খুন-প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ! যেভাবে তিলে তিলে শেষ হল মারাঠা সাম্রাজ্য

Anglo Maratha War: ১৭৭৩ সালে নারায়ণ রাওয়ের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে, মারাঠা পরিষদ সেই সদ্যোজাত শিশুকে পরবর্তী পেশোয়া ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৭৬৪ সাল। ‘ব্যাটেল অফ বক্সার’ বিজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। সম্পূর্ণ বাংলা এসে গিয়েছে হাতের মুঠোয়। অন্যদিকে, মুঘল সাম্রাজ্য ইতিমধ্যেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। উত্তরের কেবল কিছু ছোটো এলাকায় তখনও মুঘল সাম্রাজের আধিপত্য টিকে আছে। এমন সময়ে ভারতে অন্যদিকে উত্থান হচ্ছে আরও একটি সাম্রাজ্যের। মারাঠা সাম্রাজ্য। যা এই দুই সাম্রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি দাপুটে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে অনেক বড় এলাকাই ছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে, ছিল অধিক সম্পদ, অধিক শক্তি। তা সত্ত্বেও কীভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হারাল মারাঠাদের?

মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান হয় ১৬৭৪ সালে ছত্রপতি শিবাজির হাত ধরে। শুরু থেকেই ভীষণ শক্তিশালী সংগঠন হয়ে সামনে আসতে থাকে মারাঠারা। শোনা যায়, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়কাল থেকেই মুঘল সাম্রজ্যের অধীনস্ত এলাকা খুব ছোট ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বলাবাহুল্য, এতে মারাঠা সাম্রাজ্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৭৫৯ সালে, মারাঠাদের অধীনে চলে আসে উত্তরের আফগানিস্তান থেকে শুরু করে দক্ষিণের তামিলনাড়ু, পশ্চিমে সিন্ধ থেকে পূর্বের ওড়িশাও। প্রায় দু’ বছর পর, ১৭৬১ সালে বড় সমস্যায় পড়ে মারাঠা সাম্রাজ্য। শুরু হয় পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আফগান শাসক আহমদ শাহ দ্রুরানি মারাঠাদের পরাজিত করে। এর ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মারাঠারা, হারিয়ে যায় অধীনস্ত রাজত্ব। যদিও এরপর প্রায় এক দশকের মধ্যেই মারাঠারা নিজেদের ক্ষমতায় ফেরত আসে। ক্ষমতার পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় প্রথম পেশোয়া মাধবরাওয়ের নেতৃত্বে। তাঁর নেতৃত্বে মারাঠা সাম্রাজ্য এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তাদের এড়িয়ে চলত। সেই কারণেই কোম্পানি আওয়াধ দখল করেনি।

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মারাঠা সাম্রাজ্যের মাঝে ‘ট্রিটি অফ এলাহাবাদ’ সাক্ষর হয়, যেখানে আওয়াধ একটি বাফার রাজ্য হয়ে থেকে যায়। মারাঠাদের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এমন নয় যে মারাঠা সাম্রাজ্য দখলের কোনও বাসনাই ছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আসলে অপেক্ষা ছিল প্রকৃত সুযোগের, তাই ধৈর্য ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

আরও পড়ুন- জমি কেড়ে নেওয়া, পরের পর যুদ্ধ! পৃথিবী শাসন করা আমেরিকার ইতিহাস তাক লাগাবে

১৭৭২ সালে অবশেষে সেই সুযোগ আসে। প্রথম পেশোয়া মাধবরাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর কে দ্বিতীয় পেশোয়া হবে সেই নিয়েই জোরালো বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মাধবরাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছোটো ভাই নারায়ণ রাওকে পরবর্তী পেশোয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও বিষয়টা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি তাঁর কাকা রঘুনাথ রাও। পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। নারায়ণ রাওকে হত্যা করে নিজেকে পরবর্তী পেশোয়া হিসাবে ঘোষণা করেন রঘুনাথ রাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নারায়ণ রাওয়ের স্ত্রী সেই সময়ে গর্ভবতী ছিলেন। ১৭৭৩ সালে নারায়ণ রাওয়ের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে, মারাঠা পরিষদ সেই সদ্যোজাত শিশুকে পরবর্তী পেশোয়া ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু দ্বিতীয় মাধবরাও তখন শিশু, তাই তাঁর বড় না হওয়া অবধি নানা ফড়নবিস শাসনভারের দায়িত্ব পান। রঘুনাথকে পাঠানো হয় নির্বাসনে।

