ক্রিকেটের লুপ্তপ্রায় সৌন্দর্যের নাম উমরান
ক্রিকেটের মরশুম বদলে গেছে। আগে ক্রিকেট মরশুমের সূচনা বলতে বোঝাত অঘ্রাণ মাস। যখন সন্ধে না নামতেই শিশির পড়তে শুরু করে, গা শিরশির করে ভোরের দিকে। আর মরশুমের শেষ, যখন মাঘের শীত বাঘের গায়। মাঝের মাসগুলোতে ইডেন উদ্যানে বসত টেস্ট বা একদিনের ক্রিকেটের আসর। প্রবীণ ক্রিকেটপ্রেমীরা এখনও শোনান ভাগবত চন্দ্রশেখরের ম্যাচ জেতানো স্পেলের কথা বা সোনালি চুলের টনি গ্রেগকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা। আমাদের প্রজন্মের কাছে অমূল্য স্মৃতি নয়ের দশকের মাঝামাঝি হিরো কাপের সেমিফাইনাল, ওই দশকের গোড়ায় দুর্বার গতির অ্যালান ডোনাল্ড আর অফসাইডের চিনের প্রাচীর জন্টি রোডসকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা। মরশুম দীর্ঘায়িত হয়েছে অনেকদিন হল। ২০০১ সালে যেদিন অস্ট্রেলিয়ার সর্বনাশ সম্পূর্ণ হল হরভজনের হ্যাটট্রিক আর রাহুল দ্রাবিড়-ভিভিএস লক্ষ্মণের যুগলবন্দিতে, সেদিন চৈত্র মাস। অবশ্য গত শতাব্দীতেই জৈষ্ঠ্যের প্রখর তপন তাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে ইডেন থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ জিতে নিয়ে গেছে অর্জুনা রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। ঠান্ডা পানীয়ের কোম্পানি টুর্নামেন্টের টাইটেল স্পনসর হলে যা হয়! এরপর আরও দুটো দশক কেটে গেছে। এখন খেলা হয় সারা বছর, আর ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে বড় উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রিমিয়ার লিগ– আইপিএল। তাই এবারও কাঠফাটা গরমে ইডেনে বসবে ক্রিকেটের আসর– আইপিএল প্লে অফ।
শুধু মরশুম নয়, খেলাটাও বদলে গেছে বিস্তর, আবিশ্ব। সারা বছর ক্রিকেটের যুগে বিশ্রামের সময় নেই, গতি আসবে কোথা থেকে? অতএব, এখন চাহিদা আস্তে বল করতে পারা জোরে বোলারের। স্লোয়ার, চেঞ্জ অফ পেস ইত্যাদি বাহারি নামের মন্থরতা আবিষ্কৃত হয়েছে। স্পিন শিল্পে শান দিয়ে আরও ধারালো হয়ে ওঠারও সময় নেই। তাই চাহিদা জোরে বল করতে পারা স্পিনারের, যার বল সাধারণত সোজা যাবে, ঘুরলেই রহস্য তৈরি হবে। শুধু কি তাই? এখন ক্রিকেট খেললে গ্লেন ম্যাকগ্রা, কোর্টনি ওয়ালশ-রা বিশেষ পাত্তা পেতেন না। কারণ তাঁরা ব্যাট করতে পারতেন না একেবারেই। এখন প্যাট কামিন্সের মতো বোলারেরও ব্যাট হাতে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা থাকা দরকার। সুনীল নারিনকেও ইনিংসের শুরুতে বা মিডল অর্ডারে চার-ছক্কা হাঁকাতে জানতে হয়। অর্থাৎ, অসামান্য বোলার বা ব্যাটারের চেয়ে মাঝারি মানের অলরাউন্ডার বেশি প্রার্থনীয়।
