বিদেশে জন্মালে অস্কার পেতেন, মানতেন সত্যজিৎ, তুলসী চক্রবর্তী আজ বিস্মৃত অধ্যায়

মধ্যবিত্ত কেরানিজীবনে পরশপাথরের আগমন বড় বেশি ঘটে না। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ কথিত 'ক্ষণিকা'র মতো যখন সে আসে, তখন সত্যিই যেন 'এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।' তাকে ঘিরে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। আর এমন বিস্ময়কে অপার্থিব ভঙ্গিতে শরীরে ফুটিয়ে তুলেই সেলুলয়েডের রাজাধিরাজ হয়ে উঠেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। 'টিনের তলোয়ার' নাটকের বেণীমাধব চাটুজ্জে নিজেকে তুলনা করেছিলেন 'বাংলার গ্যারিকে'র সঙ্গে। প্রখ্যাত সেই ইংরেজ অভিনেতার অভিনয় দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে বিশ শতকের কোনো অভিনেতা কে যদি সে অভিধায় ভূষিত করা চলে তাহলে তিনি অবশ্যই তুলসী চক্রবর্তী। সাধে কি আর তাঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, বিদেশী দর্শকের সামনে অভিনয় করার সুযোগ পেলে অস্কার পেতেন তিনি?

বেশ কিছু কলাকুশলী নিয়ে অর্কেস্ট্রার দল চালাতেন প্রসাদ চক্রবর্তী। অনেকের সঙ্গে সেখানকার গায়কের তালিকায় নাম ছিল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তুলসী চক্রবর্তীর। সদ্য কৈশোর পেরোনো সেই ছেলের মঞ্চে নামার বড় শখ ছিল। নিষ্ঠার সঙ্গে জ্যাঠামশায়ের কাছে তিনি শিখে নেন গলা খেলানোর নানান আদব কায়দা। প্রসাদবাবুর অর্কেস্ট্রার দল খুব বেশিদিন চলে নি। নানান কারণে সেটা উঠে যায়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্টার থিয়েটারে হারমোনিয়াম বাজানোর কাজ পেয়ে যান। সেখানে সারাদিন পরিশ্রমের পর যখন আহারের সময় উপস্থিত হত তখন তিনি দেখতেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁর জন্য ঠিক খাবার নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এতদিন গানের দলে গলা মিলিয়ে সুরের তালিম তুলসীর ভালোই হয়েছিল। এবার তাঁর আগ্রহ জন্মালো অভিনয়ে। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি একমনে দেখতেন মঞ্চে কে কীভাবে অভিনয় করছেন। 

এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন তুলসীর জেদ হল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু অবশ্যই দশটা পাঁচটার চাকরি করে নয়। বাড়ি থেকে পালালেন তিনি। সোজা গিয়ে যোগ দিলেন 'বোসেস সার্কাসে'। তারপর সেখান থেকে বর্মা। এর আগে অবশ্য কিছুদিন হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজকর্মও করেছেন। কিন্তু সে কাজ বেশিদিন চালাতে পারেননি তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে ধরা পড়ে বেদম ধমক খান। 

মনে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে পুরোদমে থাকলেও তার পথ তুলসী চক্রবর্তীর জন্য বড় মসৃণ ছিল না। নানান সময় পেট চালাতে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছে তাঁকে। দিনের পর দিন অভিনয়ের ডাক আসেনি কোথাও থেকে। বর্মা থেকে ফিরে তুলসী যোগ দিলেন চিৎপুরের এক প্রেসে। সেখানে কম্পোজিটরের কাজ করতেন তিনি। মাইনে পেতেন নাম মাত্র, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। কাজের সূত্রেই তিনি দেখতেন বড় বড় থিয়েটারের পোস্টার ছাপত তাঁদের প্রেস। তাতে নিখুঁত রঙে আঁকা নায়ক নায়িকার মুখ। এসব দেখে তাঁর অভিনয়ের ইচ্ছে আরও প্রকট হয়ে উঠত। অবশেষ সুযোগও এসে পড়ল একদিন। জ্যাঠামশায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কম্পোজিটরের কাজ ছেড়ে তিনিও যুক্ত হলেন স্টার থিয়েটারে। অভিনয়ে মন দিলেন পুরোপুরি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করলেন ক্যামেরার সামনে। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে তাঁর অভিমানী মলিনাদেবীর মান ভাঙানোর অমন চমৎকার দৃশ্যখানা আর কেই বা ভুলতে পারে?

