গোয়ার অহংকার ফেনি, সুরাপ্রেমী মাত্রই চেনেন, পাঁচ শতকের যে গল্পটা আজও অজানা

‘ফেনি’র স্বাদ নেওয়ার জন্যই দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসেন গোয়ায়। কাজুবাদাম থেকেই তৈরি হয় এই পানীয় যিনি একবার খেয়েছেন তিনি গোয়া ফেরত আসবেনই আসবেন, মনে করেন স্থানীয়রা।

গোয়ার কথা শুনলেই আপনার প্রথম কী মনে পড়ে? এক লহমায় নিশ্চয়ই মনে পড়ে যায় উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকত, পুরনো স্থাপত্য, শতাব্দী প্রাচীন চার্চের কথা। গোয়া মানেই নীল সমুদ্রের মাঝে রাতভর পার্টি, নানারকম সি ফুড-- আরও কত কী! সেই সঙ্গে মাথায় আসে গোয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা যা প্রায় ৪৫০ বছর ধরে ভারতীয় ও পর্তুগিজ সভ্যতার অনন্য মিশ্রণ। সুরাপ্রেমীদের তালিকায় এক পানীয় সংযোজন হবেই হবে। যার নাম ‘ফেনি’,  গোয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে থাকা এক দেশি মদ। এখন গ্লোবালাইজেশানের দয়ায় এই লোকালের অবশ্য গ্লোবাল চাহিদা তৈরি হয়েছে। ‘ফেনি’র স্বাদ নেওয়ার জন্যই দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসেন গোয়ায়। কাজুবাদাম থেকেই তৈরি হয় এই পানীয় যিনি একবার খেয়েছেন তিনি গোয়া ফেরত আসবেনই আসবেন, মনে করেন স্থানীয়রা। কিন্তু কবে কী ভাবে তৈরি হল এই পানীয়, ইতিহাসটা সুলিখিত নয়।

ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে উপনিবেশ বিস্তারের লক্ষ্যে গোয়ায় আগমন পর্তুগিজদের। নিজেদের দেশ থেকে আসার সময় প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি নিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছিল ভারতে। জানলে আশ্চর্য হবেন আমাদের বর্তমানে রোজ ব্যবহৃত বহু খাবারেরই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পর্তুগিজদের নাম। পর্তুগিজরাই তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল আলু, টমেটো, লঙ্কার মত দৈনন্দিন সবজি। এদেশে কাজু বাদামের চাষ শুরু তাদের হাত ধরেই। কাজুবাদামের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে ব্রাজিলেরও নাম। দীর্ঘদিনের পর্তুগিজ কলোনি ব্রাজিলেই প্রথম চাষ শুরু হয় কাজুবাদামের। পরে গোয়ায় বসতি স্থাপনের পর মাটির ক্ষয় রোধে পর্তুগিজরা কাজুবাদাম চাষ শুরু করে। পরে দেখা যায় ভারতীয় মাটি কাজুবাদাম চাষের অন্যতম উপযুক্ত ক্ষেত্র। বর্তমানে ভারত বিশ্বের অন্যতম কাজুবাদাম উৎপাদক দেশ। কিন্তু এই সবেরই শুরু সেই পর্তুগিজদের হাত ধরেই।

‘ফেনি’র প্রথম চুমুক

স্পষ্ট ভাবে জানা যায় না কে প্রথম ‘ফেনি’ তৈরি শুরু করেন।তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে অনুমান করা যায় ১৭৪০ সাল নাগাদ গোয়ায় কাজুবাদাম থেকে প্রথম তৈরি হয় ‘ফেনি’। গাছ থেকে ঝরে পরা পাকা কাজুবাদাম থেকেই একমাত্র তৈরি করা যায় ‘ফেনি’। এই পদ্ধতি সম্ভবত জানা ছিল না পর্তুগিজদের ও। ধরে নেওয়া হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতেই প্রথম তৈরি হয় এই পানীয়। ‘ফেনি’ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে তা অন্যান্য মদের বাজারকে গ্রাস করতে শুরু করে।স্বাভাবিক ভাবেই মুনাফা কমতে শুরু করে পর্তুগিজদের। ফলে এই পানীয়ের উৎপাদন নিয়ে প্রায়শই  গোয়ার  স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে অশান্তি হত পর্তুগিজদের।

মজার কথা হল যতই কাজুবাদামের সঙ্গে জুড়ে থাক পর্তুগিজ উপনিবেশিকতাবাদের ইতিহাস, ‘ফেনি’ কিন্তু জাতে খাঁটি ভারতীয়। এমনকি সংস্কৃত শব্দমালা থেকেই এসেছে তার নাম। সংস্কৃত শব্দ ‘ ফেনা’ থেকে এসেছে ‘ফেনি’ শব্দটি। ‘ফেনি’ গ্লাসে ঢালার সময় বা বোতলের মুখ খোলার সময় ঝাঁকুনিতে ফেনা হয়। সেই ফেনার অনুষঙ্গ থেকেই নামকরণ ‘ফেনি’ র।