ফলে ক্রিকেটের আদি অকৃত্রিম সম্পদ– কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া ফাস্ট বোলার, যে কোনও পরিবেশে বল দু'দিকে সুইং করানোর ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াম ফাস্ট বোলার, খাঁটি লেগ স্পিন বা অফ স্পিনের রহস্যে ব্যাটারদের নাজেহাল করে দেওয়া স্পিনার, নিখুঁত ডিফেন্সসম্পন্ন এবং ছবির মত কভার ড্রাইভ মারতে পারা ব্যাটাররা ডোডোপাখি হয়ে যাচ্ছেন। কেবল কুড়ি বিশের ক্রিকেটে নয়, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে বা টেস্টেও তাঁদের পক্ষে দলে টিকে থাকা শক্ত হচ্ছে। বরং এইসব গুণ থাকা দোষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেকের ক্ষেত্রে। ভুবনেশ্বর কুমারের মতো সুইং শিল্পীর যেমন টেস্ট কেরিয়ার বলে কিছু হলই না। কারণ প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক– সকলে সিদ্ধান্ত করে ফেললেন, এ সুইং সহায়ক পিচ ছাড়া সুবিধা করতে পারবে না। অথচ স্রেফ লম্বা, বেশি বাউন্স আদায় করতে পারেন– এই যুক্তিতে হাতে গোনা কয়েকটা বলার মতো পারফরম্যান্স নিয়েই একশো টেস্ট খেলে ফেললেন ইশান্ত শর্মা (জোরে বোলারদের মধ্যে একশোর বেশি টেস্ট খেলার পরেও উইকেট পিছু ৩২-এর বেশি গড় ইশান্ত ছাড়া কেবল জাক কালিসের, কিন্তু তিনি ব্যাট হাতে তেরো হাজার রানও করেছেন)। ব্যাট করতে পারেন বলে রবীন্দ্র জাদেজা টেস্টেও রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো প্রবল শক্তিধর এবং মেধাবী বোলারের জায়গা দখল করে রাখতে পেরেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ।
আরও পড়ুন: ক্রিকেট, প্রেমিকা, ড্রাগ… || শেন ওয়ার্নের গোটা জীবনটা বিতর্কের নামান্তর
অর্থাৎ, ছোট ছোট মাঠে ঘণ্টায় ১৩০-১৪০ কিলোমিটার গতির বল আর দড়কচা ‘মিস্ট্রি’ স্পিনারদের বিরুদ্ধে পেশিবহুল ব্যাটারদের চার, ছক্কার বন্যা– এই হল আজকের ক্রিকেটোৎসব। যে দলের ব্যাটাররা ব্যর্থ হবেন, তাঁরা হারবেন। সেদিন প্রতিপক্ষের বোলারদের মনে হবে অসাধারণ, পরের দিনই হয়তো অতি সাধারণ দেখাবে। এই মরশুমে যাকে মনে হচ্ছে জিনিয়াস, পরের মরশুমেই সে ভিড়ে হারিয়ে যাবে। নামটা স্বপ্নিল অসনোদকর, পল ভালথাটি, মনপ্রীত গোনি, বরুণ চক্রবর্তী– যা খুশি হতে পারে। এমনকী, রতিতেও ক্লান্তি আসে, আর এই জিনিস দিনের পর দিন দেখতে হলে ক্লান্তি আসবে না? লাইভ সম্প্রচারের জাঁকজমক যাই-ই প্রমাণ করার চেষ্টা করুক, আইপিএল দেখতে দেখতেও দর্শকের ক্লান্তি আসে। সম্প্রচারকারী, বিজ্ঞাপনদাতা এবং আইপিএল কর্তৃপক্ষ সে কথা বিলক্ষণ জানে। তাই এবারের আইপিএলে প্রত্যেক ম্যাচে যত্ন করে দেখানো হচ্ছে, ম্যাচের দ্রুততম বলটা কে করল। সেই বোলারের জন্য এক লক্ষ টাকা পুরস্কারও থাকছে। বারবার কে পাচ্ছেন সেই পুরস্কার? ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কেউ নন, কোনো অস্ট্রেলিয়ানও নন, এমনকী নিউজিল্যান্ডের লকি ফার্গুসনও নন। পরপর ছ'টা ম্যাচে এই পুরস্কার পেয়েছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের উমরান মালিক।
