ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরতে বাধ্য হলেন মহানায়ক, নেপথ্যে ছিল সুচিত্রা সেনের 'দুষ্টুমি'!
Uttam Kumar: 'সপ্তপদী'-র শুটিংয়ে ঠিক কী ঘটেছিল?
ফুটবলপ্রেমী মানুষটা শটটা মেরেই চেঁচিয়ে উঠছেন, 'গোওওওল'! হঠাৎ কোঁকানোর শব্দ। অ্যাঁ! সে কী! মাঠ কোথায়? এ তো খাট। ওপাশ থেকে স্ত্রী-র আওয়াজ। কিন্তু স্ত্রী কই? শেষে খাটের ওপাশে মেঝেতে তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল। এতক্ষণে বোঝা গেল, ঘুমের মধ্যেই ভদ্রলোক 'গোওওওল' বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন। এবং সেই শটখানা ঠিক কোনখানে লেগেছিল।
'ধন্যি মেয়ে'-র সেই দৃশ্য বাঙালির ঘরে ঘরে আলোচিত। এখনও টেলিভিশনে সেই ছবি দেখতে দেখতে হেসে গড়িয়ে পড়েন দর্শক। সেই ছবিতেই একখানা গান ছিল, 'সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল'! সত্য বটে। জাতীয়তাবাদের হাত ধরে বাংলায় মোহনবাগানের পথচলা শুরু। ঔপনিবেশিক সময়ের সেই খেলা, পরবর্তীতে মোড় নিল অন্যদিকে। দেশভাগের যে বিপুল ক্ষত, তা বাঙাল-ঘটির মিষ্টিমধুর লড়াই-ঝগড়ায় ভাগ করে নিয়েছিল বাঙালির যৌথমানস। সেই লড়াইয়েরই একটা সুস্থ হাড্ডাহাড্ডি উত্তেজনার ঝোঁক দেখা গিয়েছিল কলকাতা ডার্বির মধ্যেও। ইস্টবেঙ্গল ছিল মূলত বাঙালদের ক্লাব। আর মোহনবাগানের সমর্থক ছিলেন ঘটি-রা। সে নিয়ে বাঙালি দর্শকের মারপিট থেকে পাশের বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এখনও ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির নাড়ির যোগ খানিকটা রয়েছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশভাগের আবেগ নেই, না-থাকাই স্বাভাবিক। এবং আরও বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ধীরে ধীরে নস্টালজিয়ায় পরিণত হচ্ছে। তবে বাঙালির ফুটবলপ্রেমের চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই রঙিন জগতের মানুষরাও প্রায়শই দু'টি শিবিরে ভাগ হয়ে যেতেন।
সেসময় অভিনেতাদের সঙ্গে ফুটবলের যোগাযোগের গল্পও বেশ চলতি। 'সপ্তপদী'-র শুটিং করতে গিয়ে যেমন কিছুতেই ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরতে চাননি অরুণ চাটুজ্জে। মোহনবাগানের গোঁড়া ভক্ত। লাল-হলুদ কিছুতেই গায়ে তুলবেন না। এদিকে মোহনবাগান ক্লাব বন্ধ। আধিকারিরা ইস্ট আফ্রিকা সফরে গিয়েছেন। বাধ্য হয়েই ইস্টবেঙ্গলের কাছে শুটিংয়ের জন্য আসতে হয়েছে মহানায়ককে। তৎকালীন ফুটবল সচিব মন্টু বসু উত্তমের অনুরোধে ক্লাব খুলে শুটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। গোরাদের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচের দৃশ্য। মহানায়কের বল খেলানোর দৃশ্যটা ক্যামেরার সামনে করেছিলেন ইস্টবেঙ্গলেরই খেলোয়াড় তুলসীদাস বলরাম। কিন্তু জার্সি দেখেই বেঁকে বসলেন উত্তম। সাদাকালো ছবিতে রঙটা কোনও ব্যাপার না, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে তুলবেন না কিছুতেই। সুধাময় দাশগুপ্ত ময়দান মার্কেট থেকে ঘুরে এসে বললেন, ময়দান মার্কেটের দোকানপাট নাকি সব বন্ধ। আসলে খোলাই ছিল। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের জার্সিটা মহানায়কের গায়ে উঠুক, তাঁরও বড় ইচ্ছে। কিন্তু উত্তম নারাজ। পরিচালককে নাকি সেদিন প্যাক আপ পর্যন্ত করতে বলে দিয়েছিলেন। বাধ সাধলেন সুচিত্রা। সব কথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, "ওঁকে বলে দিন, জার্সি পরে শুটিং করতে বলা হয়েছে, ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হতে বলা হয়নি। কীসের এত টালবাহানা? শটের জন্য মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করব। তার মধ্যে ব্যবস্থা না হলে এ ছবি ছেড়ে দেব।" এতে কাজ হয়েছিল। সুচিত্রার মেজাজের ভয়ে নাকি উত্তম জার্সিটা পরেছিলেন শেষ অবধি। তারপরে সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য। গোল শোধ করে ক্লেটনকে কনুই চালিয়ে মাঠের বাইরে পাঠানো কৃষ্ণেন্দু বাঙালির কাল্ট হয়ে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। অনেকে বলেন, সুচিত্রা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক বলেই ইচ্ছে করে অমন নকল রাগারাগি করেছিলেন। তাও সম্ভব অবশ্য। এমনিতেই উত্তমের লেগপুল করতে ভালবাসতেন 'মিসেস সেন'। তার ওপর সত্যি সত্যিই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক ছিলেন। নিছক দুষ্টুমির বশেও সেদিন ও-কাজ করতে পারেন। আজ আর জানার উপায় নেই। তবে অভিনেতাদের সঙ্গে ফুটবলের যোগাযোগ বেশ আলোচিত। কিন্তু বাংলা গানের গায়ক-গায়িকা বা গীতিকার সুরকারদের সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল? আজ সেদিকে খানিক নজর ফেরানো যাক।
উত্তম যে খেলাপাগল ছিলেন, তা মোটামুটি সকলেই জানেন। সেকালে টুকটাক নানান উপলক্ষ সামনে রেখে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হতো। ক্রিকেট, ফুটবল। সমস্তরকম। তারকাদের সেই সব খেলা দেখতে ভিড় জমত ভালোই। কখনও কখনও টিকিটের টাকা কোনও বিশেষ ত্রাণ তহবিলে যেত। সেরকমই একদিন উত্তম মরশুমি ক্লাবের আড্ডায় বললেন, "আমাদের 'মরশুমি ক্লাব' ভার্সেস 'টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়ো' একটা ফ্রেন্ডলি ফুটবল ম্যাচের ব্যবস্থা করেছি।" সে সময় মরশুমি ক্লাব মানে গায়ক শ্যামল মিত্র, গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা— কে নেই! সবাই হই হই করে উঠলেন। দারুণ একটা ব্যাপার হবে। পুলক বন্দ্যো বেচারা খেলার ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি। চুপচাপ বসেছিলেন। যদি পার পাওয়া যায় কোনওমতে। তাঁর দিকে তাকিয়েই উত্তম বললেন, "আমরা কিন্তু সবাই খেলব মামা, তোমাকেও খেলতে হবে।" হলো! পার হওয়া দূর, ভাগ্নের চালে মামা একেবারে বিশ বাঁও জলে। মুখ শুকিয়ে আমসি। আমতা আমতা করে বললেন, "অ্যাঁ, আমি?" ভুল মানুষকে ভুল কাজে উৎসাহ জোগানোর লোক কম পড়ে কি? পাশ থেকে বেশ সিরিয়াস হয়ে শ্যামল মিত্তির বললেন, "ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ফ্রেন্ডলি ম্যাচ তো। যতক্ষণ পারবি খেলবি। তারপর উঠে আসবি।" কী আর করা! নিমরাজি হতে হলো গীতিকারকে।
যথারীতি এক রোববার মহামেডান স্পোর্টিং গ্রাউন্ডে হাফপ্যান্টে পুলক বন্দ্যোকে দেখা গেল বাকিদের সঙ্গে। খেলতে নেমেছেন বলে অবশ্য মনে হচ্ছে না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ধীরে ধীরে হাঁটছেন। মরশুমি ক্লাবের হয়ে উত্তম, শ্যামল মিত্তির, ভূপেন হাজারিকা, সুনীল চক্কোত্তি, সুধীর মুখার্জিও নেমেছেন। রতু মুখোপাধ্যায়কে দেখা গেল একেবারে পেশাদার খেলোয়াড়ের ভঙ্গিতে মাথায় একখান রুমাল বেঁধেছেন। ওদিকে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর পক্ষে প্রযোজক দেবেশ ঘোষ, সত্যেন চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। উত্তেজনা তুঙ্গে। খেলা আরম্ভ হলো। উত্তম মরশুমি ক্লাবের ক্যাপ্টেন। দেখা গেল, শ্যামল, রতু, সুনীল বেশ ভালোই খেলা জানেন। উত্তম তো জানেনই। মাঠজুড়ে ওঁরাই খেলছেন। পাশে পাশে হাফ প্যান্ট পরে চশমা সামলাতে সামলাতে পুলকবাবু অহেতুক ছোটাছুটি করছেন। বোঝাই যাচ্ছে, বল কোনদিকে কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। হঠাৎ থমকে দেখেন, কীভাবে যেন বলখানা তাঁর পায়ের কাছে চলে এসেছে। আর অপেক্ষা কেন! হাঁকড়ালেন একটা শট। কিন্তু মরণ! যতক্ষণ পায়ের কাছে ছিল, বলটা বেশ দেখা যাচ্ছিল, মারার পর কোনদিকে গেল আর বুঝতে পারেন না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। উত্তম পাশেই ছিলেন। প্রথমটায় বুঝতে পারেননি মামা এদিক-ওদিক কী খুঁজছে। পরে ব্যাপারখানা বুঝে তাঁর সে কী হাসি! হো হো করে হাসতে হাসতে কোনও মতে বললেন, "মামা, ওই