ব্যাধ ও শবরদের প্রাচীন দেবী আজও হাজার হাজার ভক্তর আশ্রয়
বর্তমানে উলাইচন্ডীপুজোর জৌলুস কিছুটা কমে এলেও পুজোর দিনটিতে নানা স্থান থেকে জনসমাগম হয়। অতীতেও এই মেলাতে অসম্ভব ভিড় হতো বলে জানা যায়।
'উলা' বা 'উলো' নদিয়া জেলার একটি প্রাচীন জনপদ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও 'উলা'-র নাম পাওয়া যায়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্যে আমরা উলার অস্তিত্ত্ব পাই।
উলা বাহিয়া খিসমার আশেপাশে
মহেশপুর নিকটে সাধুর ডিঙ্গা ভাসে
এখানকার একজন সুবিখ্যাত পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি সপ্তদশ শতকের কবি বলে জানা যায়। তাঁর রচিত 'গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী' গ্রন্থকে আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর 'বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস' গ্রন্থে প্রধান গঙ্গামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস অনুযায়ী ১৮৫৬ খিস্টাব্দে এক ভয়াবহ মহামারী প্রসিদ্ধ এই জনপদটিকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করে। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে আবার জনবসতি গড়ে ওঠে এখানে। বর্তমানে বীরনগর নামে পরিচিত এলাকাটি রানাঘাট মহাকুমার অন্তর্ভুক্ত একটি পৌর এলাকা। তবে এই উলা বা উলোর বিশেষ পরিচিতি উলাইচন্ডীপুজো ও এই পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলার জন্য। 'গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী' গ্রন্থে বলা হয়েছে,
অম্বিকা পশ্চিম পারে,শান্তিপুর পূর্ব্বধারে,
রাখিলা দক্ষিণে গুপ্তিপাড়া।
উল্লাসে উলায় গতি, বট মূলে ভগবতী,
যথায় পাতকী নহে ছাড়।
বৈশাখেতে যাত্রা হয়,লক্ষ লোক লক্ষ্য হয়,
পূর্ণিমা তিথির পূণ্য চয়।
নৃত্য গীত নানা নাট, দ্বিজ করে চন্ডীপাঠ,
মানে যে মানসা সিদ্ধি হয়।
দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী উলার পাশ দিয়ে একসময় গঙ্গা প্রবাহিত হত। এই স্থানে বৈশাখী পূর্ণিমাতে বটমূলে দেবী চন্ডীর পুজো হয়। যেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় এবং এই পুজোতে মনের ইচ্ছে পূরণ ঘটে, এমনটাই কথিত আছে। এখনও বৈশাখ মাসে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এখানে দেবীর পুজো উপলক্ষে জমায়েত হয়। তাছাড়াও সারাবছর নিত্যপুজোর ব্যবস্থা তো রয়েছেই। বেশ কয়েকটি প্রাচীন বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার বহু পুরনো দেবী চন্ডীর বেদিতল যে কোনও ব্যক্তির কাছেই চরম শান্তিদায়ক স্থান।
আরও পড়ুন: স্বপ্নাদেশে দেবী বন্ধ করেছিলেন নরবলি! আজও ভক্তদের ঠিকানা বাংলার এই শক্তিপীঠ
শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত এই জনপদ একসময় সমগ্র দেশে পরিচিত ছিল। বর্তমানে উলাইচন্ডীপুজোর জৌলুস কিছুটা কমে এলেও পুজোর দিনটিতে নানা স্থান থেকে জনসমাগম হয়। অতীতেও এই মেলাতে অসম্ভব ভিড় হতো বলে জানা যায়। ধনী-দরিদ্র-জাত নির্বিশেষে ভিড়ের পরিমাণ এতই বেশি হতো যে এই মেলায় গেলে জাত রক্ষা করা কঠিন ছিল বলে প্রচলিত ছিল। তাই এই মেলাকে 'যাতের মেলা'-ও বলা হতো। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজমহিষীদের উলো-র 'যাতের মেলা'-তে গিয়ে অতিরিক্ত ভিড়ে সম্ভ্রম নষ্ট হওয়ার ভয়ে সেখানে না পাঠিয়ে রাজবাড়ির মাঠে 'বারোদোলের মেলা' বসানোর ব্যবস্থা করেন।
উলার চন্ডীমাতা এবং চন্ডীমাতার পুজো সম্পর্কে জানার আগে আমরা চন্ডীমাতা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারি। বৈদিক সংহিতায় আমরা দেবী চন্ডীর উল্লেখ পাই না। রামায়ণ, মহাভারত কিংবা কোনও প্রাচীন পুরাণেও এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, দেবীভাগবত, বৃহদ্ধর্মপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতিতে দেবী চন্ডীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুমান করা যায়, আর্যেতর সমাজ থেকে এই দেবীর অস্তিত্ব পৌরাণিক সাহিত্যে প্রবেশ করে। 'চন্ডী' শব্দটি কোনও অনার্য ভাষা থেকে সংস্কৃত শব্দভান্ডারে প্রবেশ করে বলে আশুতোষ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে,
