ছোঁয়াচে রোগী বলে জ্যান্ত ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে! লালন ফকিরকে ঘিরে আছে যে অজানা কাহিনি
Lalon Fakir: জনশ্রুতি আছে, ছেউড়িয়া মৌজায় লালন-ভক্ত মলম-শাহ কারিকর লালন ফকিরকে সাড়ে ১৬ বিঘে জমি দান করেন।
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায় |
ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায় |"
এ গান আপামর বাঙালির, যারা সেই ফকিরকে অন্তরের অনুরাগ দিয়ে আজও লালন করে চলেছেন | লালন সাঁইয়ের শিষ্যদের অনুমান অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১৭৭৪ সালে | তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালে | বেশির ভাগ শিষ্যের মত অনুযায়ী তৎকালীন নদিয়া জেলার কুষ্ঠিয়ার কুমারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের গোড়াই নদীর তীরে ভাঁড়ারা গ্রামে লালন ফকিরের জন্ম | তাঁর পূর্বনাম জানা যায় না, তবে বাবার নাম মাধব কর, মা পদ্মাবতী। আবার ১৮৮০ সালের ১৯ জানুয়ারি রেজিস্ট্রি করা একটি দলিলের বয়ান থেকে জানা যায়, "পাট্টা গ্রহীতা-শ্রীযুত লালন সাঁই, পিত মৃত সিরাজ সাঁই, জাতি মুসলমান, পেশা ভিক্ষা ইত্যাদি। সাকিন ছিউরে, পরগণা ভ্রাহিমপুর, ইষ্টাসন ভলকো, সাব রেজিস্টারি- কুমারখালি।"
এখান থেকেই লালনের জাতি-ধর্মের পরিচয় নিরুপণ জটিল হয়ে পড়ে। তবে সাঁইয়ের একটি পরিচয় নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একা এমন একজন মানুষ যিনি জাতি-ধর্মের সকল গন্ডির উর্ধ্বে থেকেছেন জীবনভর। ছোটবেলায় বাবা মারা যান। আর্থিক অনটনের কারণে লেখাপড়াও তেমন হয়নি। মামার বাড়ি ছিল চাপড়ায় কিন্তু মামার বাড়ির পরিবেশও তাঁর কাছে অসহ হয়ে উঠল। মনের দুঃখে মাঠে -ঘাটে-প্রান্তরে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতেন। কোনও ফকির মাঠের উপর দিয়ে গান গাইতে গাইতে গেলে লালন তাঁর পিছু নিতেন, একতারা বাজানো শিখতেন। এমনি করেই বাল্যকাল থেকে ফকির, বাউল, একতারা আর উদাসী ভাব তাঁর জীবনসঙ্গী হয়ে গেল।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায় তাঁর উপর এসে পড়ল। অল্প বয়সে বিয়েও হলো। কিন্তু নানা রকম সামাজিক উৎপীড়নের কারণে মা আর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে পথে বেরিয়ে পড়তে হলো। হাঁটতে হাঁটতে সেই ভাঁড়ারা গ্রামের শেষ প্রান্ত দাসপাড়ায় এসে পৌঁছলেন। সেখানেই নতুন করে ঘর বাঁধলেন। কিন্তু ওই যে উদাসীভাব, ঘরে মন টিকতে দেয় না। মনে প্রশ্ন জাগে- এ দেহটাই কি তবে ঘর, খাঁচা নয় তো? শুরু হলো এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা।
একবার দাসপাড়া গ্রাম থেকে অনেকে চললো মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে। লালনও সঙ্গী হলেন তাদের। বেশ কাটলো ক'দিন। কত নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হলো, কত নতুন কথা শুনলেন। কিন্তু গঙ্গা স্নান সেরে ফেরার পথে লালনের গায়ে তেড়ে জ্বর এল। সেই জ্বর গুটি বসন্তের। জ্বরের ঘোরে লালনের ভুল বকা শুরু হলো, জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, সকলে প্রমাদ গুনল। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কে দেখবে তাঁকে? সকলকে গ্রামে ফিরতে হবে তো! রাত্তিরে প্রবল জ্বর এল, কোনও সাড় নেই শরীরে। সংক্রামক ব্যাধির ভয়ে সঙ্গীর তাঁর দেহ ফেলে রেখেই পালাল। কয়েকজন আবার নামমাত্র মুখাগ্নি করে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিল তাঁর দেহ।
