আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে সামনে রেখেই এবার আদিবাসীদের বনভূমিতে কোপ?
সত্যিই কি আদিবাসীদের কথা ভাবছে সরকার? না কি সেই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে?
ভারতের বিশাল অংশের মানুষ বনভূমিতে আবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকে। জঙ্গলের মধ্যে এবং পাশাপাশি অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ হয় প্রধানত বনভূমিকেই কেন্দ্র করে। চিরকালই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের অনধিকার প্রবেশকারী হিসাবে দেখা হয়, বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাদেরই নিজস্ব বাসস্থানে।
২০০৬ সালে সংসদে ঐতিহাসিক 'বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্য পারম্পরিক বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬' (সংক্ষেপে, বনাধিকার আইন) পাশ হয়েছিল। এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা আছে যে, বনবাসীদের স্বীকৃত অধিকারের মধ্যে বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ থাকছে, এবং মানুষের অংশগ্রহণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য আরও বজায় থাকবে। তার ফলে অরণ্য সংরক্ষণ করতে আরও সুবিধে হবে। এই আইন অনুযায়ী, জঙ্গলের জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, ফলমূল, ঘাস, ভেষজ উদ্ভিদ, লতাপাতা- সব ধরনের বনজ সম্পদ ব্যবহারের অধিকার থাকবে অরণ্যবাসীদের, যদিও এসব আইনে উল্লিখিত বিষয়ের বেশিটাই লিখিত আইন হয়েই রয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়ে থাকে, বনজ সম্পদ ব্যবহারের কারণে।
সম্প্রতি ২০২২ সালে বন সংরক্ষণ আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে সংসদে। এই নতুন ধারায় বলা হয়েছে যে, জঙ্গলের অধিবাসী এবং গ্রামসভার অনুমোদন ছাড়াই নির্বিচারে জঙ্গল কাটা যেতে পারে। এইসব জঙ্গলের বনজ সম্পদ বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করাও যাবে। পূর্বের আইন অনুযায়ী বাণিজ্যিক কারণে জঙ্গল কাটার প্রয়োজন হলে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল অধিবাসী মানুষদের থেকে সম্মতি গ্রহণ করা আবশ্যক ছিল। এবার যথেচ্ছভাবে কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিতে আর কোনও প্রকার যাতে বাধা না তৈরি হয়, তারই ব্যবস্থা করেছে সরকার। ২৮ জুন এই আইনের সংশোধনী পাশ হয়ে গিয়েছে সংসদে। এই নতুন ধারার ফলে জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল আদিবাসী ও তফশিলি জনজাতির মানুষেরা, তাদের জীবনযাত্রা ব্যহত হবে।
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখেই চলছে ইতিহাস পালটে দেওয়ার খেলা
এই প্রথম রাষ্ট্রপতি পদে কোনও আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। আসলে দ্রৌপদী মুর্মুকে এই আসনে বসিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ বিজেপি রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়-এর আগামী বিধানসভা নির্বাচন এবং পরে লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করতে চাইছে। এই রাজ্যগুলিতে মোট ১২৮টি আসন তফসিলি জনজাতি বা এসটি-দের জন্য সংরক্ষিত। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি শুধুমাত্র ৩৫টি আসনে জিততে পেরেছিল। তবে কি হারানো ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পেতেই এই সস্তা রাজনীতির খেলায় মেতেছে বিজেপি? তাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতির সম্মানে অভিষিক্ত করা? যাতে সহজে আরও কোনও সন্দেহ ও প্রশ্ন ছাড়াই শোষণ, অত্যাচার করা যায়? দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখে আদিবাসী সমাজের সর্বনাশ করাই এখন লক্ষ্য?
সত্যিই কি আদিবাসীদের কথা ভাবছে সরকার? না কি সেই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে? এই আইনের সংশোধনীর ফলে খুব সহজেই যে-কোনও বেসরকারি সংস্থা অথবা সরকার জঙ্গলের অধিবাসীদের তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে। এর ফলে নির্বিচারে অরণ্যগুলি ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। জঙ্গলের অধিবাসীদের এবং গ্রামসভার থেকে কোনও প্রকার সম্মতি না নিয়েই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আদিবাসীদের জমি ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। অথচ, নয়া আইন অনুযায়ী তাদের মতামত নেওয়া আর বাধ্যতামূলক নয়, বরং তাদেরকেই অজ্ঞাতে উচ্ছেদ করা যেতে পারে আইনিভাবে। নয়া আইনে জঙ্গলের জমি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারগুলিকে, আগে এই দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। সরকারের দাবি অনুযায়ী, বনভূমি এলাকাগুলি সহজেই উন্নয়নের কাজে আসবে এর ফলে। এই আইন অনুযায়ী জঙ্গলের জমি প্রথমেই তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থা বা শিল্পপতিদের হাতে, তারপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে বৃক্ষরোপনের অর্থ নেওয়া হবে। সব শেষে সেই অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের জানানো হবে এবং রাজ্য সরকার তাদের দাবি খতিয়ে দেখে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। এর ফলে যেমন আদিবাসী মানুষদের প্রতি অবিচার হবে, তেমনই অবিচার হবে পরিবেশের প্রতিও। এই ভয়াবহ আইনে বনাঞ্চল, অরণ্য সবই শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পূর্বের সরকার আদিবাসীদের কথা ভেবে কিছুই করেনি। অথচ এমন সিদ্ধান্তে অরণ্যের অধিকার ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই করছে না তো মোদি সরকার?
অথচ এতদিন এই জঙ্গলে বসবাস করা মানুষগুলোই জীবনকে বাজি রেখে বনভূমিকে আগলে রেখেছে। আজ তাদেরই জীবন নিশ্চিতরূপে দুর্বিসহ করে তোলা হচ্ছে 'ফরেস্ট কনভারশন রুলস ২০২২'-এর মাধ্যমে।