শরীরচর্চা নয়, অত্যাচারের জন্যই তৈরি হয়েছিল ট্রেডমিল

‘গেম অফ থ্রোনস’ সিরিজের র‍্যামসে বোল্টনের কথা মনে আছে? থিওন গ্রেজয়-এর উপর অত্যাচারের একের পর এক চরম সীমা পার করে, আরও নতুন, আরও অভিনব কোনও অত্যাচারের পদ্ধতি সবসময় যার আঙুলের ডগায় থাকত! রাজনীতি, যুদ্ধ বিগ্রহ, তুমুল সব শরীরী দৃশ্যের অভূতপূর্ব ব্যবহারের পাশাপাশি অত্যাচারের মাত্রাতেও, এই সিরিজ তামাম বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বারবার। যুদ্ধবন্দীদের ওপর অত্যাচারের জন্য ক্যাসট্রেশন, ক্রুশবিদ্ধ করা, জ্যান্ত অবস্থায় কুকুর দিয়ে খাওয়ানো কিংবা নগ্ন শরীরের উপর বাক্সবন্দী ইঁদুরকে ছেড়ে দেওয়া- কোনওটাই কারও চেয়ে কম যায় না! কিন্তু যুদ্ধবন্দিদের উপর এমন অত্যাচারের ঘটনা কি শুধুই লেখকের কল্পনার দৌড়? একেবারেই না। প্রাচীনকালে গ্রিস, রোম, সিসিলি ইত্যাদি জায়গায় এমন অত্যাচারের ঘটনা হামেশাই ঘটত। আর খোদ ইংল্যান্ডে? কেমন ছিল সেখানকার যুদ্ধবন্দিদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস? কোনও অংশেই কম নয়। আপনাকে যদি বলা হয়, টানা আট থেকে দশ ঘণ্টা ধরে অন্তহীন এক সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে যেতে,  কেমন লাগবে? আপনি হয়তো বলবেন, “এ আর নতুন কী! জিমে গেলে তো রোজই করছি। ট্রেডমিলে হাঁটছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।” ঠিক তাই। ট্রেডমিলের কথাই হচ্ছে। ইংল্যান্ডে জেলবন্দীদের উপর অত্যাচারের জন্য ‘প্রিজন রিহ্যাবিলিটেশন ডিভাইস’ হিসাবেই ট্রেডমিল প্রথম আবিষ্কৃত হয়।

‘পিকে’ সিনেমায় ভিনগ্রহের বাসিন্দা পিকে মাগনায় খাওয়া-পরা পেতে জেলে ঢুকে যেত। একবার ঢুকলে ব্যাস, খাও, পিও, মৌজ কর! খাটাখাটনি নেই, ক’দিন পরে গায়ে গত্তিও লাগবে। কিন্তু বন্দিদের এত সুখ কি আর কর্মকর্তাদের চোখে সহ্য হয়? এসেছে তো কোনও অপরাধ করে। দাও পাঠিয়ে ওদের জোরদার সব খাটনির কাজ করতে। কাজ করার ব্যবস্থা নেই? তবে ব্যবস্থা করো। সেই ব্যবস্থার সুবাদেই ইংল্যান্ডের জেলখানায় ১৮১৮ সালে একজন ইংরেজ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্যার উইলিয়াম ক্যুবিট এইসব তথাকথিত ‘অলস, নিষ্কর্মার ঢেঁকি’ জেলবন্দীদের জন্য ‘Trade Wheel’ নামে এক যন্ত্র তৈরি করেন। চব্বিশটা স্পোকওয়ালা এক বিশালাকার, পায়ে চাপ দেওয়া চাকার উপর দাঁড়িয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে হবে। যত উপরের দিকে ওঠা যাবে, চাকার ঘষা লেগে যন্ত্রের নীচে রাখা শস্য বা জল থেকে মাড়াই হয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি হবে। একদিকে জিনিস তৈরিরও যন্ত্র, তাই ‘Trademill’ও বলা চলে। হিসেবমতো, টানা আট থেকে দশ ঘণ্টা এই যন্ত্রটির চাকার উপর হাঁটলে, তা প্রায় ৭২০০ থেকে ১১০০০ ফুট উচ্চতা অবধি হাঁটার সমান হয়। যা আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রায় এক চতুর্থাংশ উচ্চতা ওঠার সমান! যথাযথ খাদ্যের অভাব, ক্লান্তি, আর এই টানা পরিশ্রমের ধকলে জেলবন্দীদের শরীরে তখন অসুখ ঘাপটি মেরে বসত। বন্দি মৃত্যুর খবরও কানে আসত প্রায়শই। অথচ ততদিনে এই যন্ত্রের ব্যবহার ইংল্যান্ড ছাপিয়ে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে।

