লোভীদের স্বর্গরাজ্য তৃণমূল, টিকিট না পেলেই আলবিদা বলেন যারা
TMC Candidate List 2024: মমতা নিজে দেবকে প্রার্থী করতে চান। তাই মত বদলে নেন দেব। ফের ঘাটালে তাঁকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তবে মিমির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে। তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও আর আমি বসে চিনেবাদাম খাই, এমনটা হালফিলের রাজনীতিতে আর নেই। গত দু'দশকে রাজনীতিতে জনপ্রিয় হয়েছে তাই কিছু শব্দবন্ধ, কিছু ট্যাগলাইন। মানুষের মাথায় দলবদলু, দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না জাতীয় রাজনৈতিক কথা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের থেকে 'আদর্শ' প্রত্যাশা করা কি তাহলে ভুলেই গেল মানুষ? ভুলিয়ে দেওয়ার আয়োজন বিবিধ। বাংলার শিশুও আজকাল জানে, যতজন মানুষ লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল বা অন্য দল থেকে বিজেপিতে যাচ্ছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে আবার অনেকেই ফিরে আসবে তৃণমূলে। এই আসা যাওয়ার মাঝে বাংলার রাজনৈতিক অভিধান থেকে আদর্শ, দলীয় নীতি জাতীয় শব্দগুলি হাপিশ। টিকিট না দিলে দল ছেড়ে দেওয়া, দল বদলে নেওয়া বড্ড সহজ। তার জন্য পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদও হতে হয় না। রাজনীতির ব্যবসায় লাভের মুখ না দেখলে দলত্যাগকেই বেছে নেন নেতারা। তা সে তৃণমূলের দীর্ঘদিনের নেতা তাপস রায় হন বা সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। টিকিট নেই তো আমিও নেই!
রবিবার জনগর্জন সভা হয়েছে দুপুরে। সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়ে গেছে। আর রাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, সায়ন্তিকা আশা করেছিলেন বাঁকুড়া থেকে তাঁকে প্রার্থী করা হবে। কিন্তু তার বদলে সেই আসন থেকে প্রার্থী করা হলো অরূপ চক্রবর্তী। তালডাংরার বিধায়ক ছিলেন অরূপ। টিকিট না পেয়ে মনের দুঃখে ইস্তফা!
আরও পড়ুন- তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা: বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই দুর্বল প্রার্থী?
এমনটা যে হবেই তা জনগর্জনের মঞ্চেই বোঝা গেছিল। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে জনসভা শেষ হয় কিন্তু অতক্ষণের জন্য অপেক্ষা করেননি সায়ন্তিকা। বাঁকুড়া কেন্দ্রে তিনি নেই, কোথাও তিনি নেই- এতটুকু বুঝে যাওয়ার পরেই ফোনে কথা বলতে বলতে মঞ্চ থেকে নেমে যান সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কে? কেন তাঁকে টিকিট দিতেই হবে? রাজনীতির ময়দানে কী তাঁর অবদান?
২০০৯ সাল থেকে সিনেমা করছেন। কোনও সিনেমাই ব্যাপক হিট, বাংলা কাঁপানো তা নয়। অভিনয়েও নিজের পৃথক কোনও গুণ দেখাতে পারেননি। তাতে কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে সায়ন্তিকার হাতে 'মহানায়ক সম্মান' তুলে দিয়েছেন। ২০২১ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে তাঁর ইচ্ছে হয় দেশের সেবা করবেন। দলও বাঁকুড়া থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করে তাঁকে। কিন্তু হেরে যান সায়ন্তিকা। বিজেপির নীলাদ্রি শেখর ডানা জিতেছিলেন, যদিও ভোটের ব্যবধান ছিল সামান্যই। ভোটে হারলেও তাঁকে দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক করা হয়। বাঁকুড়াতে নিয়মিত যেতে থাকেন তিনি। কিন্তু টিকিট পেলেন শেষে তালড়াংরার বিধায়ক? সায়ন্তিকা অবশ্য পরে বলছেন যে ইস্তফাপত্রটি দেখা যাচ্ছে সেটি ভুয়ো। তিনি পদত্যাগ করেননি। কিন্তু খুউউব অভিমান হয়েছে।
সায়ন্তিকা বলেছেন, “৩ বছর ধরে মাটি কামড়ে পড়েছিলাম, পঞ্চায়েতেও ভালো ফল হয়েছিল। কী কারণে টিকিট পেলাম না, দল আগে জানলে ভাল হত।" একবারও কোনও ভোটে না জিতে, ৪ বছর রাজনীতি করে সোজা লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ হয়ে দেশের সেবা করার খোয়াব দেখছেন সায়ন্তিকা! বঙ্গ রাজনীতি এ কোন কবরডাঙায় যে এল! অভিমানী সায়ন্তিকা বলেছেন, হেরে যাওয়ার পর থেকে বাঁকুড়ায় মাটি কামড়ে পড়েছিলেন তিনি। শ্যুটিং বাতিল করে দলের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঁকুড়া গেছেন। তাও টিকিট নেই! পদত্যাগপত্র যদি ভুয়োও হয়, গোঁসা তো খাঁটি! দলের কাজ করার জন্য, সেবা করার জন্য টিকিট পেতেই হবে? কীসের লোভ?