আগেই বলেছি, বিশ্ব ক্রিকেটে এখন যথার্থ ফাস্ট বোলার, অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে যে কোনো পিচে গড়ে ৯০ মাইলের (প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার) বেশি গতিতে বল করতে পারেন এরকম বোলার বিরল। নিজেদের সেরা দিনে যশপ্রীত বুমরা আর মহম্মদ শামি পৌঁছে যান ওই গতিতে। মাঝে মাঝে নতুন বলে মিচেল স্টার্ক আর কামিন্সও পারেন। উমরান কিন্তু নিয়মিত ওই গতিতে বল করছেন, ১৫০ কিলোমিটারের গণ্ডিও পেরিয়ে যাচ্ছেন প্রায়ই। উমরানের মন্থরতম বলটাও ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকে। মুম্বইয়ের প্রবল গরমে এত জোরে বল করছেন কী করে? বিস্মিত হর্ষ ভোগলের এই প্রশ্নের উত্তরে উমরান বলেছেন, আমাদের জম্মুতে তো প্রচণ্ড গরমেও খেলি। ওতে কষ্ট হয় না, বরং মজা লাগে। কিন্তু গতিই শেষ কথা নয়। নইলে ব্রেট লি আর শন টেটের তফাত থাকত না। বলের লাইন, লেংথ ঠিক না থাকলে গতিময় বোলিংয়ে কোনও লাভ হয় না। উমরানের সেখানেও ভুল নেই। নেই বলেই রবিবার (১৭ এপ্রিল) পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে একটাও রান না দিয়ে তুলে নিতে পেরেছেন তিন-তিনটে উইকেট, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার। ওই ম্যাচের চার উইকেট নিয়ে আইপিএলে ছ'টা ম্যাচ খেলে ন'টা উইকেট নেওয়া হয়ে গেল।
কিন্তু উমরানের আসল প্রভাব পরিসংখ্যানে ধরা পড়েনি। সত্যিকারের ফাস্ট বোলিং যা করে তার সবটা কখনওই স্কোরবোর্ডে ধরা পড়ে না। ২০১৩-'১৪ অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মিচেল জনসন ইংল্যান্ডের কী অবস্থা করেছিলেন, তা কেবল পাঁচ টেস্টে ৩৭টা উইকেট নেওয়ার তথ্য থেকে বোঝা যাবে না। ওই বোলিং দেখলে তবেই বোঝা যায়, ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা কেমন মরার আগেই মরে বসে থাকতেন জনসনাতঙ্কে। কেভিন পিটারসেনের মতো বড় ব্যাটার কেমন ছেলেমানুষের মতো আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়েছেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ক্লাইভ লয়েডের পেস চতুষ্টয়ের কোনও স্পেল দেখুন ইউটিউবে, জেফ থমসনের বোলিং দেখুন, বা কার্টলি অ্যামব্রোসের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এক রান দিয়ে সাত উইকেট তুলে নেওয়া দেখুন। ইডেন উদ্যানে তখনও অখ্যাত শোয়েব আখতারের পরপর দু'বলে রাহুল আর শচীন তেণ্ডুলকরকে আউট করা ফিরে দেখুন। পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যায় উমরান কলকাতা নাইট রাইডার্স অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ারকে বোল্ড করার পর ছেলেমানুষের মতো উল্লাস করছিলেন যিনি, সেই ডেল স্টেইনের বোলিংয়ের ভিডিও দেখুন। বুঝতে পারবেন ভয়ংকর সুন্দর কাকে বলে। এমন সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন, আর এই নেশা ধরানো সৌন্দর্যেরই মালিক উমরান।
আরও পড়ুন: ঝুলন সেরা বাঙালি ক্রিকেটার? মোটেই না