চন্ডী শব্দটি সম্ভবত অস্ট্রিক কিংবা দ্রাবিড় ভাষা হইতে আগত।
এই দেবী প্রথমে ব্যাধ ও শবরদের দেবী ছিলেন। পরে ধীরে ধীরে স্ত্রী-সমাজ ও বণিকসমাজের মধ্যে দেবী চন্ডীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
উলায় পুজিতা দেবী চন্ডী 'উলাই চন্ডী' নামেই পরিচিত। ঠিক কবে থেকে, কীভাবে এই বহু প্রসিদ্ধ দেবী চন্ডীর পুজো উলাতে শুরু হয়, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে আজ থেকে প্রায় পাঁচ শতাব্দী পূর্বে রচিত কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্য অনুসারে ধনপতি সওদাগর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিংহল যাওয়ার পথে প্রচণ্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হন। তিনি উলার পূর্বদিকে গঙ্গাতীরে বড় বটগাছের তলায় একটি শিলাখণ্ডে মা উলাইচন্ডীর পুজো করে রক্ষা পান বলে লেখা হয়েছে। সেই দিনটি বৈশাখী পূর্ণিমার দিন ছিল। সেই থেকে আজও বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে উলাইচন্ডীর পুজো হয়ে থাকে। তবে এই পুজোর প্রাচীনত্ব এখনও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই মেলাটি যেহেতু বুদ্ধপূর্ণিমার দিন হয় এবং 'যাতের মেলা' নামের সঙ্গে 'জাতকের' নামের মিল রয়েছে তাই উলাইচন্ডী মেলার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক রয়েছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। যদিও বৌদ্ধতন্ত্রর সঙ্গে এই পুজোর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার লৌকিক সংস্কার অনুসারে ওলাওঠার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য পূজিত হওয়ায় এই দেবী 'ওলাই চন্ডী' বা 'উলুই চন্ডী' নামে পরিচিত।
প্রধানত, শিলাখণ্ডই দেবী চন্ডীরূপে পূজিত হন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৯৫৯ সালের ২৯ এপ্রিল চন্ডীমাতার বহু প্রাচীন শিলারূপটি নিখোঁজ হয়। বহু সন্ধানেও এই শিলারূপটি পাওয়া যায়নি। অবশেষে নবদ্বীপ ও ভাটপাড়ার প্রধান পণ্ডিতদের বিধান অনুসারে ঐ বছরেরই ১৫ মে ঘট স্থাপন করে পুজো শুরু হয়। ঘটের পাশে বেশ কিছু শিলাও পূজিত হয়। বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামে সংকল্প করে ঘটে পুজোর সূচনা হয়। পূর্বে এই পুজোর দিন উলাতে আরও কয়েকটি পুজো মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হতো। এগুলি যথাক্রমে দক্ষিণপাড়ার মহিষমর্দিনী পুজো, উত্তরপাড়ার বিন্ধ্যবাসিনী, পালিতপাড়া, মুহুরিপাড়া ও ডোমপাড়ায় দশভূজা দুর্গা এবং মাঝেরপাড়ায় গণেশজননী পুজো। বর্তমানে উত্তরপাড়ার বারোইয়ারি বিন্ধ্যবাসিনী ও দক্ষিণপাড়ার মহিষমর্দিনী পুজো প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে পশুবলিরও প্রচলন ছিল এই পুজোতে। পুজো উপলক্ষে যাত্রা, খ্যামটা, খেউড়, বাইনাচ, কবিগান, ঝুমুর, ঢপ, তরজা প্রভৃতি বিনোদনেরও ব্যবস্থা ছিল। বোঝাই যাচ্ছে যে, বুদ্ধপূর্ণিমার দিন থেকে পরপর চারটি দিন বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে মেলা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। এই পুজোর মেলা যে বেশ আকর্ষণীয় ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় প্রকাশিত উলায় চন্ডীমেলার বিবরণীর উল্লেখ করা যায়,
