তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা: বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই দুর্বল প্রার্থী?
TMC Candidate List 2024: এবার ১১ জন বিধায়ককে লোকসভা ভোটে দাঁড় করাতে হয়েছে তৃণমূলকে। তৃণমূলের প্রার্থীভাণ্ডারের এমন দেউলিয়া দশা কেন?
জনগর্জন সভা। লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের তরফে ব্রিগেডের এই সভা যে গুরুত্বপূর্ণ হবেই তা আন্দাজ করেছিলেন সকলে। তবে গুরুত্বের পরতে পরতে এত চমক অপেক্ষা করে ছিল, কে জানত! সভা থেকেই ৪২ টি লোকসভা আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই তালিকা দেখে অবাক হওয়াই উচিত! শক্ত ঘাঁটিতেও দুর্বলতম প্রার্থী দিয়েছে তৃণমূল! বিজেপিকে আসন পাইয়ে দেওয়ার বোঝাপড়া দেখছেন অনেক বিশ্লেষকই! রাজ্যের অন্তত ১২ টি আসনে তৃণমূলের প্রার্থীর নাম দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিরোধী বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে আগেই! বাইরে বিরোধিতার আড়ালে রয়েছে নিবিড় অঙ্ক কষাকষি।
কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন যাদবপুর। কবীর সুমন, সুগত বসু, মিমি চক্রবর্তীরা জিতেছেন তৃণমূলের টিকিটে। সেই আসনে এবার বিজেপি প্রার্থী করেছে অনির্বাণ গাঙ্গুলিকে। আর তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের সায়নী ঘোষ! যুবনেত্রী সায়নীকে ঘরের মেয়ে বলে প্রচার করলেও আসলে তিনি অত্যন্ত দুর্বল প্রার্থী। সায়নীর বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বাড়ি-গাড়ি কেনার অভিযোগ আছে। ডাঃ অনির্বাণ গাঙ্গুলি বোলপুর-শান্তিনিকেতন বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে লড়েন এবং ৪০.৮৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই একই আসনে বিজেপি মাত্র ১৯,০০০ ভোট পেয়েছিল। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ ফাউন্ডেশন চেয়ারপার্সন অনির্বাণ গাঙ্গুলি নিঃসন্দেহে এবারের বিজেপির শক্তিশালী প্রার্থী। যাদবপুর কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে ভাঙড়। নৌশাদ সিদ্দিকীর যা দাপট তাঁর কেন্দ্রে, সেখানে জোড়াফুল ফোটাতে পারবেন সায়নী?
আরও পড়ুন- ভোটে হেরেও ছিলেন মমতার বিশ্বস্ত! অভিনয় থেকে দুর্নীতিতে যেভাবে নাম জড়াল সায়নী ঘোষের
বহরমপুরে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন ক্রিকেটার ইউসূফ পাঠান। মুসলিম নাম দিয়ে মুসলিম ভোট টানার চেষ্টা। কিন্তু অধীরের গড় বহরমপুরের সঙ্গে ইউসূফ পাঠানের সম্পর্ক কী? বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট নেই বলে জানিয়েও কি তাহলে কংগ্রেসের জন্য দরজা খোলা রাখলেন মমতা?
দার্জিলিং আসনে তৃণমূলের প্রার্থী গোপাল লামা। ২০০৯ সাল থেকে এই আসনে জিতছে বিজেপি। এবার অজয় এডওয়ার্ডকে প্রার্থী করতে পারে কংগ্রেস। গোপাল লামাকে প্রার্থী করায় মমতা বিরোধী গোর্খাল্যান্ডের ভোট বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যেই ভাগ হয়ে যাবে না এতে?
প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদকে বর্ধমান দুর্গাপুর আসন থেকে প্রার্থী করছে তৃণমূল। বিহারের দারভাঙ্গা থেকে বিজেপির টিকিটে সাংসদ হয়েছিলেন কীর্তি। ক্রিকেটে বেনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য তাকে বিজেপি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তারপর কীর্তি আজাদ ২০১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০২১ সালে আসেন তৃণমূল কংগ্রেসে। বর্ধমান দুর্গাপুর আসনে কোনওগ্রহণ যোগ্যতাই নেই কীর্তির। তৃণমূল কি নিজের রাজ্যের প্রার্থী পাচ্ছে না? আসানসোলে বিজেপির পবন সিং যদি বহিরাগত হন তাহলে ইউসূফ পাঠান, কীর্তি আজাদরা কীভাবে ঘরের ছেলে হন?