সায়ন্তিকা একা নন। ব্যারাকপুর কেন্দ্র থেকে টিকিট না পেয়ে রবিবারই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্জুন সিংও। ব্যারাকপুর রাজনীতির রঙিন চরিত্র অর্জুন। অথচ ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শিবিরের সেচ মন্ত্রী পার্থ ভৌমিককে ব্যারাকপুরে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। অর্জুন স্বাভাবিকভাবেই রেগে গিয়েছেন। তৃণমূল শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসভঙ্গ করেছে বলে মনে করছেন তিনি। অর্জুন সিং কিন্তু খাতায়কলমে বিজেপির সাংসদ। ওই আসা যাওয়ার মাঝের পর্বের তুখোড় খেলোয়াড় অর্জুন। বিজেপি থেকে তাই আবার তৃণমূলে ফিরতে চাইলে দলের অনেকেই খুশি হননি। সবচেয়ে বড় আপত্তি ছিল নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকের, যাঁকে এবার টিকিট দেওয়া হলো ব্যারাকপুরে। অর্জুনকে যাতে ব্যারাকপুরে প্রার্থী করা না হয় সেজন্য পার্থ তাঁর ঘনিষ্ঠদের দিয়ে এলাকায় গণসাক্ষর সংগ্রহও করিয়েছেন।
আরও পড়ুন- প্রার্থীতালিকায় কেন নেই নুসরত, মিমি, অর্জুনরা? কী স্ট্র্যাটেজি তৃণমূলের?
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্জুন সিংকে টিকিট না দিয়ে দীনেশ ত্রিবেদীকে প্রার্থী করে। চটে গিয়ে দল ছেড়ে দেন অর্জুন সিং! তারপর বিজেপির টিকিটে লড়ে দীনেশকে হারিয়ে দেন। আবার তৃণমূলে ফিরে এসে এখন টিকিট না পেয়ে তাঁর মনে হচ্ছে বিজেপি ত্যাগ না করলেই হতো। অর্জুন কখন ঘাসফুল কখন পদ্মফুল তা মনে রাখাই দুষ্কর হয়ে গেছে এখন।
কিছুকাল আগে যাদবপুরের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী ইস্তফা দিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে মিমিকে সেভাবে সংসদে দেখা যায়নি। যাদবপুর লোকসভার এলাকাতেও মিমি সময় দেননি। দলের মধ্যেই অনেকে ছিলেন অসন্তুষ্ট। তারপর মিমি সমস্ত পদ ছেড়ে দেন। রাজনীতিকে আলবিদা বলে চলে যান। বিশ্লেষকরা বলছেন মিমির পারফর্ম্যান্স দেখে এবারের নির্বাচনে তাঁকে টিকিট দেওয়া হতোও না। তা আগেভাগে আন্দাজ করেই মিমি চক্রবর্তী ইস্তফা দিয়েছেন। ঘাটালের সাংসদ-অভিনেতা দেবও খানিক এই পথেই হাঁটছিলেন। কিন্তু ঘাটালে দেব জনপ্রিয়, মানুষের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। মমতা নিজে দেবকে প্রার্থী করতে চান। তাই মত বদলে নেন দেব। ফের ঘাটালে তাঁকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তবে মিমির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। দল যখন কিছু দিচ্ছে না মিমিই বা কেন দলে রইবেন?
মানুষের সেবা করতে টিকিট পাওয়া জরুরি কারণ জেতা মানেই ক্ষমতা পাওয়া। ক্ষমতা আর অর্থের যোগাযোগ অত্যন্ত স্পষ্ট। তাই সামান্য কয়েক মাস রাজনীতি করে, মানুষের সঙ্গে ন্যূনতম যোগ না থাকা নায়িকারা, তারকারাও ভাবেন রাজনীতির কেরিয়ারে যত দ্রুত সম্ভব আখের গোছাতে হবে। আদর্শের তাতে কোনও ঠাঁই নেই। যে দেবে, বান্দা তাঁর! আসলে জনপ্রতিনিধি নয় আসলে লোভী কিছু মানুষকে নিয়ে এগোয় শাসকের রথ।