ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কীসের চোরাকুঠুরি? বাংলার গুপ্তধন নিয়ে রয়েছে যে যে জল্পনা
ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে এইরকম কুঠুরি সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য অথবা মানুষকে বন্দি করার জন্য ব্যবহৃত হতো। ২০১২ সালের পর এই কুঠুরি নিয়ে আর কোনও তথ্য প্রকাশিত হয়নি।
পায়ে ধরে সাধা।
রা নাহি দেয় রাধা॥
শেষে দিল রা,
পাগোল ছাড়ো পা॥
তেঁতুল-বটের কোলে
দক্ষিণে যাও চলে॥
ঈশান কোণে ঈশানী,
কহে দিলাম নিশানী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'গুপ্তধন' গল্পের এই সাংকেতিক কবিতা প্রায় সবাই পড়েছি। বাংলা সাহিত্যে, সিনেমায় আলাদা আলাদা বহু গুপ্তধনের গল্প বলা হয়েছে। 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য'-র সিংহরায় বাড়ির নারায়ণী মুদ্রার গুপ্তধন থেকে সোনাদার খুঁজে পাওয়া শাহজাহান-পুত্র সুজার বাংলায় লুকিয়ে রাখা হিরে, জহরতের গুপ্তধন। গুপ্তধনের গল্প মানেই ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র এবং গুপ্তধন খুঁজে বের করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। গুপ্তধন পাহারা দেওয়ার জন্যে যক্ষের কথা বিভিন্ন জায়গায় উঠে এসেছে। সত্যতা যাচাই করা মুশকিল হলেও বাংলায় সাহিত্যের পাতা এবং সিনেমার পর্দা ছাড়াও বিভিন্ন গুপ্তধনের গল্প লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়।
গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্ক প্রাচীন বাংলার শাসকদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত নাম। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মানব গৌড়ের রাজা হয়েছিলেন। মানবের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারা যায় না, কারণ রাজ্যাভিষেকের আট মাসের মধ্যেই শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কথিত আছে যে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মানব তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ নিজের প্রাসাদে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই ধনসম্পদের মধ্যে একটি মহামূল্যবান রত্ন ছিল। 'হর্ষচরিত'-এর রচয়িতা বানভট্টর লেখায় রত্ন-সহ এই মহামূল্যবান গুপ্তধনের কথা জানা যায়। শত্রু-সেনার আক্রমণে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রাসাদটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বহু অনুসন্ধান করেও সেই গুপ্তধন অথবা গুপ্তধন-সংক্রান্ত কোনও সংকেত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: আছে অথচ নেই! বাংলার রহস্যময় এই অঞ্চলের কথা পাওয়া যাবে না ইতিহাসেও
বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরের রাজা রাইচরণ দেব বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কথিত আছে যে, শহিদ ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকিকে তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন। রাজবাড়ি থেকে জঙ্গল অবধি একটি সুড়ঙ্গ বিস্তৃত ছিল। বিপদের হাত থেকে বেঁচে পালাতে বিপ্লবীরা এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতেন। ইংরেজরা বিভিন্ন সূত্র থেকে রাজবাড়িতে উপস্থিত বিপ্লবী এবং রাজার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর ব্যাপারে জানতে পারে। ইংরেজদের হাত থেকে নিজের প্রজা এবং বিপ্লবীদের রক্ষা করতে সৈন্য-সমেত রাজা রাইচরণ নিজে ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। ইংরেজ আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবেন না বুঝতে পেরে রাইচরণ তাঁর পরিবারের সদস্যদের একটি ঘরে লুকিয়ে রেখে তার বেশিরভাগ সম্পদ নদীতে ফেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। ইংরেজদের হাতে নিজের সম্পত্তি দিতে রাইচরণ রাজি ছিলেন না। যদিও লোকমুখে শোনা যায় যে, ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচাতে রাজা তাঁর বিপুল সম্পদ নৌকো করে অন্যত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বিপুল সম্পদ সামলানোর দায়িত্ব কিছু তরুণ সৈনিকদের দেওয়া হয়েছিল। নদীতে নৌকাডুবির ফলে সেইসব সম্পদ হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ইংরেজরা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও সেই সম্পদের কানাকড়িও খুঁজে পায়নি। বর্তমানে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্পদের গল্প বেশিরভাগ মানুষের স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে।
বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত নাম জগৎশেঠ। পিতৃদত্ত নাম জগৎশেঠ না হলেও তাঁর কাজ এবং সম্পত্তির পরিমাণ তাঁকে এই নামে পরিচিত করে তোলে। কথিত আছে যে, জগৎশেঠের কাছে থাকা সোনা, হিরে এবং অন্যান্য রত্ন দিয়ে নদীর ওপরে বাঁধ দেওয়া যাবে। সমগ্র ইংল্যান্ডের থেকে বেশি সম্পদ জগৎশেঠের কাছে ছিল। এই কথাগুলো থেকেই তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ আন্দাজ করা যায়। জগৎশেঠের হত্যার পর তাঁর বিপুল সম্পত্তির কিছুটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর ছেলে হরেকচাঁদ কাঠগোলা রাজবাড়ি তৈরি করলেও জগৎশেঠের সম্পদের ছটা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। জগৎশেঠের কাছে থাকা সম্পদের পরিমাণ আন্দাজ করে বহুবার গুপ্তধনের সন্ধান করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই শতকের শুরুতে কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি মেরামতি করার সময়ে এক বন্ধ কুঠুরির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কুঠুরিতে কোনও জানলা, দরজা অথবা চোরাদরজা ছিল না। বিশেষজ্ঞরা কুঠুরিটি বাইরে থেকে পরীক্ষা করে জানান যে, কুঠুরির একদিকে একটি খিলান বা তোরণ ছিল যেটা ইট তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি হেরিটেজ তকমা পাওয়া স্থাপত্য হওয়ার কারণে, তার দেওয়াল ভেঙে ফেলা সম্ভব ছিল না। আদালত থেকে অনুমতি পেয়ে দেওয়ালে একটি ছিদ্র করে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বিশেষজ্ঞরা জানান যে, বাড়িটি মজবুত করার জন্য ওই কুঠুরিটি তৈরি করে মাটি দিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা নিজেদের মতামত জানালেও মানুষের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। মাটি দিয়ে যেই কুঠুরিটি বন্ধ করা হবে, সেখানে খিলান বা তোরণের উপস্থিতির কারণ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে এইরকম কুঠুরি সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য অথবা মানুষকে বন্দি করার জন্য ব্যবহৃত হতো। ২০১২ সালের পর এই কুঠুরি নিয়ে আর কোনও তথ্য প্রকাশিত হয়নি।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত অথবা অজানার প্রতি মানুষের আকর্ষণের কারণেই হয়তো বাংলার কোনায় কোনায় এইরকম বহু গুপ্তধনের গল্প আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।