প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?

Umar Khalid: উমর খালিদের মা সাবিহা খানুম বলেন, “উমর নিজের অসুবিধার কথা শেয়ার করে না। সবসময় হাসিমুখে কথা বলে।”

সিস্টেমকে প্রশ্ন করলে সিস্টেম আইনের নামে শাস্তি দেয়, স্বাভাবিক যাপনের থেকে সরিয়ে এনে ফেলে জেলের চৌহদ্দিতে। প্রশ্ন করলে দেশ কারাদণ্ড দেয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার ফলে সাধারণ মানুষকে জাতীয়তাবাদী বিরোধী ঘোষণা করা হয়। ৩৫ বছর বয়সী ভারতীয় সমাজকর্মী উমর খালিদের সঙ্গেও এমনটাই ঘটে। দিল্লি পুলিশ মনে করে, উমর যে বক্তৃতা দিয়েছেন তা ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গায় উসকানি জুগিয়েছে এবং সাহায্য করেছে। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উমর খালিদকে দিল্লি দাঙ্গা মামলার কথিত ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল গ্রেফতার করে। পুলিশ দিল্লি দাঙ্গার বিষয়ে উমর খালিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট ফাইল করে যা ২০২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে দিল্লি আদালতে গৃহীত হয়। উমর খালিদ ২০২১ সালের জুলাইয়ে জামিনের আবেদন করেন, ৮ মাস দীর্ঘ শুনানির পর তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করা হয়। এই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর বেআইনি কার্যকলাপ আইনের অধীনে তিহার জেলে দুই বছর পূর্ণ করলেন উমর খালিদ।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ভারতের প্রেস ক্লাবে ন্যায় বিচারের অন্বেষণে একটি সংহতি সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি অনেক ছাত্রকর্মীই সংহতির বার্তা দেন। উমরের মা সাবিহা খানুমও উপস্থিত ছিলেন এই সভায়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জেএনইউএসএউয়ের ছাত্রকর্মী অপেক্ষা প্রিয়দর্শিনী। সভার শুরুতেই তিনি জানান, কীসের জন্য তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন এবং নাগরিকত্বের জন্য জাতীয় সাম্প্রদায়িকীকরণে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্যই তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। প্রিয়দর্শিনী জানান, উমর কখনই এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দাবি করেননি। বরং তিনি বারেবারে জানিয়েছিলেন, এই প্রথমবার সারা দেশের নাগরিকরা একত্রিত হয়েছিলেন একদল মুসলিম মহিলার নেতৃত্বে এবং তাঁরা এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন।

বস্তুত শাহিনবাগের মহিলারাই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জামিয়ায় ছাত্রদের উপর নৃশংস দমন-পীড়নের পরে সিদ্ধান্ত নেন যে আর চুপ থাকা যাবে না। তাঁরা সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ডেকে আনেন। প্রিয়দর্শিনী বলেন, “এই বিক্ষোভ যে এত ব্যাপক ছিল, সেই বাস্তবতাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। সেই সময়ে আমাদের বহু নাগরিকই সমর্থন করেছিলেন এটি। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে থেকে অনেকেই পিছু হটে যাচ্ছেন।”

শাহিনবাগের প্রতিবাদের একটি ভিডিও ক্লিপ এবং উমর খালিদের গ্রেফতারির ঠিক আগের একটি ভিডিও ক্লিপ দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। উমর খালিদ, তাহির হোসেন, শোয়েব আলম, খালিদ সাইফি, শাদাব আহমেদ, শিফাউর রহমান সহ আরও অনেক নেতাকর্মীরা রয়েছেন যাদের আইনের নামে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সকলকেই কারাগার থেকে মুক্ত করার দাবি জানানো হয় এই সভা থেকে।

আরও পড়ুন- আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ

সভার উদ্বোধনী বক্তা ছিলেন ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলি শ্রী। তিনি জানান, উমর খালিদের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা বোধ করেন তিনি। গীতাঞ্জলি আরও জানান, আইনের নামে দুই বছর ধরে জেলে রয়েছেন উমর। আদালত বলছে, উমর এতটাই ‘বিপজ্জনক’ যে জামিনেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। “আজ মানুষ প্রশ্ন করে বলে তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয় এবং এটিই ঘটেছে উমর এবং অন্যদের সঙ্গে। উমর এই অন্যায় কারাবাসের শেষ চায়”, বলেন গীতাঞ্জলি শ্রী।

প্রাক্তন বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ বলেন, “ইউএপিএ নিয়ে আমার অবস্থান খুব স্পষ্ট। এটা আমাদের সঙ্গে খাপ খায় না। ফৌজদারি আইনশাস্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইন দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যাক্তিকে নির্দোষ মনে করে। ফৌজদারি আইনের এই মৌলিক নীতিটি আইনশাস্ত্রের কোন নিয়মে বাতিল করা হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারছি না। আমি বিস্মিত যে আদালত কীভাবে এই অবস্থান গ্রহণ করেছে!”