গঙ্গা স্নানের যাত্রীরা দাসপাড়ায় ফিরে আসতে সারা গ্রামে রটে গেল লালনের মৃত্যু সংবাদ। কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাঁর মা এবং স্ত্রী। সর্বহারার অবস্থা হলো তাদের। এদিকে গঙ্গা নদীর স্রোতের তালে-তালে কলার ভেলায় লালনের দেহ ভাসতে ভাসতে চলল, কত গ্রাম পেরিয়ে গেল। এমনি করে ঢেউয়ের ধাক্কায় ভাসতে ভাসতে কলার ভেলা একটা গ্রামের স্নানের ঘাটের কাছে একটা মস্ত বড় গাছের শিকড়ে এসে আটকে গেল। সেই ঘাটে তখন কয়েকজন গ্রাম্য বধূ স্নান করছিলেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। হঠাৎ মহিলারা এক পুরুষ কণ্ঠের গোঙানি শুনে চমকে উঠলেন। নিজেদের কথাবার্তা থামিয়ে কান পেতে রইলেন। আবার ওই শব্দ, ক্ষীণ কণ্ঠের। ফিরে তাকিয়ে দেখেন গুঁড়ির কাছে ভাসমান একটি ভেলায় এক পুরুষ মানুষের দেহ। গোঙাচ্ছে মানে বেঁচে আছে তো? একজন বাদে অন্য মহিলারা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। এদিকে তেষ্টায় লালনের ঠোঁট, গলা শুকিয়ে গেছে, ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন- জল, জল। জলের কথা শুনে মহিলাটি আঁতকে উঠে বললেন, "আমরা মুসলমান"। উত্তরে অনেক কষ্টে লালন নাকি বলেন, "মানুষের আবার জাত কী? একটু জল দাও, জল।" কথা শুনে মুসলমান মহিলার মনে দয়া হলো, লোকজন ডেকে লালনকে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। সেবায় শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুললেন তাঁকে। কে এই মহিলা?
গবেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, মহিলার স্বামীর নাম মলন কারিকর, বাস ছেউড়িয়া গ্রাম। আর তাঁর স্ত্রীর সেবাতেই লালন সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তাদের ঘরে সেই সময় সিরাজ সাঁই এসেছিলেন। সিরাজ সাঁইয়ের দেওয়া ওষুধ খেয়ে লালনের রোগ সারল, শরীরে বল ফিরে পেলেন কিন্তু গুটি বসন্ত রোগ চিরদিনের মতো কেড়ে নিল চোখের দৃষ্টি আর গোটা মুখ জুড়ে রয়ে গেল বসন্তের দাগ।
আরও পড়ুন- ‘যন্ত্রের কী দরকার, অন্তরে সব বাজতাসে!’ প্রকৃত ‘গুরু’ ছিলেন সুবল দাস বাউল
কোনও কোনও গবেষক বলেন, মলম কারিকর নয়, লালনকে সিরাজ সাঁই ঠাঁই দিয়েছিলেন। তার করুণায় মুগ্ধ হয়ে লালন সিরাজের সঙ্গেই পথে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু সিরাজ তাঁকে সঙ্গে নেননি।
লালন ফিরে যান নিজের গ্রামে, নিজের ভিটেয়। তাঁকে দেখে তার মা এবং স্ত্রী বিস্ময়ে ও আনন্দে আত্মহারা কিন্তু গ্রামের সমাজ লালনকে মেনে নিল না। রটিয়ে দিল লালনের জাত গিয়েছে, সে মুসলমানের অন্ন-জল খেয়েছে। ভাঁড়ারা গ্রামের মানুষ তাঁকে ভিটে ছাড়া করল। দুঃখে যন্ত্রণায় লালনের মন ভেঙে গেল। অভিমানে একতারা হাতে নিয়ে আবার পথে বেরিয়ে পড়লেন লালন। তাঁর তখন মধ্য যৌবন, মনে বৈরাগ্যের উদয় হলো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার সময় স্ত্রীকে ডেকেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি সঙ্গী হলেন না। লালনের মনে খালি প্রশ্নের ঢেউ উঠতে থাকল, এ কেমন জাত? এ কেমন বিচার? সুতীব্র অভিমানে ও কান্নায় উঠে এসেছে তাঁর সেই গান,
"সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে?
লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে"।
পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা হয়ে গেল সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে। সিরাজ ছিলেন বাউলগুরু। লালনের শিষ্যদের মতে, "সিরাজ হলেন আমাদের সাঁইয়ের গুরু দরবেশ। সুফি সাধক।"
এবার নিত্য নতুন প্রশ্ন নিয়ে লালন গুরুর কাছে হাজির হতে থাকলেন। বিশ্ব সংসার ও বিচিত্র জগৎ নিয়ে লালনের হাজার কৌতূহল। সে সব কৌতূহলের নিরসন সিরাজ সাঁই। ধীরে ধীরে তিনি লালনকে শেখালেন সাধনার আর এক রূপ রংমহলের কথা, সে আসলে দেহতত্ত্বের কথা। মানব দেহ এক রংমহল, তবে সেখানে তালা লাগানো। রংমহলের ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে সেই তালা খোলা শিখতে হয়। লালন তাই সিরাজ সাঁইয়ের কাছে নিয়মমতো দীক্ষা নেন। মনের মধ্যে ব্যাকুলতা জাগে মনের মানুষের সন্ধান পাওয়ার জন্য। একাকী ভাবের ঘোরে গান গান বাঁধেন, "আমার মনের মানুষের সনে, মিলন হবে কত দিনে।"
আরও পড়ুন- নেশা আর খিস্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলেন যে বাউল
লালন যত গুরুর নির্দেশিত পথে সাধনমার্গে এগোতে থাকেন তত নতুন নতুন উপলব্ধির স্বাদ পেতে থাকেন, আর সেই সব উপলব্ধি কাব্য হয়ে সুর হয়ে গান হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
জনশ্রুতি আছে, ছেউড়িয়া মৌজায় লালন-ভক্ত মলম-শাহ কারিকর লালন ফকিরকে সাড়ে ১৬ বিঘে জমি দান করেন। তাঁর উপরে লালন ফকির তাঁর আখড়া গড়ে তোলেন বাংলার ১২৩০ সালে | ছেউড়িয়ায় এসে থিতু হওয়ার পর লালন প্রথম দিকে গ্রামের বাইরে একটি বনের মধ্যে আমগাছের তলায় বসে সাধনা করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতি হতে থাকে, গ্রামের লোকজন তাঁকে গুরু মানতে শুরু করে। পরবর্তী কালে কখনও একা, কখনও শিষ্য সঙ্গী নিয়ে পাবনা জেলা রাজশাহী, ফরিদপুরের পথে চলে যেতেন। ক্রমে শিষ্য সংখ্যাও বাড়তে শুরু করে।
মানুষের জন্য লালনের প্রাণ কাঁদত, মানুষরে সেবার জন্য কবিরাজি চিকিৎসাও শুরু করেন তিনি। তিনি কেবল সাধক ফকির ছিলেন না। দুনিয়াদারির খবরও রাখতেন, ছিলেন স্বভাবকবি। প্রাণে ভাব এলে গান রচনা করতেন আর তাঁর শিষ্যরা তা লিখে রাখতেন। তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু হরিনাথের উদ্যোগে তাঁর 'ব্রহ্মাণ্ডবেদ' সংকলনে প্রথম লালনের গান মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করেন ১২৯২ সালে। গানটি ছিল, 'কে বোঝে সাঁইয়ের লীলা খেলা'।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গে লালনের কখনও সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে শিলাইদহে লালনের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে রবিঠাকুরের প্রায়ই লালনের গান ও দর্শন নিয়ে কথা হতো।
দিনাজপুরে এক দরবেশের কথায়, "সব বাউল দরবেশ নন | কিন্তু লালন ফকির ছিলেন দীক্ষায় দরবেশ আর সাধনায় বাউল"।