দুর্ঘটনা কেড়েছিল দুই পা, এক হাত! সব অক্ষমতাকে হারিয়ে যেভাবে এভারেস্ট ডিঙোলেন যুবক

Tinkesh Kaushik: সেই অদম্য বুকের পাটা নিয়েই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করে ফিরলেন যুবক। তিনিই বিশ্বের প্রথম মানুষ, যে তিনটি অঙ্গচ্ছেদ নিয়ে এভারেস্ট জয় করলেন।

পাহাড় ডিঙানো কঠিন। এভারেস্ট জয় তো আরওই। দুর্গম পথ, চরম আবহাওয়া, অক্সিজেনের কমতি। সব কিছুই প্রতিনিয়ত পথে বিছিয়ে দেয় আরও কাঁটার পর কাঁটা। এর আগে এভারেস্ট জয় করেছেন অনেকেই। কিন্তু গোয়ার বাসিন্দা টিঙ্কেশ কৌশিকের জন্য কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয় মোটেও। মাত্র তিরিশ বছর বয়সেই তিনি খুইয়েছেন দুটি পা, বাঁ হাতের কাঁধ থেকে বাকি অংশটাও উধাও। তবে শরীরে অঙ্গ কম থাকলেও বুকে সাহসের কমতি কোনও দিনই ছিল না টিঙ্কেশের। সেই অদম্য বুকের পাটা নিয়েই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করে ফিরলেন যুবক। তিনিই বিশ্বের প্রথম মানুষ, যে তিনটি অঙ্গচ্ছেদ নিয়ে এভারেস্ট জয় করলেন।

মাত্র ৯ বছর বয়স তখন। হরিয়ানায় থাকতেন টিঙ্কেশ। একটি বিদ্যুৎজনীত দুর্ঘটনায় দুটি পা এবং একটি হাত হারান তিনি। জীবনটা বদলে যায় এক নিমেষে। নিজের দুটো পা, একটা হাতের জায়গায় চিকিৎসকেরা বসিয়ে দেন প্রস্থেটিকের কয়েকটা অঙ্গ। সেসব কাজ চালিয়ে দেয় বটে, তবে তা দিয়ে জোরে হাঁটাই দুষ্কর, তো পাহাড় চড়া। কিন্তু হাল ছাড়েননি টিঙ্কেশ। যা ছিল তাঁর শারীরিক দুর্বলতা, সেই দুর্বলতাকেই সম্বল করে শুরু হয় অধ্যবসায়। ক্রমে শরীরচর্চায় মন দিতে থাকেন টিঙ্কেশ। ২০২১ সাল নাগাদ ফিটনেস কোচের কাজ নিয়ে গোয়ায় চলে আসেন তিনি। সেটা ছিল তাঁর প্রথম পাহাড় ডিঙানো। ভীষণ রকম মনের জোর দিয়ে শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন টিঙ্কেশ সেবারই। প্রায় প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে জিমে শরীরচর্চা করেন তিনি। এর অন্যথা হয় না কখনও।

আরও পড়ুন: ছক ভাঙা পেশা! ১৯ পেরিয়ে কুড়িতম মাতৃত্বের পথে বছর ঊনচল্লিশের মহিলা

তবে তাতেই থামেনি টিঙ্কেশের লড়াই। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এবার পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করতে চাইলেন তিনি। এভারেস্টের বেস ক্যাম্পটির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭,৫৯৮ ফুট উপরে। যেখানে তাপমাত্রা থাকে প্রায় মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। আর সেখানে পৌঁছনোর রাস্তা যেমন দুর্গম, তেমনই ভয়ঙ্কর। মাইনাস তাপমাত্রা, তার উপর সময়-অসময়ে তুষারঝড়, আবহাওয়ার পরিবর্তন। উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি- গোটা পথটাই বন্ধুরতায় ভরা। শারীরিক অক্ষমতা যাঁর নেই, তাঁর জন্যই সে পথ বিপদসংকূল, সেখানে টিঙ্কেশের জন্য যে এ লড়াই কয়েক গুণ শক্ত ছিল বলাই বাহুল্য।

 

বন্ধু বলতে ওই প্রস্থেটিক হাত-পা। সেগুলো হাত-পায়ের মতো দেখতে নয় একেবারেই। কিন্তু ওগুলোই ছিল টিঙ্কেশের কাছে পক্ষীরাজ ঘোড়া। ওদের ভরসাতেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিরিশের এই যুবক। এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে সময় লেগেছে তাঁর আট দিন মতো।নেপাল থেকে গাইড ও একজন ট্রেক লিডারকে সঙ্গী করে প্রায় ৬ কেজি ওজনের ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে শেষপর্যন্ত পাহাড় ডিঙোলেন টিঙ্কেশ। এই আট দিনের প্রতিদিন প্রায় ৯-১০ কিলোমিটার করে ওই দুর্গম আবহাওয়ায় হাঁটতে হয়েছে তাঁকে। কখনও কখনও শরীর ভেঙে পড়েছে ক্লান্তিতে, কখনও মাউন্টেন সিকনেস এসে শরীরকে চলচ্ছক্তিহীন করে ফেলেছে। তবু হিম্মত হারাননি টিঙ্কেশ। গত ১১মে ট্রেক শেষ করেন তিনি।

প্রতিদিন ওই ঘণ্টা দুয়েকের শরীরচর্চা, জিম করার অভ্যেস আসলে তাঁকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছে। প্রস্তুতি হিসেবে নিয়মিত ৫-১০ কিলোমিটার রাস্তা হাঁটতেন টিঙ্কেশ। আর সেই অদম্য সাহস আর পরিশ্রম করার মনের জোর নিয়েই বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গজয়ের ইতিহাসের নিজেকে শামিল করেছেন তিনি। এমন দুঃসাহসীক কাজ অবশ্য প্রথম নয় টিঙ্কেশের জীবনে। ২০১৮ সাল নাগাদ নেপাল থেকে বাঞ্জি জাম্পিং করেন তিনি। বছর তিনেক বাদে পুদুচ্চেরিতে গিয়ে সেরে ফেলেন স্কুবা ডাইভিং। অবশেষে এভারেস্ট ছুঁয়ে আসার স্বপ্নটাকেও ছুঁয়েই ফেললেন টিঙ্কেশ।

আরও পড়ুন:এভারেস্টজয়ীরাও ভয় পান! পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত এটিই…

টিঙ্কেশের এই সাফল্য গর্বিত করেছে গোয়াকেও। ডিসেবিলিটি রাইটস অ্যাসোসিয়েশন অব গোয়া (DRAG)-এর প্রধান অ্যাভেলিনো ডি'সুজা তেমনটাই জানিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। পাহাড় চড়ার ব্যাপারে কিন্তু একেবারেই নবিশ টিঙ্কেশ। এর আগে ট্রেকিংয়ের সামান্যতম অভিজ্ঞতাও ছিল না তাঁর ঝুলিতে। তা সত্ত্বেও অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন মনের জোরে। প্রথম দিকটায় শরীরে ভয়ঙ্কর কষ্ট হত। তখন নিজেকে একটানা বলে গিয়েছেন, পারতেই হবে। আর সেই মনের জোরই জিতিয়ে দিল তাঁকে শেষমেশ। টিঙ্কেশই বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি, যিনি তিন-তিনটি অঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও যাকে বলে ৯০ শতাংশ লোকোমোটর ডিসেবিলিটি, সেই নিয়েই এভারেস্ট চড়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, মনের জোর থাকলে সব সম্ভব। এমনকী পাহাড় ডিঙানোও।

More Articles