ইংল্যান্ডে ১৭৭৯-এর ‘Prison Act’ অনুযায়ী, ষোল বছরের উপরের সমস্ত পুরুষ বন্দিদেরই কঠিন পরিশ্রমের শাস্তি দেওয়া হত, -“… labor of the hardest and most servile kind in which drudgery is chiefly required and where the work is little liable to the spoiled by ignorance, neglect, or obstinacy…” আর প্রথম শ্রেণির কঠিন পরিশ্রমের কাজই ছিল এই ট্রেডমিলের। একাধিক বন্দীদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে যাওয়ার কাজ করে যেতেই হত, যতক্ষণ না থামার হুকুম আসে।
১৮২১ সালে প্রথম ট্রেড হুইল যন্ত্রটি বসানো হয়েছিল ‘Surrey House of Correction’-এর সংশোধনাগারে, যা বর্তমানে ‘Brixton Prison’ নামে পরিচিত। যন্ত্রটি উইলিয়াম ক্যুবিট নিজে তৈরি করেছিলেন। তাঁর মতে এই ট্রেডমিলের উদ্দেশ্য ছিল, “reforming offenders by teaching them habits of industry.” ; অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে একটি ‘Water wheel’-এর সমান শক্তি উৎপাদন করে মনুষ্যশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শস্য পেষাইয়ের কাজ করা। ট্রেডমিলের কার্যপ্রণালী বোঝাতে গিয়ে উইলিয়াম ক্যুবেট জানান, “by means of steps… the gang of prisoners ascend[ing] at one end… their combine weight acting upon every successive stepping board, precisely as a stream upon the float-boards of a water wheel.”। তবুও ২০০ জন নারী ও পুরুষ একসঙ্গে টানা প্রায় ৮ ঘণ্টা করে এই যন্ত্রের উপর হাঁটার পরেও তা একটি জল-চাকা যন্ত্রের কাজের সমান হত না। কখনও কখনও ট্রেডমিলে শুধুমাত্র ‘grinding the wind’-এর কাজও হত। দীর্ঘ সময় ধরে এমন অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে অনেক বন্দিই ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ত।

আবার এই হৃদপিণ্ডের রোগ নির্ণায়ক যন্ত্র হিসাবেই ১৯৫২ সালে ডাক্তার রবার্ট ব্রুস ও ওয়েন কুইনটনের তৎপরতায় ডাক্তারিক্ষেত্রে প্রথম ট্রেডমিলের ব্যবহার হয় ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে ডাক্তার কেনেথ কুপারের লেখা শরীরচর্চায় অ্যারোবিক্স-এর ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণাপত্র প্রকাশের পর, বাড়িতেও ট্রেডমিলের ব্যবহার ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষ অবগত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে তো বটেই, সেইসঙ্গে নানাধরনের সংশোধনাগার, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদির কেন্দ্রেও ট্রেডমিলের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।

বন্দিদের উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের যন্ত্রের পাশাপাশি এই ট্রেড হুইল একসময় ডুবোজাহাজের কাজেও ব্যবহৃত হত। ১৮৫১ সালে এক ডুবোজাহাজে, হুইলের উপর চাপ বাড়িয়ে কমিয়ে জাহাজটির জলে ডোবা ও ভাসার কাজটি নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ট্রেড হুইল তথা ট্রেডমিলের ব্যবহার হত বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে ট্রেডমিলের নানা অপকারিতার দিক লক্ষ্য করে ব্রিটিশরা ১৯৮৯ সালে সম্পূর্ণভাবে এর ব্যবহার বন্ধ করে দেন। কিন্তু তার আগেই ১৯১৩ সালে ‘Training Machine’ হিসাবে ট্রেডমিল ততদিনে আবার বাজারে ফিরে এসেছে। ১৯৬০ সাল নাগাদ উইলিয়াম স্টাব নামে একজন আমেরিকান ‘Pacemaster 600’ নামে এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন , যা বর্তমানের জিমখানায় ব্যবহৃত ট্রেডমিলদের পূর্বসূরী। ১৯৯১ সালে পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যবহৃত শরীরচর্চার যন্ত্র হিসাবে প্রথম সারিতে উঠে এসেছিল এই ট্রেডমিল। তাই এখন আর বাধ্যতামূলক ভাবে নয়, মানুষ নিজে থেকেই এই কষ্টস্বীকার করছে স্বেচ্ছায়, নিজেকে সুঠাম, শক্তিশালী, সুদর্শন রাখার অভীপ্সায়।

বর্তমানের বাস্তবকে মেনে নিয়ে, আরেকবার ট্রেডমিলের ব্যবহার এমন অত্যাচারের মতো মনে হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে কারারক্ষী জেমস হার্ডির কথা। ট্রেডমিলের কাজটি তাঁর কাছে ভয়াবহ মনে হত এর, “monotonous steadiness, and not its severity, which constitutes its terror”-এর কারণে। আর এই অন্তহীনভাবে একই কষ্ট সহ্য করার কথা বলতে গিয়ে অস্কার ওয়াইল্ডের কথা মনে পড়ে যায়। ১৮৯৫ সালে এমনই এক জেলে থাকাকালীন, যিনি তাঁর ‘Ballad of Reading Gaol’-এ লিখেছিলেন- “We banged the tins, and bawled/ the hymns/ And sweated on the mill,/ But in the heart of every man/ Terror was lying still.” সংশোধনাগারের কাজ যদি কৃত অপরাধের কথা স্বীকার করে নিয়ে, সেই অপরাধের যন্ত্রণাকে বারবার নিজের ভেতর তারিয়ে তারিয়ে দেখার সুযোগ হয়, তাহলে সেই সংশোধনাগারের ট্রেডমিলে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোকে, জীবনের হাতে বাঁধা সিসিফাসের মতোই মনে হয়। শেষমেষ কোনও প্রাপ্তি নেই জেনেও, উপর শুধু অন্তহীন উপরের দিকে প্রত্যাশাহীনভাবে উঠে যাওয়াই যাদের ভবিতব্য।


তথ্যসূত্রঃ

১।https://www.mentalfloss.com/article/12275/treadmill-originated-prisons?a_aid=46103&fbclid=IwAR1CMYAgjKv2j7XpSOO5h9atCJqQalgfhArIIC899ELtcZNG7pOH2mgRmZI

২। https://www.treadmillreviews.net/the-treadmill-a-history/

৩। https://discvr.blog/the-treadmill-was-originally-a-torture-device/

More Articles