তাপপ্রবাহ থেকে ঝড়ঝঞ্ঝা, আরও করাল হবে প্রকৃতি! কী কারণে এত দুর্যোগ?

গত এক সপ্তাহ যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চলছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। বৃষ্টির দেখা নেই। এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে একাধিক দিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ দেখা যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে সাইক্লোনের ভয়াবহতা বিপুলভাবে বেড়েছে। আমফান, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ই তার প্রমাণ। প্রকৃতি খামখেয়ালি হয়েছে, এমনটাই শুধু নয়। আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে- অসময়ের বৃষ্টি বানভাসি অবস্থা ডেকে আনছে, বিধ্বংসী সাইক্লোন তছনছ করে দিচ্ছে উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে উপকূল থেকে দূরবর্তী ভূ-ভাগকে, তাপপ্রবাহ চলছে নাগাড়ে। এদিকে বৈশাখ শেষ হতে চলল, কালবৈশাখীর দেখা নেই, এতই শুষ্ক দক্ষিণবঙ্গের বুকে বয়ে চলা বাতাস!

কিন্তু এখানেই থামবে না প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ। সম্প্রতি জাতিসংঘের তরফে জানানো হয়েছে, আগামী দিনে আরও বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা। আরও করাল হবে প্রকৃতির রূপ। ঝড়ঝঞ্ঝার পাশাপাশি বাড়বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা। পাল্লা দিয়ে বাড়বে খরা ও দাবানলের মতো ঘটনা।

জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা পৃথিবীতে মোট প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ছিল ৪০০-র কাছাকাছি। কিন্তু ২০৩০, অর্থাৎ আর আট বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫৬০-এ। অথচ তুলনা টানলে দেখা যাবে, ইতিমধ্যেই, ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবী নব্বই থেকে একশোটি মাঝারি থেকে ভয়াবহ হারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে।

জলবায়ু দূষণ এবং দেশের অর্থনীতি কিন্তু ওতপ্রোতভাবে পরস্পরকে প্রভাবিত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যার মানুষ এমন অঞ্চলে বসবাস করেন, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-জনিত ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িগুলো নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে বানাতে বাধ্য হন পিছিয়ে পড়া দেশের মানুষরা। পাশাপাশি গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট বা জিডিপি নীচের দিকেই থাকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে।

আরও পড়ুন: আকাশের বুকে বয়ে যাচ্ছে নদী, আর তাতেই হু হু করে বাড়ছে তাপমাত্রা?

বিশ্বব্যপী কোভিড অতিমারীর পর ভারতের জিডিপি কমে ২.৩২ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে দারিদ্রের হার। পাশাপাশি জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। ফলে নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ বাধ্য হয়েছে এমন জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হতে, যার থেকে কার্বন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উচ্চ হারে নির্গত হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং গ্রাম-শহর নির্বিশেষে প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষরা দারিদ্র, তাঁরা দেনার প্রভাবে বাধ্য হয়েছেন এই ধরনের সস্তা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হতে।

ফলস্বরূপ বাড়ছে দূষণের হার। কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ফল মানুষকে ভুগতে হয় পাঁচ থেকে দুশো বছর অবধি। হ্যাঁ, সময়টা এতটাই দীর্ঘ। বলার অপেক্ষা রাখে না, কেন পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব, তথা সাইক্লোন, তাপপ্রবাহ, ক্ষরা, দাবানলের মতো একাধিক বিষয় ক্রমাগত বাড়বে, কেন প্রবল হবে তাদের করাল রূপ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা বাড়ায়, তাও বলা বাহুল্য।

প্রবল তাপপ্রবাহের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাড়বে ভয়াবহ ভাবে, তুলনা করলে যার প্রাবল্য ২০২১ সালের তুলনায় তিনগুণ বেশি। কিন্তু এর ফলে প্রতি বছরই মারাত্মক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যার প্রভাব অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির ওপর প্রকট হলেও, বাদ যায় না উন্নত দেশগুলোও। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত থেকে উন্নত দেশগুলো নিজেদের দ্রুত সারিয়ে তুললেও, পিছিয়ে পড়া দেশগুলি অর্থাভাবে তা পারে না। সেই নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়েই ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট মেরামত করা হয়। পরবর্তী দুর্যোগে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তা-ও। যেন ক্ষতর ওপর ক্ষত, ক্ষতির ওপর ক্ষতি এসে জাঁকিয়ে বসে।

তবে এমন নয় যে, আগামীদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলির পিছনে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনেরই হাত আছে। সেই ঘিয়ে আগুন ঢেলেছে কোভিড অতিমারী, বিশ্বব্যাপী আর্থিক অবনমন, এমনকী খাদ্যাভাব।

জাতিসংঘের ন্যাচারাল ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশনের অধিকর্তা মামি মিজো়তোরির মতে, এইভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী এমন একটি পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়াবে, যেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। শুধু তাই-ই নয়, তিনি আরও জানাচ্ছেন, আমরা ইতিমধ্যেই একটি ক্ষতিকর চক্রের শিকার বানিয়ে তুলেছি নিজেদেরই, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিমারী, একাধিক অসুখ, খাদ্যাভাব, আর্থিক অবনমন পরস্পরের ক্ষতি করছে।

এবার আর বিলম্ব না করে দেশের অর্থনীতি যে সুষ্ঠুভাবে সামলাতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রিপোর্ট বলছে, এর জন্য রাজনৈতিক নেতা তো বটেই, এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেও।

মিজো়তোরির মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যযের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো গেছে ঠিক সময় সাবধান হয়ে। এবং সেই সাবধানতা যাতে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ অবলম্বন করতে পারে, সমস্ত স্তরের মানুষ যাতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারে, তার দিকে নজর দিতে হবে দেশের সরকারকেই।

More Articles