২৮ বৈশাখ, ৯ মে রবিবার বৈশাখী পূর্ণিমাতে মোং উলাগ্রামে উলাই চন্ডীতলা নামে এক স্থানে বার্ষিক চন্ডীপুজা হইবেক৷ এবং ঐ দিনে ঐ গ্রামের তিন পাড়ায় বারএয়ারি তিন পূজা হইবেক। দক্ষিণ পাড়ায় মহিষমর্দিনী পূজা ও মধ্যপাড়ায় বিন্ধ্যবাসিনী পুজা ও উত্তরপাড়ায় গণেশজননী পূজা।...অনেক স্থানে বারএয়ারি পূজা হইয়া থাকে কিন্তু এইক্ষণে উলার তুল্য কোথাও হয় না।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের নদিয়া গেজেট থেকে উলার মেলার বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো,
Not far from Ranaghat is Ula so called Uli, a goddes whose festival is held here,when many presents are made to her by thousands of people who come from various parts
উলাইচন্ডী মাতার পুজোর দিন থেকে শুরু করে স্থানীয় আরও দু'টি পুজোকে ঘিরে প্রায় দিনপনেরো এলাকাটি এখনও সরগরম থাকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনসমাবেশে এক মিলনমেলার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এলাকাটি।
দেবী চন্ডী মূলত লৌকিক দেবী। সমাজে এই লৌকিক দেব-দেবীর পুজোর প্রচলন কীভাবে হয়, তা দেখে নেওয়া যেতে পারে। বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভবের পরে বৈদিক হিন্দুধর্মের ওপর তার প্রভাব পড়েছিল। পরবর্তীকালে মহাযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে লৌকিক সংস্কারের মিশ্রণে লৌকিক ধর্মের উৎপত্তি হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে সমকালীন পরিস্থিতি ও লৌকিক বিশ্বাস-সংস্কারের ওপর নির্ভর করেও লোকদেবতার উদ্ভব হয়। লৌকিক দেবতারা প্রধানত আর্যেতর গোষ্ঠীর মধ্যেই পূজিত হতেন। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের পর বাংলাতে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি হয়, তাতে সমাজের বৈদিক যুগের বর্ণভেদ কিছুটা প্রশমিত হয়। প্রচলিত ধর্মীয় জটিল লোকাচারের তুলনায় সাধারণ লৌকিক দেবদেবী মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। লৌকিক দেবদেবীকে নিয়ে রচিত হয় মঙ্গলকাব্য। এই মঙ্গলকাব্যগুলি থেকেই জানা যায় যে, দেবী চন্ডী আর্য ও অনার্য সংস্কারমিশ্রিত দেবী। অঞ্চলভেদে এই দেবী কুলুই চন্ডী, উদ্ধার চন্ডী, রখাই চন্ডী, ঢেইলা চন্ডী, মঙ্গলচন্ডী ইত্যাদি নামে পরিচিত। উলার 'উলাই চন্ডী' এমনই এক লৌকিক দেবী।
বাংলায় যে সমস্ত লৌকিক দেবতার প্রচলন আছে, মূলত পল্লীজনসমাজে তার উদ্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত তা রাজসভায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বলে জানা যায়। তাই দেখা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও তাঁর রাজসভা কবি ভারতচন্দ্রকে 'অন্নদামঙ্গল' রচনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। উলাতে প্রচলিত উলাইচন্ডী একজন লোকদেবী। এই পুজোর আগের রাতে এখানকার হাড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্য শূকর বলির রীতি ছিল বলে জানা যায়। এর থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে, পূর্বে সম্ভবত এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই পুজোর প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এই পুজো সাধারণ লোকসমাজে প্রচলিত হয়।
এখনও বুদ্ধপূর্ণিমার সময় পূর্ণিমার শুরু থেকেই উলার চন্ডীতলায় ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে। শোনা যায়, উলুধ্বনি এবং চন্ডীপাঠ। হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। এই বিশেষ দিনটিতে মূল বেদির কাছে পৌঁছনোও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী প্রাচীন বটগাছের ঝুড়িতে মনস্কামনা পূরণের জন্য ঢিলও বেঁধে যান বহু ভক্ত। প্রাচীন বটগাছগুলিও মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোকে ধারণ করে সানন্দে। সকালে কিংবা বিকেলে মৃদু বাতাসে যখন সেই মনস্কামনা পূরণের জন্য বাঁধা ছোট্ট ছোট্ট ইটের টুকরোগুলো হালকা দোলে, মনে হয় যেন বটগাছগুলিই হালকা হেসে উলাই চন্ডীর ভক্তকে বলছেন, তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হোক।