কলকাতায় সত্যিই রয়েছে ফেলুদার বাড়ি?

প্রদোষচন্দ্র মিত্র অথবা ফেলুদা বাঙালির খুব প্রিয় এক চরিত্র। ফেলুদার ব্যাপারে প্রায় সব তথ্য বাঙালির নখদর্পণে থাকলেও তার পরিবারের ব্যাপারে বেশি কিছু জানা যায় না।

 

নাম- সন্ধ্যা শশী বন্ধু। পেশা- সূক্ষ সাল শস্য। উচ্চতা ছয় ফুট দুই ইঞ্চি, স্বাস্থ্যবান। বিভিন্ন রকমের বই পড়ে। প্রিয় বই- আরণ্যক। সাধারণ জ্ঞানের পরিধি ব্যাপক। বাঙালি, জনপ্রিয় এবং কাল্পনিক। মার্শাল আর্টে পারদর্শী। প্রত্যেক দিন সকালে যোগব্যায়াম করে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া পছন্দ করে। হেঁয়ালি, সমাধান এবং শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালবাসে। সিগারেট বলতে চারমিনার এবং খাওয়ার পর পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। পকেটে কোল্ট .৩২ থাকলেও তার প্রধান অস্ত্র অদৃশ্য। সেই অস্ত্রের নাম মগজাস্ত্র।

প্রদোষচন্দ্র মিত্র অথবা ফেলুদা বাঙালির খুব প্রিয় এক চরিত্র। ফেলুদার ব্যাপারে প্রায় সব তথ্য বাঙালির নখদর্পণে থাকলেও তার পরিবারের ব্যাপারে বেশি কিছু জানা যায় না। ফেলুদার তদন্তের পদ্ধতি খুব খুঁটিয়ে দেখলে এবং পড়লে তার পরিবার এবং ইতিহাস সম্পর্কে অল্প কিছু জানা যায়। ফেলুদার প্রথম আবির্ভাব ১৯৬৫ সালে। 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' গল্প প্রকাশের সময় তার বয়স ২৭ বছর। সেই হিসেবে ফেলুদার জন্ম হয়েছে ১৯৩৮ সালে। ফেলুদার পৈতৃক বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের সোনাদিঘি গ্রামে। ফেলুদার বাবার নাম ছিল জয়কৃষ্ণ মিত্র। তিনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন। স্কুলে অঙ্ক এবং সংস্কৃত পড়াতেন। কলকাতায় ফেলুদা প্রথমে তারা রোডের ভাড়া বাড়িতে থাকত, তারপর সেখান থেকে উঠে যায় রজনী সেন রোডের বাড়িতে। এই ২১ নম্বর রজনী সেন রোড ফেলুদার পাকাপাকি বাসস্থানে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার এই যে, ফেলুদার মতো তার বাড়িটিও কাল্পনিক। বাস্তবে, দক্ষিণ কলকাতায় রজনী সেন রোডে ২১ নম্বর বাড়িটি নেই। তবে, উত্তর কলকাতার শচীন মিত্র লেনে একটি বাড়ি রয়েছে, যার নামের ফলকে লেখা রয়েছে পি. সি. মিটার।

 

Joy Baba Felunath

'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর একটি দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সন্তোষ দত্ত

ফেলুদার যখন নয় বছর বয়স তখন তার মা, বাবা মারা গিয়েছিলেন। তারপর তার কাকা তাকে মানুষ করে। ফেলুদার কাকার নাম বিনয় মিত্র। ফেলুদা তার কাকার পরিবারের সঙ্গেই থাকে। যদিও উপার্জন বেড়ে যাওয়ার পরে সে একবার অন্য ফ্ল্যাট খোঁজার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কাকার ধমক খেয়ে সেই প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয়। এই কাকার ছেলের নাম হলো তপেশরঞ্জন মিত্র। যদিও 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' গল্পে ফেলুদা ছিল তপেশের মাসতুতো দাদা, কিন্তু পরে ফেলুদার সৃষ্টিকর্তা সত্যজিৎ রায় এই সম্পর্কের পরিবর্তন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তপেশ হয়ে যায় ফেলুদার খুড়তুতো ভাই।