তবে, জীবনের সর্বোচ্চ খ্যাতি তুলসী পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করেই। 

বলা হয় সত্যিজিৎ রায় তিনটি নায়কভিত্তিক ছবি করেছেন, প্রথমটা 'জলসাঘর' তারপর যথাক্রমে 'পরশপাথর' এবং 'নায়ক'। আসলে অভিনেতা তো যুগত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন বিশেষ কিছু মুহূর্ত সৃষ্টির মুন্সিয়ানার মধ্যে দিয়ে। প্রাণের নায়ক নায়িকাদের প্রতিভার ইন্দ্রজালে গড়ে ওঠা সে সমস্ত মুহূর্তের কথাই ফেরে দর্শকদের মুখে মুখে। যেমন 'জলসাঘর' ছবিতে সমস্ত সম্পত্তি নিলাম হয়ে যাওয়ার কালে যখন জমিদাররূপী ছবি বিশ্বাসের  খাস পরিচারক তাঁকে নিচের মহলে যাওয়ার অনুরোধ জানান, তখন তিনি গলাটা হালকা ভেঙে দিয়ে ঘোষণা করেন যে তিনি যাবেন না। এ উচ্চারণে যেন ঘোরতর ট্র্যাজেডির মতো ফুটে ওঠে কোনও পরাজিত বাদশার আত্মাভিমান। বা ধরা যাক 'নায়ক' ছবিতে যখন বাল্যবন্ধু জ্যোতির সামনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উত্তম কুমার বলেন, 'আই উইল গো টু দ্য টপ', অচিরেই সে দৃশ্য হয়ে ওঠে কালজয়ী। 

মুহুর্মুহু এমন দৃশ্যের জন্ম দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল তুলসী চক্রবর্তীর। এমন ডাকসাইটে অভিনেতা, কিন্তু দিন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে। থাকতেন শিবপুরে। সামান্য পয়সা বাঁচাতে দিনের পর দিন স্টুডিও পাড়া থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। নিজের মূল্যবোধে অনড় ছিলেন, ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বললেও সে সুবিধা গ্রহণ করেননি। কেবলমাত্র সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেই প্রধান অভিনেতার সম্মান পেয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। এ ছাড়া আপামর দর্শক তাঁকে চিনেছেন কেবলমাত্র একজন 'কৌতুকাভিনেতা' হিসেবে। অমন মাপের একজন অভিনেতার কাছে এ এক লজ্জাও বটে। খাঁটি হিরেকে চিনে ওঠার ক্ষমতা আর বাঙালির কবেই বা ছিল? 

মাত্র ৬২ বছর বয়সে চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তীর। হাওড়ায় গেলে তাঁর বাড়িখানা আজও দেখা যাবে। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেই বাড়ি পড়ে থাকে তালাবন্ধ অবস্থায়। সেই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের কোনোরকম দায়িত্ব নেওয়া হয়নি। একসময় যাঁর তুলনা করা হত চার্লস চ্যাপলিনের সঙ্গে, সেই তুলসী চক্রবর্তীর ভাগ্যে জুটেছে শুধুই বিস্মৃতির লাঞ্ছনা। তাঁর ১২৩ তম জন্মদিবসে বড় করে কোনও অনুষ্ঠান করা তো দূরের কথা, নিদেনপক্ষে সমবেতভাবে তাঁর ছবিতে মাল্যদানের উদ্যোগও নেয়নি কোনও পক্ষ। নীরদ সি চৌধুরী লিখেছিলেন 'আত্মঘাতী বাঙালি'। কথাটা যেন আজ পদে পদে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।

More Articles