চুরি হয়েছিল অষ্টধাতুর বিগ্রহ! বর্ধমানের এই শক্তিপীঠের প্রতি পরতে জড়িয়ে পৌরাণিক কাহিনি
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জন্মস্থান এই 'কোগ্রাম'। দেবীর ভৈরব 'কপিলাম্বর'-এর অবস্থান দেবীর পাশেই।
পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে পিতা দক্ষরাজের যজ্ঞস্থলে সর্বসমক্ষে দেহত্যাগ করেন সতী। এর ফলে ক্রুদ্ধ দেবাদিদেব মহাদেব দক্ষরাজের যজ্ঞস্থল পণ্ড করে দিলেন এবং সতীর দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করলেন। সৃষ্টিকর্তা প্রমাদ গুনলেন। সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দিলেন বিষ্ণু। সতীর দেহ মর্ত্যলোকে ৫১টি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে প্রস্তর খণ্ডে পরিণত হলো। ৫১টি স্থানে গড়ে উঠল এক-একটি সতীপীঠ তথা শক্তিপীঠ। বর্ধমানের ৪টি সতীপীঠ, অট্টহাস, বহুলা, যোগাদ্যা বা ক্ষীরগ্রাম এবং উজানি। বর্ধমানের 'কোগ্রামে' অবস্থিত উজানি সতীপীঠ আজও অজানা রহস্যে ঘেরা।
পূর্ব বর্ধমান তথা রাঢ় অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য প্রাচীন সতীপীঠ হলো কোগ্রামের 'উজানি' সতীপীঠ। পীঠ নির্ণয় তন্ত্রমতে ত্রয়োদশ সতীপীঠ হলো এই উজ্জয়িনী বা উজানি। গবেষকদের মতে, 'ওড্ডিয়ান মঙ্গলকোট' অনুযায়ী এখানেই উজানি সতীপীঠ। উপেক্ষিত এই সতীপীঠ প্রচারের আলোয় আসেনি কখনও, তাই অনেকেই জানেন না এর মাহাত্ম্য। বর্ধমান থেকে গুসকরা রোডের কাছে এই মন্দিরের অবস্থান।পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুসারে এখানে মায়ের কনুই পতিত হয়েছিল।
উজ্জয়িন্যাং কর্পূরঞ্চ মাঙ্গল্যঃ কপিলাম্বরঃ।
ভৈরবঃ সিদ্ধিদঃ সাক্ষাদ্দেবী মঙ্গলচন্ডিকা।।
'অন্নদামঙ্গল' কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখেছেন-
উজানীতে কফোণি মঙ্গলচন্ডী দেবী।
ভৈরব কপিলাম্বর শুভ যারে সেবি।।
এই পীঠস্থানে দেবীর নাম- 'মঙ্গলচন্ডী সর্বমঙ্গলা' এবং ভৈরব 'কপিলাম্বর'। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্যে ভ্রমরাদহ, মাড়গড়া, শ্রীমন্তর ডাঙা প্রভৃতি স্থানগুলি এই উজানিতেই রয়েছে, এমন বর্ণনা আছে। 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্যে আছে লহনা এবং খুল্লনা, এই দুই বোনের কাহিনি। মঙ্গলকাব্যের কাহিনি অনুযায়ী মর্ত্যে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজোর প্রচারের জন্য অভিশাপগ্রস্ত স্বর্গের অপ্সরী রত্নমালা, খুল্লনা-রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যেও মাতা মঙ্গলচন্ডীর পুজো প্রচলনের কাহিনি উল্লেখ করে গেছেন। শ্রীপতি সওদাগর ছিলেন শিবভক্ত। তিনি মঙ্গলচন্ডীর পুজো করতে অস্বীকার করেন। তাঁর প্রথম পত্নী লহনার খুড়তুতো বোন খুল্লনাকে তিনি বিবাহ করেন, কিন্তু দাসী দুবলার কু-পরামর্শে লহনা, খুল্লনাকে প্রতিদিন ছাগল চরাতে যেতে বাধ্য করতেন। খুল্লনা তখন দেবী মঙ্গলচন্ডীর আরাধনা শুরু করেন এবং দেবী প্রসন্ন হয়ে তাঁকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