ক্ষমতার লোভে মশগুল রঘুনাথ নিজের অধিকার ফিরে পেতে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলালেন। সেই সময়ের সুরাট, বম্বে প্রেসিডেন্সি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ১৭৭৫ সালে, ‘ট্রিটি অব সুরাট’ নামক একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, ব্রিটিশরা সমস্তরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করবে রঘুনাথকে এবং নিজেদের সৈন্যও দেবে পেশোয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। আর তার বদলে রঘুনাথকে কিছু এলাকা ব্রিটিশদের দিতে হবে। ১৭৭৫ সালে শুরু হয়ে প্রথম অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধ। যুদ্ধের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি দেখে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সুরাটের চুক্তি ভেঙে দেন। হেস্টিংসের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ এড়িয়ে চলা। কিন্তু এই বিষয়ে বোম্বে প্রেসিডেন্ট ও হেস্টিংসের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

সুরাট চুক্তি খারিজ হলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যালকাটা কাউন্সেল নানা ফড়নবিসের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি সাক্ষর করে যাকে বলা হয় ‘ট্রিটি অব পুরন্ধর’। এই চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল, মারাঠা অন্যান্য কোনও বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে কোনও রকম চুক্তি করতে পারবে না। অন্যদিকে বোম্বের ব্রিটিশ সরকার এই চুক্তি সম্পূর্ণ খারিজ করে দেয় এবং রঘুনাথ রাওকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়ায় প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে নানা ফড়নবিস এতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং এর প্রত্যুত্তরে ১৭৭৭ সালে ফরাসিদের তিনি তাঁর এলাকার একটি বন্দর ছেড়ে দেন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখে ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ও বম্বে প্রেসিডেন্সি ক্ষুব্ধ হয়ে মারাঠাদের ওপর আক্রমণ চালায়।

নানা ফড়নবিস এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হায়দরাবাদের নিজাম মাসুরকে হায়দার আলি, আরকোটের নবাব ও মুঘল বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে হাত মেলান। সকল ভারতীয় শাসক এইবার একে একে যুদ্ধ আরম্ভ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু বছর ধরে এই যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে দুই পক্ষের সম্মতিতে যুদ্ধ শেষ হয় এবং ১৭৮২ সালে সালবাইয়ের চুক্তি সাক্ষর হয়।

আরও পড়ুন- উন্নয়নের কোপে পরিবেশ ধ্বংসের মাশুল! কোন ভয়াবহ সংকট আসন্ন

এভাবে আগামী দুই দশক মারাঠা এবং ব্রিটিশদের মধ্যে শান্তি থাকলেও দেশের বাকি স্বতন্ত্র রাজ্য গুলিতে হামেশাই যুদ্ধ-দাঙ্গা লেগেছিল। অন্যদিকে, মারাঠা সাম্রাজ্যকে তখন পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়- গায়কোয়াড়ের বারদোয়া, নাগপুরের ভোঁসলে, ইন্দোরের হোলকার, গোয়ালিওর সিদ্ধি এবং পুনের পেশোয়া। এই পাঁচটি ভাগেরই নিজস্ব প্রধান পেশোয়া ছিল। ১৮০০ সালে নানা ফড়নবিসের মৃত্যু হলে তাঁর পরিবর্তে সিংহাসনে বসেন রঘুনাথ রাওয়ের পুত্র দ্বিতীয় বাজিরাও। ইন্দোরের হোলকার এটি মানতে না পেরে পুনে আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভয়ে পেশোয়া পুনে থেকে পালিয়ে ব্রিটিশদের কাছে সাহায্য চান। ব্রিটিশরা এই সুযোগে পেশোয়াকে দিয়ে চুক্তি সাক্ষর করিয়ে নেয়। চুক্তি অনুসারে ৬০০০ সৈন্য থাকবে পেশোয়ার জন্য কিন্ত তার বদলে পুনেকে তুলে দিতে হবে ব্রিটিশদের হাতে। বাকি মারাঠি শাসকরা এই চুক্তি অস্বীকার করলে ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৮০৫ সালে ব্রিটিশরা যুদ্ধ জিতে সিন্ধি, হোলকার ও ভোঁসলেকে দিয়ে নিজেদের চুক্তি সাক্ষর করিয়ে নেয় এবং পেশোয়াকে ফের সমগ্র এলাকার প্রধান বানিয়ে দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরে আসল চাবিকাঠি ব্রিটিশরা রাখল নিজেদেরই হাতে।

বিষয়টি বুঝতে পেরে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ধীরে ধীরে সিন্ধি হোলকার ও ভোঁসলের সঙ্গে গুপ্ত সন্ধি পাতাতে শুরু করেন। এমনকী তিনি আফগান শাসক আমির খানের থেকেও সাহায্য নেন। ১৮১৭ সালে শুরু হয় তৃতীয় অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধ। রাজ্যগুলি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ব্রিটিশরা এই যুদ্ধ জিতে যায়। পতন হয় মারাঠা গৌরবের।

More Articles