রাজ্যবাসীর মতামত শিকেয়, 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' পাশে প্রথম উত্তরাখণ্ড

Uniform Civil Code Bill tabled in Uttarakhand: দেশ জুড়ে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এত বিতর্ক, উত্তরাখণ্ডের বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল সেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড।

রামমন্দির গড়ার কাজ শেষ। লোকসভা ভোটের আগে এবার মোদির চোখ 'অখণ্ড ভারত'। আর সেই 'অখণ্ড' ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে চায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আর তার শুভ মহরৎ হয়ে গেল উত্তরাখণ্ডে। দেশ জুড়ে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এত বিতর্ক, উত্তরাখণ্ডের বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল সেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড। উত্তরাখণ্ডের পুষ্কর সিংহ ধামী সরকার দেশে প্রথম অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করতে চলেছে।

আপাতত সেই বিলটি অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া বাকি শুধু। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত পেলেই পার্বত্য এই রাজ্যে চালু হয়ে যাবে বিতর্কিত এই দেওয়ানি বিধি। কিন্ত রাজ্যবাসী কি আদৌ সেটাই চান। না, আশপাশে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দেখে তো তেমনটা মনে হচ্ছে না। উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় চার দিনের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল সম্প্রতি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় সেই অধিবেশন। শোনা গিয়েছিল, বুধবার শেষ দিনের অধিবেশনেই উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল পাশ করাবে। আর কার্যত হলও তেমনটাই।

আরও পড়ুন: এবার লিভ-ইন রেজিস্ট্রি না করলেই শাস্তি! কী বলা আছে বিজেপি সরকারের প্রস্তাবিত আইনে?

কী রয়েছে এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে? যতদূর জানা গিয়েছে, সব ধর্মের মানুষের জন্য বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, জমি-সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক এবং অভিন্ন আইন প্রচলনের কথা বলা হয়েছে এই আইনে। একই সঙ্গে সমস্ত ধর্ম নির্বিশেষে পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে এই আইনে। শুধু তা-ই নয়, লিভ-ইন বা একত্রবাসের ক্ষেত্রেও তা নথিভুক্ত করাতে হবে বলে জানানো হয়েছে প্রস্তাবিত ওই আইনে। ওই বিধির আওতায় কোনও যুগল যদি একত্রবাস করতে চান, সেক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই পুলিশ বা জেলা আধিকারিকদের অনুমতি নিতে হবে। আর যদি যুগলের বয়স একুশের কম হয়, সেক্ষেত্রে তাঁদের অভিভাবকদের অনুমতির প্রয়োজন হবে।

ধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘রেজিস্ট্রি বিবাহ’ বাধ্যতামূলকের কথা বলা হয়েছে এই বিধিতে। কোনও যুগল ‘লিভ-ইন’ করতে চাইলে প্রথমেই তাঁদের নাম পুলিশের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে। ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কের ‘ঘোষণাপত্র’ সঙ্গে রাখতে হবে যুগলকে। সময় মতো প্রয়োজনে তা দেখাতে ব্যর্থ হলে যুগলের ২৫ হাজার টাকার জরিমানা এবং তিন মাসের জেল হতে পারে। ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কে থাকা যুগলের যদি সন্তান হয়, তবে শিশুরা আইনি স্বীকৃতি পাবে।

Uniform Civil Code bill passed in Uttarakhand assembly

বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও রাজ্যের সকলের জন্য একই নিয়ম বলবৎ করার কথা আছে এই বিলে। দম্পতিকে নির্দিষ্ট সময় ‘কুলিং অফ’ পিরিয়ডে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে এই বিলে সন্তান দত্তক নেওয়ার নিয়ম আরও সহজ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়াও সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের সমান অধিকার থাকবে। জন্ম দেওয়া সন্তান এবং দত্তক নেওয়া সন্তান— দু’জনেই সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকারী হবে।

বিজেপির এই একগুচ্ছ আইন সংশোধন প্রস্তাবে প্রথম সায় জানিয়েছে উত্তরাখণ্ড। যদিও এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। দেশের সংবিধানপ্রণেতা বিআর অম্বেদকরের পৌত্র তথা বঞ্চিত বহুজন আঘাদি (VBA)-র প্রধান প্রকাশ অম্বেদকরের মতে, এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এইভাবে আরোপ করা যায় না। কারণ সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে তাঁদের নিজস্ব ধর্ম ও তার সংস্কার পালনের স্বাধীনতা দেয়। এই পরিস্থিতিতে যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রূপায়িত করতে হয়, সেক্ষেত্রে সংবিধানকে পুরোপুরি বদল করার প্রয়োজন রয়েছে। নাহলে এই UCC-আইন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।জনগণের তাঁদের ব্যক্তিগত ধর্ম ও আইন মেনে চলবেন, না অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানবেন, সে ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁর সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। ফলে এই ধরনের আইন রূপায়ণের চেষ্টাকে 'অপপ্রচার' বলেই মনে করছেন অম্বেদকরের পৌত্র।

Uniform Civil Code bill passed in Uttarakhand assembly

তবে তিনি যা-ই বলুন না কেন, বিজেপি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হওয়ার সম্ভাবনা যে বেশ বেশি, তা একরকম পরিষ্কার। আর সেই ছবিটাই আরও একবার পরিষ্কার করে দিল উত্তরাখণ্ড। বিধানসভায় এই বিল পাশের পর সংবাদমাধ্যমকে মুখ্যমন্ত্রী ধামী বলেন, ‘‘এই আইন সমানাধিকারের কথা বলে। এটি কারও বিরুদ্ধে নয়। এই আইন মহিলাদের জন্য, যাঁরা সমাজে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হন। এটি তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। বিলটি পাশ হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের বিধানসভা ভোটে বিজেপি জিতলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ধামী।

আরও পড়ুন: লিভ-ইন করলেও রেজিস্ট্রি করতে হবে এবার? অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে যা করতে চাইছে বিজেপি

গত বছর ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরার পরেই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তৎপর হন তিনি। উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করার আইনি প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে কমিটিও গড়েছিল সে রাজ্যের সরকার। গত শুক্রবার সেই কমিটি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়া রিপোর্ট তুলে দেয়। তার পর এই বিল পাশ হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। এখন বাকি শুধু রাষ্ট্রপতির হাত থেকে অনুমোদন মেলার। সেটুকু হয়ে গেলেই উত্তরাখণ্ড হবে দেশের প্রথম রাজ্য, যেখানে বলবৎ হবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। কিন্তু উত্তরাখণ্ডে এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। মানুষ কি চায় আদৌ এই অভিন্ন আইন, 'অখণ্ড' ভারত! সেই সমীক্ষা কি আদৌ চালিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার? প্রশ্ন থাকছেই। 

More Articles