার পর অবসর নেন রঞ্জন দত্ত। তার পরে তাঁকে আর তেমন দেখা যেত না। তিনি ইউরোপে চলে গিয়েছিলেন কয়েক বছরের জন্য। ফিরে এসে ছেলের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন চেন্নাইতেই। মেয়ে আয়েশা তখন ‘তেরা বাহো মে’ নামক সিনেমায় অভিনয় করেছে, জ্যাকি শ্রফকে বিয়ে করেছে, নিজে সিনেমার প্রযোজক হয়ে গিয়েছে। ২০০৯-এর ১৩ অগাস্ট চেন্নাইতেই মারা যান রঞ্জন দত্ত। তখন তাঁর বয়েস ৮৭। তাঁর স্মৃতিচারণেই ইনস্টায় আয়েশার ওই পোস্ট।

More Articles