তিনি আইপিএলের চার, ছক্কায় ঝলমলে সন্ধেবেলায় ব্যাটারদের প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে প্রাণ হাতে করে বাঁচা তৃণভোজীদের স্তরে নামিয়ে আনতে পারেন। কেকেআর ম্যাচে শ্রেয়স আর আন্দ্রে রাসেলের বিরুদ্ধে তাঁর বোলিং যে কোনও ক্রিকেট-রসিকের চোখে লেগে থাকবে। শ্রেয়স বারবার লেগের দিকে সরে গিয়ে উমরানকে খেলার চেষ্টা করছিলেন। অফসাইডে সীমানার কাছাকাছি একাধিক ফিল্ডার থাকা সত্ত্বেও এই কৌশল কেন, তা ধারাভাষ্যকাররা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সম্ভবত, বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিই তাঁদের বুঝতে দিচ্ছিল না। কারণ পাড়ার মাঠে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও বোঝা যায় ওটা কৌশল ছিল না, ছিল আত্মরক্ষার তাগিদ। একনাগাড়ে সামান্য শর্টপিচ বল করে ব্যাটারকে ওভাবে কুঁকড়ে দিয়ে, তারপর ইয়র্কারে বোল্ড করে দিতে আমরা দেখেছি ওয়াকার ইউনিসকে। রোমাঞ্চিত হয়েছি। এই রোমাঞ্চ গত দশ বছরে বিশ্ব ক্রিকেট থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলা উমরান সেই রোমাঞ্চ ফিরিয়ে দিচ্ছেন আইপিএলের মঞ্চে।
ওই গতি দর্শককে রোমাঞ্চিত করে, ক্রিকেট দেখার সাবেকি আনন্দ ফিরিয়ে আনে। কিন্তু খেলাটার জন্য কী করে? মাঝারিয়ানাকে উলঙ্গ করে দেয়, খুব ভাল ক্রিকেটার আর মহান ক্রিকেটারের তফাত গড়ে দেয়। পৃথিবীজুড়ে চার, ছয় মেরে বেড়িয়ে ভূয়সী প্রশংসা পাওয়া রাসেল যেমন শুক্রবার ওই একটি ওভারে টের পেয়ে গেলেন তিনি ভিভ রিচার্ডস তো দূরের কথা, গর্ডন গ্রিনিজেরও যোগ্য উত্তরসূরি নন। ব্যাটে-বলে করতেই বিস্তর ঝামেলায় পড়লেন, একটা বাউন্সারে তো মাথা বাঁচাতে একেবারে শুয়ে পড়তে হল।
কুড়ি বিশের ক্রিকেটের মুশকিল হলো, উমরানের সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার উপায় নেই। মাত্র চব্বিশটা বল, তার ওপর সীমানা এত ছোট করা আছে যে চোখ বুজে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেও এক-আধটা ছয় হয়ে যায়। এখন অবধি মাত্র তিনটে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা উমরান দিনে ১৫-২০ ওভার বল করলেও এই গতি বজায় থাকবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। উমরানের আগুনে সৌন্দর্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের দগ্ধ করবে কি না, সে আলোচনাও এখন থাক। আপাতত জম্মুর ছেলের শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভোগ করে নিন। যৌবন আর গতি, দুটোই হারিয়ে যায়। বিশেষত জম্মু, কাশ্মীরের যৌবন আগলে বসে থাকা যায় না।
ঋণ: সাহেবদের থেকে শেখা খেলা দেখার অভিজ্ঞতাকে বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অধ্যাপক অভীক মজুমদারের এক সাম্প্রতিক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধের প্ররোচনায়। দেখা গেল তাতে ভাষাটা বেশি কাব্যিক হল। উমরানের ক্রিকেট কাব্যময়।