অ্যাডভোকেট শাহরুখ আলম এফআইআরের বিরুদ্ধে মত পোষণ করে একে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মহড়া বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “২০১৯ সালের কুখ্যাত এই এফআইআর ‘রাজনৈতিক’ ছাড়া কিছুই নয়। আমি চাই আদালত আরও কিছু করুক এবং রাষ্ট্রকে বলুক আদালতে যেন রাজনীতি না নিয়ে আসা হয়।” আরজেডির রাজ্যসভার সদস্য মনোজ ঝা বলেন, “এটা দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও উমর, শারজিল এবং মীরনের মতো ব্যক্তিরা কারাগারের পিছনে।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “একদিকে গণধর্ষকদের সংস্কারী বলা হচ্ছে, তাহলে কেন এদের কারাগারে রাখা হয়েছে?” সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, “দুর্নীতিবাজ, খুনি, ধর্ষকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করেন, কেউ কেউ তো সংসদেও বসেন আর যারা দেশ রক্ষার জন্য, শিক্ষা রক্ষার জন্য জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন, সেই আলিগড়ের বা জামিয়ার ছাত্ররা বুলডোজার-পিষ্ট হচ্ছেন। উমর এই বিরক্তিকর প্রবণতার উদাহরণ।”

জেএনএউএসইউ সভাপতি ঐশী ঘোষ বলেন, “উমর সবসময় ছাত্র হিসাবে যে কোনও জায়গায় যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এই কারণেই রাজনৈতিক বন্দিদের কণ্ঠ এত সমালোচনামূলক।” ঐশী আরও জানান, বিজেপি-আরএসএস এই ধরনের কণ্ঠস্বর, ছাত্র এবং যুবদের ভয় পায়। “বিজেপি-আরএসএস উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভেড়া এবং ভেড়ার বাচ্চা উৎপাদন করতে চায়। তাই তারা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে পড়াশোনার, সমালোচনার মান কমিয়ে দিতে চায়।”

আরও পড়ুন- রাজনীতিতে ভরসা নেই যুবসমাজের, বিস্ফোরক তথ্য উঠে এল সমীক্ষায়

ন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ইন্ডিয়ান ওমেনের সম্পাদক অ্যানি রাজা বলেন, “আমরা উমর খালিদের জন্য আমাদের সংহতি প্রকাশ করছি। সরকার খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ। সরকার সমস্ত কঠোর আইন ব্যবহার করে বুদ্ধিজীবিদের জেলবন্দি করছে।” দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকর্মী কৌশল বলেন, “রাজনৈতিক বন্দিদের অভিজ্ঞতা থেকে জেলের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে আমরা ভালোভাবেই জানি। জেএনএউতে থাকাকালীন আমি উমর আর শারজিল দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেছি। তাঁরা অহিংস প্রতিবাদের পথেই তর্ক করেছেন। আমি উমর ও শারজিলের প্রতি আমার সংহতি প্রকাশ করছি।”

উমর খালিদের মা সাবিহা খানুম বলেন, “উমর অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জেলের ভিতরে সমস্ত অগ্নিপরীক্ষা মোকাবিলা করছে। আমি যখনই ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলি, আমি ওর শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। ও নিজের অসুবিধার কথা শেয়ার করে না। সবসময় হাসিমুখে কথা বলে।” উমরের মা আরও জানান, বাটলা হাউসের এনকাউন্টারের পর উমর নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার অন্য ভাইবোনরা পেশাগত দিক দিয়ে ভালো কাজ করছে। উমর ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো, ফলে চাইলে তিনিও পেশাগতভাবে অনেক ভালো থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার পথ বেছে নেন। “আমরা যখন আমাদের ভয় থেকে মুক্ত হব, তখনই আমরা এই নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হারাতে পারব। আমি শুধু উমর নয়, সকল রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করছি,” বলেন উমরের মা সাবিহা।

More Articles