অন্যদিকে সাগরে কমলেকামিনী (হস্তীভক্ষণ এবং হস্তী-উগলন) রূপ দেখে শ্রীপতি সওদাগর বিমোহিত হয়ে যান এবং সিংহল রাজার কাছে সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেন। কিন্তু অন্য কেউ সেই দৃশ্য দেখতে না পাওয়ায় মহারাজা, মিথ্যাচারের অপরাধে শ্রীপতি সওদাগরকে বন্দি করেন। এর কিছুকাল পর শ্রীপতি সওদাগরের পুত্র শ্রীমন্ত সওদাগর সিংহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং দেবীর মায়ায় তিনিও কমলেকামিনী রূপ দর্শন করেন এবং রাজার কাছে সেই বর্ণনা দিয়ে তিনিও বিপদে পড়েন, এবং সিংহলরাজ তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। বন্দি অবস্থায় শ্রীমন্ত সওদাগর কারাগারে দেবী চণ্ডীর বন্দনা আরম্ভ করেন এবং দেবীর কৃপায় সিংহলরাজ শ্রীমন্তকে ও শ্রীপতি সওদাগরকে মুক্তি দেন। তাঁর কন্যা সুশীলার সহিত শ্রীমন্তর বিবাহও দেন। শ্রীপতি সওদাগর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেবীর মহিমার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং উজানি ফিরে এসে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির তৈরি করেন ও পুজো করেন।সেই থেকে ঘরে ঘরে দেবীর পূজার প্রচলন হয়। এই হলো 'অন্নদামঙ্গল' বা 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্যের কাহিনি।
এখানে দেবী মঙ্গলচণ্ডী মাতা মহিষমর্দিনী রূপে বিরাজমান। মা এখানে দশভূজা। আগে মায়ের বিগ্রহ ছিল অষ্টধাতুনির্মিত। কিন্তু সেটি চুরি যাওয়ার পর থেকে ছবিতেই মায়ের পুজোপাঠ চলত। পরে ১৯৯৪ সালে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানের কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি তৈরি করিয়ে দেন।
উল্লেখ্য, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জন্মস্থান এই 'কোগ্রাম'। দেবীর ভৈরব 'কপিলাম্বর'-এর অবস্থান দেবীর পাশেই। ভৈরবের পাশে রয়েছে একটি বজ্রাসন বৌদ্ধ মূর্তি। অনেকের ধারণা, এই বৌদ্ধ মূর্তিটি পাল যুগের। এখানে দুর্গাপূজা ও কালীপূজায় খুব ধুমধাম হয়। কিন্তু আলাদা কোনও মূর্তিতে নয়, প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি এবং সতীপীঠ হওয়ার কারণে কোনও মূর্তি অথবা নবপত্রিক আনা হয় না। শুধু নতুন ঘট বারি আনা হয়। বছরে এখানে তিনবার ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং তখন বাৎসরিক পূজা হয়। এরপর দ্বিতীয় ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরের দিন, অর্থাৎ যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তৃতীয়বার ঘট আসে দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন সকালে। এখানে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসের মঙ্গলবারে চণ্ডীমঙ্গলের পূজা হয়। এখানে বলি প্রথা চালু আছে। দূর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো বলি হয়। এছাড়া নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগবলি হয়। মঙ্গলকাব্যের কাহিনি অনুযায়ী শ্রীমন্ত সওদাগর এই স্থান থেকে যাত্রা করে সিদ্ধকাম হয়েছিলেন, এই বিশ্বাসের ওপর ভর করে উজানি শক্তিপীঠের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস আজও অমলিন।
দুর্গাপূজা এবং কালীপূজা ছাড়া, কোগ্রামের বিখ্যাত উৎসব হচ্ছে 'উজানির মেলা'। 'মনসামঙ্গল' কাব্য থেকে জানা যায়, উজানিনগরের রাজা তাঁর প্রজাদের মকর সংক্রান্তির স্নানের জন্য কোগ্রামের অজয় নদের চরকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রতি বছর মাঘ মাসের ১ তারিখে অজয় নদের চরে উজানির মেলা বসে। দোলপূর্ণিমাতেও এখানে বড় উৎসব হয়।