‘ফেনি’ তৈরির পদ্ধতি

প্রতিদিন সকালে কাজু বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয় মাটিতে পড়ে থাকা পাকা কাজুগুলি। তারপর ফলের মুখে লেগে থাকা বীজ ছাড়ানো হয়। বীজ ছাড়ানোর পর ফলগুলিকে জমা করা হয় কলম্বি নামক একটু পাত্রে। কলম্বি মূলত বেসিন আকৃতির পাথরের পাত্র যেখানে কাজুর ভিতরে জমে থাকা রস নিঃসরণের জন্য খানিক সময় ফেলে রাখা হয়। এরপর কাজুবাদামগুলিকে পা দিয়ে পিষে পিষে রস বের করা হয়। কিন্তু বর্তমানে পা দিয়ে পিষে রস বের করার পরিবর্তে পিঙ্গার নামের একটি যন্ত্র ও ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেষণের পর ফলের মূল অংশটা আলাদা করে ঢিপির উপর রাখা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় নিষ্পেষণের পর যে রস বের হয় তাকে বলে ‘নিরো’। ‘নিরো’ খেতে ও অত্যন্ত সুস্বাদু।

এরপর ‘নিরো’-কে ‘কোদেম’ নামে একটি মাটির পাত্রে রাখা হয়। এই পাত্রেই চলে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতি। প্রায় দিন তিনেক রাখার পর যখন ফেনা ওঠা বন্ধ হয় তখন ‘ফেনি’ র প্রথম অবস্থা তৈরি হয়। এই প্রথম মিশ্রণটিকে বলে ‘উরেক’। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে ১২- ১৬ শতাংশ। এর দ্বিতীয় অবস্থাকে বলে ‘কাজুলো’। এর মধ্যে দিয়েই ধীরে ধীরে তৈরি হয় ‘ফেনি’ তখন এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে প্রায় ৪২-৪৬ শতাংশ।

এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে অবশেষে তৈরি হয় ঝাঁঝালো ফেনি-সুরাপ্রেমীদের মতে যার প্রসাদগুণ স্বর্গীয়।

এই অনন্য স্বাদই ‘ফেনি’ কে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ভারতের প্রথম মদ হিসেবে ২০০৯ সালে ‘ফেনি’ পেয়েছে গ্লোবাল জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ। জি আই ট্যাগ পাওয়ার মাধ্যমে স্কচ, টাকিলা, দার্জিলিং চায়ের উচ্চতায় উঠে এসেছে ফেনি। অর্থাৎ দার্জিলিং চায়ের বিশেষত্বই যেমন দার্জিলিং ছাড়া অন্য কোথাও মিলবে না, স্কটল্যান্ড ছাড়া যেমন স্কচ হবে না ঠিক তেমনি গোয়াতেই একমাত্র পাওয়া যাবে আসল ‘ফেনি’।

‘ফেনি’র হরেক কিসিম

মূলত দু ধরনের ‘ফেনি’ পাওয়া যায়। ‘কাজু ফেনি’ এবং ‘নারকেল ফেনি’। এর মধ্যে ‘কাজু ফেনি’র জনপ্রিয়তাই সব থেকে বেশি। ‘কাজু ফেনি’ খেতে ও নারকেল ‘ফেনি’র থেকে বেশি সুস্বাদু হয়। সেই কারণেই পর্যটকদের কাছে কাজুবাদাম দিয়ে তৈরি ‘ফেনি’র চাহিদা অনেক বেশি। ‘ফেনি’র সম্পর্কে বলতে গিয়ে ষোড়শ শতাব্দীর এক ইতালিয়ান পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, “ ফেনির গন্ধই একজন মানুষকে উন্মাদ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, আলাদা করে ফেনি পান না করলে ও চলবে”

এহেন দেশি মদ ‘ফেনি’ র গল্প শোনাতেই গোয়ার ব্যবসায়ী নন্দন কুরছারকরের বিশেষ উদ্যোগে গোয়ায় তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম মদের সংগ্রহশালা। সেখানে ৫০০ বছর আগে কী ভাবে তৈরি হত ‘ফেনি’ তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ধরা আছে। ২০১৬ সালে ‘ফেনি’ কে হেরিটেজ তকমা দেয় সরকার। গোয়ার ঔপনিবেশিক জীবন, আভিজাত্য, স্থানীয়দের বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক উদযাপন সব কিছুর সঙ্গেই মিলে মিশে গিয়েছে প্রাচীন এই সুরার ইতিহাস।

তাহলে আর দেরি কেন, সুরাসন্ধানীরা এক মদির পরিকল্পনা শুরু করুন!

More Articles