যে বল। স্কাইং হয়ে গেছে।" এই ঘটনা নাকি রসিয়ে রসিয়ে বহু জায়গায় পরে গল্প করতেন মহানায়ক। ফুটবল খেলতে গিয়ে মামা নাকি ফুটবলটাই হারিয়ে ফেলেছিল! যাই হোক, সেদিন মরশুমি ক্লাব এক গোলে জিতে গিয়েছিল। উত্তমের একটা থ্রু শ্যামল মিত্র চমৎকারভাবে এগিয়ে দেন রতুবাবুকে। মাথায় রুমাল বাঁধা রতু মুখোপাধ্যায়ই নায়কোচিত ভঙ্গিতে গোলটা করেন। সেদিনও মাঠের চারপাশে দর্শক উপচে পড়েছিল। তারা অবশ্য ভেবেছিল শুটিং চলছে। খেলায় জিতে গঙ্গার ইলিশ কিনে ভবানীপুরে ক্লাবে ফিরেছিলেন সকলে। বোধহয় সেই সময়েই পুলকবাবুর অবচেতনে লেখা হয়ে গিয়েছিল 'ধন্যি মেয়ে'-র সেই গান।
সেসময় খেলা হলেই ময়দানে পৌঁছে যেতেন সব্বাই। মোহনবাগানের সমর্থক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, দিলীপ মুখার্জি, অনুভা গুপ্ত, পুলক বন্দ্যো-কে দেখা যাবেই যাবে। মাঝে মাঝে নচিকেতা ঘোষ, 'উল্টোরথ'-এর প্রসাদ সিংহ, গিরীন সিংহকেও দেখা যেত। মোহনবাগান গোল করলে সে কী উচ্ছ্বাস! ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য দু'হাত তুলে লাফাচ্ছেন, নচিকেতা ঘোষ একসঙ্গে দুটো সিগারেট ধরিয়ে ফেলছেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ওই লম্বা শরীর নিয়ে পিছনের বেঞ্চটিতে চিৎপাত। প্রসাদ সিংহকে দেখলেই আশপাশের লোকে একটু সরে বসত। কারণ গোলের আনন্দে নাকি এলোপাথাড়ি কিল মারার স্বভাব ছিল তাঁর। এমনও হয়েছে, সেবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা। ইস্টবেঙ্গলের একটা গোল বাতিল করে দিয়েছেন রেফারি কী একটা কারণে। আর ম্যাচখানা জিতে গেছে মোহনবাগান। খেলা শেষে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় পাশাপাশি আসছেন। গাড়িতে উঠতে যাবেন, নজর পড়ল ইস্টবেঙ্গল ব্লক থেকে সদ্য বেরনো পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ওপর। দেখা করবেন বলে এগোলেন দু'জনে। ওঁদের দেখে ভুরু কুঁচকে একেবারে কাঠ বাঙাল ভাষায় মানববাবু বলেলেন, "কে ডা তোমরা? তোমাগো চিনি না।" বলে দিব্যি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। দু'জনেই হতভম্ব। তখনকার দিনে এ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এমনকী, শুধু কলকাতায় নয়, মুম্বইপ্রবাসী বাঙালি শিল্পীদের মধ্যেও ফুটবল নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। রোভার্স খেলার সময় মোহনবাগানের খেলার দিনে ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে 'ডে স্লিপ' নিয়ে তাঁরা হাজির হতেন 'কুপারেজ'-এ। মান্না দে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীনকত্তা, রাহুল দেব বর্মণ— দেখা যেত সক্কলকেই। শচীনকত্তা, পঞ্চম কিন্তু গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। তবু বাংলার টিম বলে মোহনবাগানের খেলা দেখতেও আসতেন। শুধু কি তাই! মোহনবাগান জিতলে খেলোয়াড়দের গেস্ট হাউসে গিয়ে গান শুনিয়ে আসতেন মান্না দে। এতটাই দহরমমহরম ছিল সেকালে গাইয়েদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের।
আজকাল তারকাদের খেলাধুলোর ব্যাপারটা রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছে। দলবদলের চোটে কোনটা কার গোলপোস্ট, সচরাচর তাই বোঝা দায়। কেউ গোল খাচ্ছেন, কেউ মঞ্চেও দিব্যি ড্রিবল করে রোজ গোল দিয়ে আসছেন। কেউ আবার পাস পাওয়ার অপেক্ষায় কোঁচা দিয়ে ঘনঘন চোখ মুছছেন। আপাতত রেফারি নিজেও বড় মাপের খেলোয়াড়। ফলে কী নিয়মে কোথায় কখন কে গোল খেয়ে যাবেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কে বলে তারকাদের ফুটবলপ্রেমে ভাটা পড়েছে! আর সত্যি বলতে কি, ফুটবল খেলা নিয়ে তৈরি একটি বাংলা সিনেমার বাংলা নাম যে 'গোলন্দাজ' হতে পারে, তার উদ্ভাবন বোধহয় আজকের বাংলা ছবির জগতের পক্ষেই সম্ভব।
তথ্য ঋণ:
কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়