কেন ডাকাতরা মা কালির পুজো করে?

কালিপুজোর সাথে ডাকাতদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার গল্প আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কমবেশি জানি। আগেকার দিনের হাড় হিম করা ডাকাতদের ডাকাতির গল্প আমরা শুনেছি প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর। ইয়াপ বড় বড় পেটাই চেহারার ডাকাতরা যে কোনও ডাকাতির আগেই মা কালির পুজো করতেন, মা কে প্রসন্ন করতে দেওয়া হতো নরবলি পাঁঠাবলি। তারপর 'হা রে রে রে' শব্দে তারা বেরোতো ডাকাতি করতে। ডাকাতি সেরে এসে ডাকাতরা লুন্ঠন করা সামগ্রী মায়ের পায়ে সমর্পণ ও করতেন। কিন্তু কেন? ডাকাতদের সাথে মা কালির কী সম্পর্ক? সেটাই জেনে নেবো আজ।

প্রায় ১১০ বছরের বেশি সময় ধরে নদীয়ার মাজদিয়া ঘোষপাড়ায় ডাকাতে কালিতলায় ডাকাত কালির পুজো হয়ে আসছে। প্রতিবছর ধুমধাম করে পালন করা হয় এই পুজো। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসেন মায়ের দর্শন করতে। মা নাকি খুবই জাগ্রত। একাগ্র চিত্তে মায়ের কাছে যা মানত করা হয়, সেই মনকামনা মা পুণ্য করে থাকেন। এই কালি পুজো নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন গায়ের লোম খাড়া করা গল্প। যে গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মা কালির সাথে ডাকাতদের সম্পর্ক। 

তখন ইংরেজ আমল। নদীয়ার এই অংশে গ্রামের মানুষদের চরম দুর্দশা। গ্রামের মানুষ খেতে পাচ্ছে না, চরম দুর্ভোগে কাটছে তাদের জীবন। রুগী মানুষদের চিকিৎসা হচ্ছে না। এমন সময় গ্রামের তরুণ সাহসী যুবকরা সিদ্ধান্ত নেন তারা এইভাবে গ্রামের মানুষদের মরতে দিতে পারেন না। অতঃপর? উপায় কী? ডাকাতি। তারা ঠিক করেন যাদের জন্য গ্রামের মানুষের এই হাল, তাদের ওপরই ডাকাতি করবেন। ইংরেজদের মাল বোঝাই ট্রেন লুন্ঠন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ডাকাতি করার পর যা সম্পত্তি পাওয়া যাবে তা গ্রামের অসহায় মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। 

যা ভাবা তাই কাজ, ঢাকার দিকে ব্রিটিশদের একটি মাল বোঝাই ট্রেন যাচ্ছিলো। ইংরেজদের তখন কড়া শাসন ভারতের বুকে। তাদেরই শাসনে তাদের ওপরেই ডাকাতি করা চারটিখানি কথা নয়। গ্রামের সাহসী তরুণেরা সে'সবের পরোয়া না করে, তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন ট্রেন ডাকাতি করার। মাজদিয়ার ইছামতি নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছিলো। লণ্ঠনের আলো দেখিয়ে ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড় করানো হয় ট্রেন। একের পর এক ডিব্বা থেকে নামানো হয় ট্রেনের সমস্ত মাল। কাপড়, কাঁচা আনাজ, দামি সামগ্রী। কিছুই বাদ দেওয়া হয় না। খবর চলে যায় ইংরেজদের কানে। তৎক্ষণাৎ ইংরেজদের বিশাল বাহিনী হাজির হয় ইছামতির ব্রিজে। 

ডাকাতরা গা ঢাকা দেয় পাশের ঘন জঙ্গলে। কারা ছিলেন সেই ডাকাতদলের প্রমুখ মুখ? হেমন্ত বিশ্বাস, দুলাল প্রামাণিক, কৃত্তিবাস মিত্র, ভরত সর্দার, গিরীন্দ্রনাথ ঘোষ এর মত বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত যুবকরাই এই ডাকাতি পরিচালনা করেন। জঙ্গলে ব্রিটিশ বাহিনী তন্ন তন্ন করে খোঁজ চালায় ডাকাত দলের। দিনের পর দিন, জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে তখন হতাশ ডাকাত দল। ব্রিটিশ বাহিনী চারিদিক দিয়ে জঙ্গল ঘিরে রেখেছে। যে কোনও মুহূর্তে ডাকাত দল ধরা পড়বে। মৃত্যু নিশ্চিত, সাথে লুঠের সামগ্রীও পৌঁছাবে না গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর কাছে। ডাকাতদল মনে মনে মা কালিকে স্মরণ করেন এই বিপদে। আশ্চর্যজনক ভাবেই ঠিক কালিপুজোর আগের দিন ব্রিটিশ বাহিনী জঙ্গল ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন পূর্ণ অমাবস্যা, মা কালির পুজোর তিথি। ডাকাতরা গ্রামে ফিরলো। ফিরেই মায়ের বিগ্রহ প্রতিস্থাপন করে মায়ের আরাধনা শুরু করলো। সেই থেকেই মায়ের নাম ডাকাত কালি। এই খবর ছড়িয়ে যায় সারা দেশ জুড়ে। দিকে দিকে ডাকাতরা মা কালির আরাধনা করতে শুরু করে। 

এখনও মাজদিয়ার প্রত্যেক ব্যক্তি এই ডাকাত দলকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেন। ডাকাত দলের উত্তর পুরুষরা কেউ বা শিক্ষক, কেউ বা রয়েছেন সেনাবাহিনীতে আবার কেউ বা পুলিশে কর্মরত। এই কালী পুজো নিয়ে এখনও একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। প্রতিবছর নাকি কালীপুজোর আগের দিন রাত্রে ডাকাতি করা চাই। নইলে মায়ের আরাধনায় ব্যাঘাত হবে। এই কাজ আটকাতে পুলিশ তাই আগে থাকতেই কয়েকজনকে সন্দেহবশত থানায় আটকে রাখে। এই সমস্যার সমাধান পেতে গ্রামের কয়েকজন সদস্য পুলিশের চোখ এড়িয়ে সেই আটক ব্যক্তিদের স্থানে কম্বলের মধ্যে লুকিয়ে যান। সেই সুযোগে আটক ব্যক্তিরা পালিয়ে গিয়ে ডাকাতি করে এসে পরদিন সকালে যথাস্থানে আবার ফিরে যান। পুলিশ এই ঘটনার কোন টেরও পায় না। ডাকাতির সামগ্রী দিয়ে মায়ের পুজোর সামগ্রী কিনে বাদবাকি জিনিস বিলিয়ে দেওয়া হয় অসহায় মানুষের মধ্যে। এই ডাকাতদল সব সময় দাঁড়িয়েছে গরীব এবং দুঃস্থ মানুষদের পাশে। এমনকি এই ডাকাতদল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ট্রেজারিতেও ডাকাতি করেছে।

এই ডাকাতে কালির পুজোর আগে ডাকাতির ঘটনা বন্ধ হয়েছে ইদানিংকালে। কোনও এক রাজবাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতদল মা কালির দর্শন পায়। মা কালি তাদের নির্দেশ দেয় ডাকাতি করা বন্ধ করতে। আসলে সে রাজবাড়ীর রাণী নিজেই মায়ের সাজে সেজে ডাকাতদলকে এই নির্দেশ দেন। 

More Articles