আরও পড়ুন: শিশুদের কাছে বিজ্ঞানকে সহজ করে তুলেছিলেন, বাঙালি মনে রাখেনি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হওয়া 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' গল্পে তপেশের বয়স ছিল সাড়ে তেরো বছর। সেই হিসেবে তার জন্ম হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ফেলুদার প্রথম তদন্ত থেকেই সে ফেলুদার সহকারী। তার জবানিতেই আমরা ফেলুদার সব তদন্তের গল্প জানতে পারি। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও ফেলুদা যাকে জ্যাঠা বলে সম্বোধন করে, সেই সিধুজ্যাঠা অথবা সিদ্ধেশ্বর বোস ফেলুদার বাবার প্রতিবেশী ছিলেন। প্রতিবেশী হিসেবে ফেলুদার বাবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং ফেলুদার আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা এবং পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার কারণে সিধুজ্যাঠা ফেলুদাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সিধুজ্যাঠা থাকেন সর্দার শঙ্কর রোডের একটি বাড়িতে। ফেলুদা মাঝে মাঝেই সেই বাড়িতে পরামর্শের জন্য যায়।

Sonar Kella

'সোনার কেল্লা'-র শুটিংয়ে সত্যজিৎ রায়

প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত মনোযোগ এবং বুদ্ধিমত্তা ফেলুদাকে শুধু সিধুজ্যাঠার স্নেহ অথবা তপেশের প্রশংসা এনে দেয়নি, তাকে বহু তদন্তে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, কথা নিয়ে খেলতে ভালোবাসা এবং মনোযোগের কারণেই সে বহু হেঁয়ালির সমাধান করতে পেরেছে। এই কারণেই মহেশবাবুর লেখা নবরত্ন বাঁদরের হিসেবে দুই হাজার পা অথবা আদিত্য সিংহ রায়ের দিক পাও ঠিক ঠিক জবাব-এর জবাব ফেলুদা খুঁজে পেয়েছিল। বাঁদরের প্রজাতির নাম এবং স্ট্যাম্প ক্যাটালগের কোম্পানির নাম যে একই, সেটা জানার জন্য সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে সমস্ত ব্যাপার ভাবা দরকার ছিল। একইভাবে মুড়ো হয় বুড়ো গাছের 'হয়' বুঝতে না পেরে সাহিত্যিক লালমোহনবাবু হাল ছেড়ে দিলেও ফেলুদা ঠিক ধরে ফেলে। ক্যাপ্টেন স্পার্ক যখন বলেছিল যে, গণেশ আফ্রিকার রাজার কাছে রয়েছে, তখনও সময় লাগলেও ফেলুদা সেই হেঁয়ালির সমাধান করেছিল। কখনও, "ত্রিনয়ন ত্রিনয়ন এট্টু জিরো", আবার কখনও "আজ থেকে পাঁচ বাদ"-এর মতো হেঁয়ালি বারবার ফেলুদার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ফেলুদা স্বভাবতই সেগুলির সমাধান করতে পেরেছে। নিজেও বহুবার কথা নিয়ে খেলেছে। তার বন্ধু লালমোহনবাবুর নাম সাংকেতিকভাবে বলতে গিয়ে বলেছেন "রক্তবরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে মরণ।" পুরীতে রহস্যের তদন্তে নেমে লালমোহনবাবুকে বলেছে, হত্যা এখনও হয় নি তাই হত্যাপুরীর বদলে চুরিপুরী বলতে পারেন।

ফেলুদা কাল্পনিক হলেও সে যেন সাধারণ মানুষের পরিচিত, রক্তমাংসের জীবিত মানুষ। তার পরিবারের ইতিহাসের প্রচুর তথ্য সবার অগোচরে রেখে সে নিজেই মানুষের জন্য একটা হেঁয়ালি রেখে দিয়েছে।

More Articles