২০১৯ সালে পুরুলিয়া আসনে তৃণমূলের মৃগাঙ্ক মাহাতোকে হারান বিজেপির জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো এই অঞ্চলে গত ৫ বছরে নিজের স্থান পোক্ত করেছেন। তিনি এলাকার জনপ্রিয় কুর্মী মুখ। সেখানে এবার শান্তিরাম মাহাতো প্রার্থী তৃণমূলের। পুরুলিয়া আসনে আগে ফরওয়ার্ড ব্লকের বীর সিং মাহাতোর কাছে হেরেছিলেন তিনি। পুরুলিয়া অঞ্চল বিজেপির গড়। সেখানে দুর্বল প্রার্থী দিয়ে আগে থেকেই পরাজয় স্বীকার করছে তৃণমূল? বর্ধমান পূর্বে তৃণমূলের শর্মিলা সরকারও নতুন মুখ। কেনই বা তাঁকে বাছা হলো কারণ অজানা!
ব্যারাকপুরে কল কারখানার প্রাধান্যের কারণে হিন্দিভাষিদের কিঞ্চিৎ দাপট আছে। অর্থাৎ বিজেপির দখল আছে। এখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শিবিরের পরিচিত মুখ পার্থ ভৌমিক কতটা দাগ কাটতে পারবেন, সন্দেহ আছে।
আরও পড়ুন- ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নাম প্রত্যাহার, কেন বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন না পবন সিং?
মালদা দক্ষিণে তৃণমূলের দুর্বলতম প্রার্থী শাহনওয়াজ আলি রায়হান। অক্সফোর্ড থেকে বাংলায় মুসলিম এবং কমিউনিজম বিষয়ে গবেষণা করা শাহনওয়াজ এককালে ব্যাপক তৃণমূল বিরোধী ছিলেন, এখন তৃণমূল প্রার্থী। এই আসনে কংগ্রেসের হয়ে সম্ভবত ঈশা খান দাঁড়াবেন। বিজেপিও লড়াই দিতে ছাড়বে না। এই আসনও কি তবে বহরমপুরের মতোই কংগ্রেসের জন্য ছেড়ে রাখলেন মমতা?
পূর্ব মেদিনীপুর শুভেন্দুর গড়। সেখানে তমলুকের মতো আসনে বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রার্থী হলে দেবাংশু ভট্টাচার্যের মতো নতুন নেতা তাঁকে কতটা লড়াই দেবেন?
হাওড়া আসনে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় থাকছে। নবীন প্রবীণ ভারসাম্য রেখে উত্তর কলকাতায় আবার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করলেও এই অঞ্চলে বিজেপির দাপট এবার চিন্তায় ফেলবেই তৃণমূলকে। দমদমেও সৌগত রায় জিততে পারবেন কিনা সন্দেহ রইছেই।
এবার ১১ জন বিধায়ককে লোকসভা ভোটে দাঁড় করাতে হয়েছে তৃণমূলকে। কৃষ্ণ কল্যাণী, অরূপ চক্রবর্তী, জুন মালিয়া, পার্থ ভৌমিক, বিশ্বজিৎ দাস, মুকুটমণি অধিকারী, বিপ্লব মিত্র, নির্মলচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া, উত্তম বারিক, হাজি নুরুল ইসলাম- সবাই বিধায়ক। তৃণমূলের প্রার্থীভাণ্ডারের এমন দেউলিয়া দশা কেন? তালিকা দেখে তাই প্রশ্ন উঠছেই, বিজেপি আর কংগ্রেস দু'পক্ষের জন্যই কি তৃণমূল দরজা খোলা রাখছে? বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী দেখলে মনে হওয়া কি স্বাভাবিক নয় হাতে করে তুলে দেওয়া হচ্ছে ওই আসন? যদি বিজেপি ২০-র বেশি আসন পায় তাহলে ২০২৬ পর্যন্ত মমতা সরকার রাখতে পারবেন তো? তাপস রায়ের মতো তৃণমূলের বিশ্বস্ত লোকও যদি বিজেপিতে চলে যান, তাহলে অন্য নেতাদের যে বিজেপির কাছে মাথা বন্ধক রাখা নেই তা নিশ্চিত তো?