মোদি জমানায় বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেল বন্দি! দেশের ১০ রাজনৈতিক বন্দি কারা?

Political Prisoners: সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বন্দি রয়েছেন ভীমা কোরেগাঁও মামলায়। এই মামলায় মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল এনআইএ।

স্বাধীন বিচার বিভাগ দেশের মেরুদণ্ড। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বও দিয়েছিলেন কিন্তু এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকারি ক্ষমতার জেরে শীর্ষ আদালতের রায় বদলে দিয়েছে সরকার। শেষ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছে, দেশে বিচারাধীন বন্দিদের সংখ্যা ৪,৩৪,৩০২ বা ৭৫.৮%। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ২৪,১৩৪ জনের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট)-এ মামলা করা হয়েছে। এমনই দশজন রাজনৈতিক বন্দির কথা এই লোকসভা নির্বাচন ও ১৮ তম লোকসভা গঠনের পরে ফিরে দেখতেই হয়।

উমর খালিদ

উমর খালিদ জনজাতি জীবন নিয়ে গবেষণারত এবং জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা। ২০২০ সালে দিল্লি হিংসার ঘটনায় উমরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রর অভিযোগ এনে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এ মামলা করেছিল দিল্লি পুলিশ। সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে উমরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর থেকে বারবার জামিনের আর্জি খারিজ করেছে শীর্ষ আদালত। বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)- এ বিনা বিচারেই নাগরিককে 'দেশদ্রোহী' তকমা দেওয়া যায়। সে মতো উমরকেও 'দেশদ্রোহী'ই বলা হয়েছে। যে দিনের ঘটনায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় সেদিন তিনি শহরেই ছিলেন না বলে জানান তাঁর আইনজীবী। এই মামলা চলাকালীন তাঁকে এও শুনতে হয় যে তাঁর পূর্বপুরুষরা নাকি ইংরেজদের দালালি করেছিলেন। বিচার হওয়ার আগেই এত সব মন্তব্য কি গ্রহণযোগ্য? প্রশ্ন ওঠে বৈকি!

আরও পড়ুন- প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?

সুরেন্দ্র গ্যআডলইং

সুরেন্দ্র গ্যআডলইং একজন আইনজীবী এবং দলিত অ্যাক্টিভিস্ট। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য আন্দোলনকারী সুরেন্দ্র গ্যআডলইংকে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। তাঁকে ইউএপইএ আইনে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর ল্যাপটপে ইমেলের মাধ্যমে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে প্রমাণ হিসেবে এই নথি কাজে লাগানো যায়।

রোনা উইলসন

রোনা উইলসনও একজন সমাজকর্মী এবং 'কমিটি ফর দ্য রিলিজ অফ পলিটিক্যাল প্রিজনারস'-এর জনসংযোগ সচিব। ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সুরেন্দ্র গ্যআডলইংয়ের মতো একইভাবে তাঁর বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা দেওয়ারও অভিযোগ আনা হয়। উইলসন মুম্বইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি।

জ্যোতি জগতপ

জ্যোতি জগতপ একজন দলিত এবং আদিবাসী অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি কবীর কলা মঞ্চের সদস্য। ২০২০ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মুম্বইয়ের বাইকুলা ওমেন্স প্রিজনে বন্দি তিনি।

হেনি বাবু

হেনি বাবু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। ২০২০ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা হয়। হেনি বাবু মুম্বইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। বম্বে হাইকোর্ট ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ করে। তারপর সুপ্রিম কোর্টে মামলা আপিল করা হয়। যুক্তি দেওয়া হয়, তিনি নাকি মাওবাদীদের সঙ্গে মিলে সরকার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তাঁর আইনজীবী জানিয়েছেন, হেনি বাবুর ল্যাপটপে কিছু কোডনাম পেয়েছে এএনআই। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই নেই, হেনি বাবু নির্দোষ।

সাগর গরখে

সাগর গরখে একজন গায়ক এবং দলিত অ্যাক্টিভিস্ট। তিনিও কবীর কলা মঞ্চের সদস্য। ২০২০ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। মাওবাদী সংস্থার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। তিনিও মুম্বইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলেই বন্দি।

মহেশ রাউত

মহেশ রাউত একজন জমি অধিকার কর্মী। ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলাতেই তাঁকেও ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়। মহেশ রাউতও মুম্বইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি।

রমেশ গাইচর

রমেশ গাইচর একজন দলিত অ্যাক্টিভিস্ট । তিনিও কবীর কলা মঞ্চের সদস্য। ২০২০ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। রমেশ গাইচরও মুম্বইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলেই বন্দি।

আরও পড়ুন- মিলে গেল কেজরিওয়ালের ভবিষ্যদ্বাণী! মোদি কি বানপ্রস্থের পথে?

আসিফ সুলতান

আসিফ সুলতান কাশ্মীরের সাংবাদিক। 'কাশ্মীর ন্যারেটর ম্যাগাজিন'-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে কাশ্মীরে যুদ্ধ বাধানোর অভিযোগ তোলা হয়। উত্তরপ্রদেশের আম্বেডকর নগর জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি।

খুরাম পারভেজ

খুরাম পারভেজ কাশ্মীরের মানবধিকার কর্মী এবং এশিয়ান ফেডারেশন আগেনস্ট ইনভলন্টারি ডিজাপেয়ারেন্স (Asian Fedaration Against Involuntary Disappearances)-এর চেয়ারপার্সন। ২০২১ সালে তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী সংস্থায় আর্থিক সাহায্যের অভিযোগ তোলা হয়। দিল্লির রোহিনী জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি।

 

উল্লেখ্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বন্দি রয়েছেন ভীমা কোরেগাঁও মামলায়। এই মামলায় মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল এনআইএ। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ৮৪ বছরের স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীকে গ্রেফতার করে এনআইএ। আগে থেকেই পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এনআইএ তাঁকে গ্রেফতার করলেও একদিনও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। অসুস্থতার জন্য জামিন চাইলেও দেওয়া হয়নি। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তিনি নাকি মাওবাদীদের সঙ্গে মিলে সরকার বিরোধী ছক কষছেন।

স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ইউএপিএ আইনের বিরোধিতা শুরু হয়। ইউএপিএ-র সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর। সেখানে বিনা প্রমাণেই ৪ বছর জেলবন্দি হয়ে রয়েছেন উমর খালিদ। প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র সমালোচনামূলক মন্তব্য করার জন্য উপযুক্ত আইনের ভিত্তি ছাড়াই আটক করে রাখা কি স্বাধীন বিচার বিভাগের অস্তিত্বকে ধ্বংস করা নয়? প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয়বার মোদি সরকারের যুগে দেশে কি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ফিরবে? যথাযোগ্য বিচারের পরে কি জেলের বাইরের আকাশ দেখতে পাবেন এই মানুষরা?

More Articles